somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সন্তান

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শিলা হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল। স্বপন বাড়িতে নেই। বৃদ্ধা শতীশবাবু বাড়িতে একা। শতীশবাবু শিলাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে গেল। খবর শুভ। শিলা আবার মা হতে চলেছে। কিন্তু শতীশবাবু এ খবরে মোটেও সুখী নও। খবর শুনে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সারা শরীর একটা অসহ্য যন্ত্রণায় তিতিয়ে উঠছে। লজ্জায় মাথা হেড হয়ে যাচ্ছে। এ সহ্য করা যায় না।
শিলার স্বামীর সন্তান দেবার ক্ষমতা নেই। শিলা জানে এ কথাটি সে ছাড়া আর কেউ জানে না। গত বছর গাড়ি দুর্ঘটণায় তার স্বামীর অনেক কিছুই রদ বদল হয়। ডান পা’টাও নাকি কেটে ফেলতে হবে। শিলা একবার স্বামীর ঘর ছেড়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু, অসহায় স্বামীকে ছেড়ে যেতে পারেনি। পাঁচ বছরের সংসার। দুটি সন্তানও হয়েছিল। দুজনই ক্ষণিকের। তার স্বামীর দেওয়া উপহার সে রক্ষা করে রাখতে পারেনি।
শিলা চেয়ারে বসে টেবিলের সব বইগুলো গোছালো। তারপর স্বপনকে ফোন করল। পা’টা ভালো হওয়ার সম্ভবনা নেই। কাল অপারেশান হবে। কথা শেষ হলে শিলা আঁচল টেনে মুখ মুছল। কিন্তু চোখের জল এতো সহজেই থামল না। বাকী জীবনের কথা ভাবল। তার ঘর, তার সংসার একটা এক্সিডেন্টে এলামেলো করে দিল। এমন ভাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ করল যে তা কোনদিন নতুন করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
সন্ধ্যায় শতীশবাবু শিলাকে ডাকল। শিলা জানতো কেন ডেকেছে। সে জন্য তার প্রস্তুতিও ছিল।
“শিলা।”
“বাবা।”
“তুমি জান ডাক্তার কি বলেছে?”
“কাল আপনার ছেলের অপারেশান।”
“স্বপনের ডাক্তার নয় তোমার।”
“শুনছি।”
“তুমি এটা কি জান সেদিন আমিও মেডিকেলে ছিলাম? শিলা এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। তার শরীর কাঁপছে। একটা অন্যায় অপরাধ তার মাথা নিচু করে ফেলছে। শিলা যেন হঠাৎ থেমে গেল।
“শিলা, তোমাকে আমি কোনদিন এতো ছোট ভাবিনি।”
“বাবা, আমি মা হতে চাই। আপনার ছেলের সে ক্ষমতা নেই। কিন্তু আমি মা হতে পারব। একটা মেয়ে যত দিন মা হতে না পারে সে হয় মেয়ে নয় নারী। নারীর সবচেয়ে বড় পরিয়চয় তার মাতৃত্বে। আমি কোন অন্যায় করিনি। সমাজ আমাকে যতই ছোট চোখে দেখুক না কেন, আমি আমার সত্যিকার পরিচয় দিতে চাই। সমাজ সংসার, ধর্ম সব কিছুর উর্ধে আমি মা হতে চাই।”
“তোমার লজ্জা করে না?”
“করে। সে ক্ষণিকের অন্যায় আমাকে দলিত, মোহিত ,নিঃশেষিত করে দিয়েছে। আমার সারা জীবনের উপর একটা দাগ দিয়ে দিয়েছে। সে সম্ভোগ আমি দেহে নিয়েছি মনে নেইনি। মনে প্রাণে তা ঘৃণা করি। আবার সান্ত্বনা পাই। এতোটুকু ভুল আমার সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।”
“যদি স্বপন জানতে পারে?”
