somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোরবানি কথনঃ

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পৃথিবীর তিনটি দেশে শতকরা ১০০ ভাগ মুসলমান। মালদ্বীপ, সোমালিয়া ও সৌদি আরব। এই তিনটি দেশের সাথে আমাদের কোরবানি সংস্কৃতির একটি তুলনামূলক আলোচনা করতে চাই।
মালদ্বীপ পুরোপুরি মুসলিম সংস্কৃতির একনিষ্ঠ অনুসারী। ভারত মহাসাগরে ১০০টিরও বেশি ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে মালদ্বীপ রাষ্ট্র গঠিত। দেশটির মোট আয়তন ৩০০ বর্গ কিলোমিটার। দেশটির মোট জনসংখ্যা প্রায় চার লাখ। ১০০ ভাগ মুসলমানের দেশ হয়েও মালদ্বীপে একটি পশুও কোরবানী হয় না। এখানে পশুপালনই নিষিদ্ধ। জীবনমান আমাদের চেয়ে উন্নত হওয়া সত্ত্বেও কোরবানির মত স্পর্শকাতর একটি ধর্মীয় অধিকার নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই। কোন মিছিল, মিটিং, ফতোয়াবাজীসহ ন্যূনতম কোন উগ্র পদক্ষেপের কথা জানা যায় না।

সোমালিয়া দুর্ভিক্ষ পীড়িত জাতিগত দাঙ্গার দেশ। এখানে খুব কম মানুষ কোরবানি দেয়ার সক্ষমতা রাখে। যারা কোরবানি দেয় তারা ভেড়া বা ছাগল কোরবানি দেয় বেশী । উট ও গরুও কোরবানি হয় তার সংখ্যা কম যা হয় প্রায় সবই সাতভাগে। একক গরু বা উট খুবই কম কোরবানি হয়। তবে বিদেশী ধনী মুসলমান অনেকে সোমালিয়ায় গিয়ে কোরবানি দিয়ে থাকে।

এবার আসি ইসলামের তীর্থভূমি সৌদি আরবের কোরবানি নিয়ে। পেট্রোডলারের দেশগুলোতে আসলে ‘নিত্য-ঈদ’ বিদ্যমান বিধায়, ‘ঈদ’ তাদের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। কারণ তাদের খাওয়া, যাতায়াত, পোশাক, পড়া, চিকিৎসা, বসবাস, বিয়ে সবই রাজকীয় তথা ‘নিত্য ঈদের মত’। সাধারণত অনেক সৌদি-ই বলে থাকে যে, তাদের কোরবানী করতে হবেনা; কোরবানী করবে কেবল হাজীরা, মানে যারা হজ্জ করতে গিয়েছে তারা। কারণ আগে নাকি কেবল হজ্জ সম্পন্নের পরই কোরবানী করা হতো। ঈদ কিংবা কোরবানি পেট্রোডলারের দেশগুলোতে কোন বাড়তি উৎসবের আবহ তৈরী করে না। নতুন জামা কাপড়, বিশেষ খাবার দাবার, ধনী-গরীব নির্বিশেষে ঈদগাহে একত্রিত হয়ে ঈদের নামাজ আদায় পরবর্তি কোলাকুলি, সৌহার্দ্য বিনিময় সব কিছুই প্রায় অনুপস্থিত।

আরবে মূলত ফজরের নামাজের সময় সবাই নিত্য দিনের মতই মসজিদে যায়, সূর্যাদয়ের পরে ঈদের নামাজ পরে চলে যায় নির্দিষ্ট কসাইখানায় কোরবানি দিতে। দুইভাবে কোরবানির ব্যবস্থা করা যায়। একটি নিজে পশু কিনে অন্যটি আইডিবর (ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক) মাধ্যমে। ১৯৮৩ সাল থেকে সৌদি সরকারের ফরমান অনুযায়ী এ প্রকল্প ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক বাস্তবায়ন করে আসছে। এবার সৌদি সরকার হাজীদের জন্য কোরবানি ব্যয় ৪৯০ রিয়াল বা বাংলাদেশী টাকায় ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে।

