বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের চেষ্টা প্রতিহত করতে ভোটকেন্দ্রভিত্তিক প্রতিরোধ কমিটি গঠনের ডাক দিয়েছেন খালেদা জিয়া।
Published : 05 Oct 2013, 05:58 PM
সিলেটে শনিবারের জনসভায় তিনি নির্দলীয় সরকারের দাবি আবার জানিয়ে বলেছেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে শুরু হওয়া ১৮ দলের এই জনসভায় বিকালে দেয়া বক্তব্যে আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারকে হুঁশিয়ার করেন বিরোধীদলীয় নেতা।
খালেদা জিয়া দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “আওয়ামী লীগের একক নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য কেন্দ্রভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে হবে। জনগণকে নিয়ে এই কমিটি করতে হবে। আমি এখন থেকে সংগ্রাম কমিটি গঠনের নির্দেশ দিচ্ছি।”
সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিদেশিদের চাওয়ার কথা তুলে ধরে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “এককভাবে নির্বাচন করলে সেটা কোথাও গ্রহণযোগ্য হবে না। এককভাবে নির্বাচন করতে দেয়া হবে না।”
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের ফলে আওয়ামী লীগের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন হবে এবং তা আগামী ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বয়কটের হুমকি দিয়ে আসছে বিএনপি। এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপি না এলেও সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে।
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগকে ২০০৭ সালের কথা স্মরণ করিয়ে দেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
“সংবিধান অনুসরণ করে আপনি তখন বিচারপতি কে এম হাসানের অধীনে নির্বাচনে রাজি হলেন না কেন? আপনি তো আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, আপনার অধীনে নির্বাচন কীভাবে হবে?”
“এজন্যই আপনার (শেখ হাসিনা) অধীনে নির্বাচন হবে না। যতই চিৎকার করেন না কেন, আপনাকে বিদায় নিতেই হবে।”
২৪ অক্টোবরের পর জোরদার আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, “২৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সময় শেষ। এ সময়ের মধ্যে নির্দলীয় সরকারের দাবি না মানলে ২৫ অক্টোবর থেকে আমরা আন্দোলন শুরু করব।”
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্যে করে তিনি বলেন, “আপনার দলের অনেকে এখন বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। অনেকে পকেটে টিকিট কেটে ওপেন ভিসা নিয়ে ঘুরছে। সংগ্রাম কমিটি হলে আপনি দেখবেন- আপনার বায়ে, ডানে, সামনে, পেছনে কেউ নেই। তখন কেবল আমরাই থাকব।”
বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় গেলেও প্রতিহিংসাপরায়ণ না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, “আমরা আপনাকে সম্মানের সঙ্গে রাখব। আমরা প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না।
সরকারি কর্মকর্তাদেরও দল নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “কারো চাকরি খাওয়া হবে না। আপনারা দেশ ও মানুষের কথা চিন্তা করেন। অন্যায়ভাবে জনগণের ওপর গুলি চালাবেন না।”
“তাই এখনো বলছি, আপনি (শেখ হাসিনা) সংসদে নির্দলীয় সরকারের বিল এনে পাস করুন। যতদিন মেয়াদ আছে, আপনারা থাকুন। তবে একক নির্বাচন হলে রাজপথে দেখা হবে,” হুঁশিয়ারি দেন খালেদা জিয়া।
ঈদের পর নির্দলীয় সরকারের আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণার আগে গণসংযোগের অংশ হিসেবে সিলেটে এই জনসভা করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এর আগে নরসিংদী, রংপুর, রাজশাহী ও খুলনায় জনসভা করেন তিনি।
৫০ মিনিটে বক্তব্যে সরকারের ‘দুর্নীতি-দলীয়করণের’ সমালোচনার পাশাপাশি বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কী কী করবে, তাও বলেন খালেদা জিয়া।
বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, “সরকার প্রশাসন, বিচার বিভাগ সব কিছু দলীয়করণ করে ফেলেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন হলে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। কারণ ডিসি, এসপি, টিএনও, ওসি সবাই প্রধানমন্ত্রীর কথামতো কাজ করবে।
“নির্দলীয় সরকার ছাড়া সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি হবে না। নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে হলে দুই পক্ষের জন্য নির্বাচনের মাঠ মসৃণ হতে হবে। উঁচু-নিচু হলে চলবে না।”
নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, “বর্তমান ইসি সরকারের আজ্ঞাবহ ও মেরুদণ্ডহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তারা শুধু ‘জি স্যার’, ‘জি স্যার’, ‘জি স্যার’ করেন। তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।”
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে দুপুর ১২টায় সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি এম এ হকের সভাপতিত্বে কোরআন তেলওয়াতের মধ্য দিয়ে জনসভা শুরু হয়।
খালেদা জিয়া যখন সভাস্থলে পৌঁছান, তখন কানায় কানায় ভরা আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানানো হয়।
১৮ দলের এই জনসভার আগে সকাল থেকে জামায়াত-শিবির ও জমিয়তে উলামা ইসলামের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক মহড়া দেখা যায়। জনসভাস্থলে তাদের একের পর এক মিছিল আসছিল।
দুপুরের পর বিএনপি ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের মিছিল আসতে থাকে। বেলা দেড়টার দিকে ছাত্রদলের মিছিল এলে বসা নিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরকর্মীদের সঙ্গে তাদের মারামারি বাঁধে, পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
সিলেটের এই জনসভায় মাঠের চারপাশে ছিল এম ইলিয়াস আলীর সন্ধান দাবিতে তার ছবি সম্বলিত ডিজিটাল ব্যানার। নিখোঁজ বিএনপি নেতার ছোট মেয়ে সাইয়ারা নাওয়ালের ছবি সম্বলিত ডিজিটাল ব্যানারে আকুতি ছিল- ‘আমার আব্বুকে ফিরিয়ে দাও’।
দেড় বছর আগে ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী।
জনসভায় বক্তব্যে খালেদা জিয়াসহ সব নেতারাই ইলিয়াস আলীকে স্মরণ করেন। খালেদা জিয়া বলেন, টিপাইমুখ বাঁধের বিরোধিতা করায় বিরোধী দলের এই নেতাকে ‘গুম’ করা হয়েছে।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনাও জনসভায় বক্তব্য রাখেন।
সিলেটের নেতা ও অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান ছবি সম্বলিত ব্যানারও ছিল জনসভায়। গত ৫ জুন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নামেও ব্যানার ছিল।
কর্দমাক্ত মাঠ ছাড়িয়ে জনসভার বিস্তার উত্তর পাশে আম্বরখানা সড়ক, দক্ষিণে জিন্দাবাজার সড়ক, পুরাতন মেডিকেল কলেজ সড়ক, পশ্চিমে রিকাবি বাজার ভিআইপি সড়ক, পূর্বে চৌহাট্টা মীরবক্সটোলা সড়কে ছড়িয়ে যায়।
খালেদা জিয়ার আগমন ঘিরে সার্কিট হাউজ থেকে মাঠ এলাকাসহ গোটা মহানগরীতে নির্মাণ করা হয় কয়েকশ’ তোরণ। সারি সরি রঙিন পতাকা দিয়ে সড়কের দুই পাশ সাজানো হয়।
জনসভায় ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন, রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, সাদেক হোসেন খোকা, শমসের মবিন চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, ওসমান ফারুক, শামসুজ্জামান দুদু, আমানউল্লাহ আমান, বরকতউল্লাহ বুলু, মাহবুবউদ্দিন খোকন, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সাখাওয়াত হোসেন জীবন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, শাম্মী আখতার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মীর সরফত আলী সপু, নুরী আরা সাফা, শিরিন সুলতানা, আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল প্রমুখ।
১৮ দলের নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এলডিপি সভাপতি অলি আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদের সাংসদ আ ন ম শামসুল ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোটের আমির আবদুল লতিফ নেজামী, খেলাফত মজলিশের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইসহাক, বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, জমিয়তে উলামা ইসলামের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শাহীনুর পাশা চৌধুরী, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, মুসলিম লীগের সভাপতি এ এইচ এম কামরুজ্জামান খান প্রমুখ।
সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকী, সাংগঠনিক সম্পাদক রেজাউল হাসান কয়েস, সিনিয়র সহসভাপতি দিলদার হোসেন সেলিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আলী আহমেদ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ তৌফিকুল হাদী, মৌলভীবাজারের সভাপতি এম নাসের রহমান, সুনামগঞ্জের সভাপতি ফজলুল হক আসপিয়া, হবিগঞ্জের সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়সল জনসভায় বক্তব্য দেন।
সিলেটের জামায়াত নেতা সায়েফ আহমেদ, আনোয়ার হোসাইন, হাবিবুর রহমান, ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা ফয়জুল হক জালালাবাদী, খেলাফত মজলিশের নেতা হাজী নুরুজ্জামান, জমিয়তে উলামা ইসলামের নেতা মনসুরুল হাসান রায়পুরী, জিয়াউদ্দিন, জাগপা নেতা মকসুদ আহমেদও জনসভায় বক্তব্য দেন।