“জানবে না। ডাক্তারকে নিষেধ করে দিয়েছি।”
“বৌমা।”
“বাবা।”
“আমার আগের দুটি বাচ্চা আমার কোল ছেড়ে চলে গেছে। তাদের সে আঘাত আমার সারা বুকটাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে। আমি কোথাও একটু নীরব থাকতে পারি না। কে যেন আমাকে বার বার মা মা করে ডাকে। আমার মাথায় কোন কাজ করে না। পাগল হয়ে ঘর ছাড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু আপনার অসহায় ছেলেকে কে দেখবে? তাকে দিয়ে আবার নতুন ঘর বাঁধা যাবে না। সে সব দিক থেকে অক্ষম। শুধু ভালোবাসা, সব কিছু ফেলে কেবল ভালোবাসা সে ক্ষণিকের খেলা ঘর। তা বেশি সময় স্থায়ী হয় না। জোর করে হয়তো আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারেন। তাতে কি লাভ? সেও হয়তো এ রকম চেষ্টা করতো।
শতীশবাবুর চোখে জল এলো।
“বাবা, একটু শেষ বয়সের কথা ভাবুন। আমাদের কি গতি হবে। আপনার ছেলে পঙ্গু, আমি মহিলা আর আপনি বৃদ্ধ । কে আমাদের আশ্রয় দেবে? আমরা কি ভাবে জীবন চালাব?”
“তবু কাজটা ঠিক হয়নি।”
“একটা প্রশ্ন করি? আমার বেলা এমন হলে আপনারা কি মেনে নিতেন? এতোদিনে কেউ একজন বউ সেজে আমার সব কিছু কেড়ে নিত। আমি অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। আপনারা কেউ আমার কথা ভাবতেন না। তবু বলি, মন চাইলে আপনারা আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এ সন্তান আমি ফেলব না। যার সংসার নেই তার সমাজ দিয়ে কি হবে। তাছাড়া ফেললেও আমার দেহের দাগ মুছে যাবে না। তাই আমি সমাজ চাই না।”
শতীশ বাবু চলে গেল। শিলা নীরব হয়ে গেল। ওর অনাগত সন্তান তাকে আবার নতুন নামে পরিচয় করে দেবে। হোক সে সমাজের চোখে মিথ্যা, ধর্মের দৃষ্টিতে পাপিষ্ঠ। তবু শিলা সে পাপ মাথায় তুলে নেবে।”
বিশদিন পর স্বপন এলো। ক্র্যাচে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনের কোণে। শিলা দৌঁড় দিয়ে বেরিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। স্বপনের চোখে মুখে মলিন মূর্ছিত দাগ। শিলার চোখে জল গড়িয়ে গেল। ক্র্যাচখানা বাম হাতে নিয়ে ডান হাত দিয়ে স্বামীকে ধরল।
রাতে শিলা কাঁদছে। স্বপনের বুক ভিজে গেল। শিলার এক চোখে অপবাদের অশ্র“ আরেক চোখে স্বামীর প্রতি নিয়তির অবিচারের ক্র্যাচ। স্বপন শিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল, “শিলা, তুমি কোন দোষ করোনি।”
শিলা মাথা খাড়া করল। ওর সমস্ত শরীর যেন থেমে গেল। ওর বুকে সংশয়।
“তুমি যখন আমাকে খবর দিলে আমি আবার বাবা হতে যাচ্ছি ঠিক তার দেড় ঘণ্ট পর ডাক্তার আমাকে বলল, আমি আর কোনদিন বাবা হতে পারব না। গত এক্সিডেন্টে আমার সে ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু সময় আমার নার্ভগুলো অকেজো হয়ে গেল। তবু তোমার এ আনন্দকে আমি মিথ্যা করে নিইনি। যাদের করার ক্ষমতা নেই তাদের অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। এটাই মেনে নিয়েছি। তোমাকে একটা প্রশ্ন করি? তুমি আমাকে যে ঠকালে তাতে আমার কি দোষ ছিল। আমি কি ইচ্ছা করেই এ ক্র্যাচ কাঁধে নিয়েছি?”
শিলা নীরবে কেঁদে চলল। স্বামীর প্রশ্নের কাছে সব কিছু মিথ্যা হয়ে গেল। মাতৃত্বের পরিচয়কে সে প্রশ্ন ধিক্কার দিল।
স্বপন শিলার মাথা ধরে খাড়া করল। বলল, আমি খুশি হয়েছি। তুমি পাশে থাকলে আমি সব কিছু ভুলে যাই। তাছাড়া আমি আবার বাবা হব। মিথ্যা হলেও। তুমিও জান, বাঙ্গালী সমাজ এটা মেনে নেয় না। মনে দারুণ কষ্ট দেয়। তবে তুমি তাকে মিথ্যা পরিচয় দিওনা। সে আমারই সন্তান।
২৯ আগস্ট ২০১২ইং
তেঁতুলিয়া, কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×