জেদ্দার একমাত্র ‘পশুর হাট’ (সুক আল হায়ওয়ানাত) যা জেদ্দার সবচেয়ে দক্ষিণাঞ্চল ‘সানাইয়া’তে অবস্থিত। পশুর হাটের সাথেই লাগোয়া কসাইখানা বা স্লোর্টা সেন্টার বিদ্যমান, যার আরবী নাম “মাসলাক-সানাইয়া”। ভেড়া, দুম্বা, ছাগল, গরু ও উট প্রত্যেকটির দাম সরকার কর্তৃক নির্ধারিত। বেশী দাম হাকা, কোন তোলা, খাজনা বা হাসিল নেই। কেনার পর ক্রেতাকে পশুটি দেয়া হয়না, প্রমাণ স্বরূপ একটি রশীদ দেয়া হয় মাত্র, রশিদের নম্বরটি ক্রয়কৃত পশুটির গায়ে রং দিয়ে বা বিশেষ পদ্ধতিতে আরবীতে লেখা হয়, যাতে কোরবানীর সময় কার কোনটি তা চেনা যায় সহজে। কারণ হচ্ছে, সৌদি নিয়ম অনুসারে কেবল কসাইখানা বা স্লোর্টা সেন্টার বা “মাসলাক” ছাড়া অন্যত্র পশু জবেহ করার কোন নিয়ম নেই। উল্লেখ্য পশ্চিমা উন্নত দেশসমূহে সর্বত্রই প্রায় একই নিয়ম। জেদ্দা ছাড়া হজ্জ্বের পর মিনাতে ব্যাপক পশু কোরবানী করা হয়। মিনায় হজ্জ্বেও প্রায় ৭/৮ দিন আগেই হাজীদের প্রায় দ্বিগুণ পশু বিদেশ থেকে বিশেষ করে ইয়েমেন, অস্ট্রেলিয়া, ভারত প্রভৃতি দেশ থেকে আমদানী করে মজুদ করা হয়। জেদ্দার প্রায় ১০-গুণ আয়তনের মিনার কসাইখানার নাম হচ্ছে “মাসলাক-মিনা”। হজ্জ্বের শেষ পর্যায়ে লক্ষ লক্ষ হাজী এখানে এসে নিজ হাতে ছোট আকৃতির পশু মানে দুম্বা, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি কোরবানী করলেও অনেক হাজী সরকারী কসাইদের মাধ্যমে তাদের কোরবানী সম্পন্ন করে। তবে গরু এবং উট হাজীরা নিজেরা কোরবানী করতে পারে না। অবশ্যই সরকারী কসাইয়ের মাধ্যমে জবাই করতে হয়।‘আইডিবি’র মাধ্যমে যারা কোরবানী দেন, তারা মিনায় অবস্থিত নির্দিষ্ট ব্যাংক শাখায় সরকারী রেটে কোরবানীর পশুর জন্যে টাকা জমা দিলেই কাজ শেষ। আইডিবি ঐভাবে সংগৃহীত লক্ষ লক্ষ পশু কোরবানী করে তার অধিকাংশ মাংস বিশেষ পরিবহণ মারফত গরিব মুসলিম দেশগুলোতে প্রেরণ করে।

নিজের হাতে যে সকল লাখ লাখ হাজী মিনাতে পশু কোরবানী করে, তার অধিকাংশ অপচয় তথা পুড়িয়ে ফেলা হয়। আগে কোরবানির পশুর মাংস ওষুধ দিয়ে নষ্ট করে ফেলা হতো। বর্তমানে মিনায় বিশেষ বুলডোজার দিয়ে ১৬-চাকার বড় আকৃতির ট্রাকে করে মিনার পূর্ব উত্তর কর্ণারে অবস্থিত বিশেষ “ভ্যানিশিং চুল্লীতে” ধ্বংস করা হয়। বুলডোজার দিয়ে কোরবানীর পশু ট্রাকে তোলার সময় ট্রাক ও বুলডোজারের চাকায় পিষ্ট হয়ে অনেক পশু থেতলে যায় ও এক ভয়াবহ দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। বুলডোজার দিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে অনেক আফ্রিকান গরিব দেশের লোক এবং কিছু কিছু বাঙালি, ‘বার্মিজ’ (সৌদিরা তাদের বাঙালি হিসেবে জানে) এখান থেকে কোরবানিকৃত পশু সংগ্রহ করে। অনেক নিগ্রো ‘তুকরুনী’ ঐ সময় মাংস শুকিয়ে শুটকি তৈরী করে এবং পুড়িয়ে বিক্রি করে, যে কারণে মাংসের পোড়া, শুকানো ও পচা গন্ধে মিনায় অস্বাস্থ্যকার পরিবেশ বিরাজ করে। মাংসের এই বিশাল অপচয় নিয়ে মুসলিম বিশ্ব কিংবা বিশ্ব বিবেকদের কোন উচ্চবাচ্য নেই। অপচয় বন্ধের কোন পরিসংখ্যান নেই, কোন গবেষণা নেই, অপচয় বন্ধের কোন যুগোপযোগী উদ্যোগও নেই। এতো গেল কোরবানির কথা; কিন্তু সারা বছর সৌদি শেখরা যে পরিমান অপচয় করে (শুধু খাদ্য নয়) তা দিয়ে পৃথিবী ক্ষুধার্ত মানুষের একটি বড় অংশের আমিষ চাহিদা মেটানো সম্ভব। খাদ্যের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিমত শেখরা পাতেই নষ্ট করে ৯০ শতাংশ খাদ্য। অথচ অমাদের ভাতের থালা থেকে একটি ভাতও ছিটকে পড়লে আমরা আঁতকে উঠি।

এবার তাকাই নিজের দেশে। বাংলাদেশের ইসলাম নিয়ে অতীতে অনেক কথা হয়েছে। অনেকে একে স্থানীয় ইসলামও বলেছে। নবীজীর মৃত্যু পরবর্তি সময়ে ইসলামে মোটাদাগে বিভক্তিও কম আসেনি। তবে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার ইসলামের তুলনায় বাংলার ইসলাম অনেক বেশী সহনশীল, অনেক বেশী আধুনিক যার প্রসার ঘটেছে পীর, আউলিয়া ও সুফীদের দ্বারা; তরবারী মারফত কোন শাসক কিংবা যোদ্ধাদের হাতে এর প্রসার হয়নি। আফগান তুর্কি যোদ্ধারা ইসলামের নামে দেশ জয় করেছে ঠিকই সেই সাথে হত্যা করেছে লাখ লাখ মানুষ, ধ্বংস করেছে হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতা, লুটে নিয়েছে সর্বস্ব। রক্তপিপাষু, লুটেরা যোদ্ধাদের প্রভাবে নয় মানুষ এখানে ধর্মান্তরিত হয়েছে মুসলিম সাধু পুরুষদের সহজ সরল জীবন ও মানবিক ধর্মীয় অদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। অধিকাংশ বিশ্লেষকরাই বলেছেন মধ্যপ্রাচ্যের মরুময় ইসলাম পারস্যের সুফীদের দ্বারা এখানে প্রেমময় ইসলামে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই প্রেমময় ইসলামের মধ্যেও কিছু ট্যাবু ঢুকে পড়েছে। ধর্মব্যবসায়ীদের প্রভাব আমাদের দেশেও রুটলেবেল পর্যন্ত প্রসারী।

‘ঈদগাহ’ ধারণাটি আরবদেশ সমূহে অনুপস্থিত। ভারতবর্ষ ছাড়া আর কোথায়ও সম্ভবত ‘ঈদগাহ’ নেই। বছরে শুধুমাত্র দুই দিন ব্যবহারের জন্য শহরের কেন্দ্রে বিশাল পরিসরে ‘ঈদগাহ’ নির্মান রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি অপরিহার্য চাহিদা। বাংলাদেশে কোরবানি মুসলিম মধ্যবিত্তের কাছে একটি অলিখিত ফরজ। কয়েক দশক আগেও শহরগুলোতে হাতে গোনা কয়েকজন ধনাঢ্য মানুষ আস্ত গরু কোরবানি দিত। সবাই মূলত ভাগে কিংবা খাসী কোরবানি দিত। দিনে দিনে কোরবানি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক স্ট্যাটাসের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক মধ্যবিত্তের একটি বড় অংশই এখন আস্ত গরু কোরবানি দেয়ার চেষ্টায় জান কোরবান করে। আমরাই একমাত্র জাতি, যারা সারা বছর মোট যে মাংস খাই তার ৬০ শতাংশই খায় কোরবানির সময়ে। সে মাংশ কতটুকু স্বাস্থ্য সম্মত পেপারের পাতা খুললেই আমরা তা দেখি। নিষিদ্ধ স্টরয়েড ইনজেকশনে গরু মোটা তাজা হয় সত্য কিন্তু বিষাক্রিয়ার প্রভাবে বিশালদেহী গরুগুলো নিস্তেজ হয়ে থাকে। গরুর হাটে গুতা দেওয়ার ও শক্তি থাকে না তাদের। গত কোরবানিতে উত্তরার একটি গরুও হাটে দেখলাম একটি বিশালদেহী গরুর দাম হাকলো দেড় লাখ টাকা, কিন্তু সেটি বসেই আছে-দাড়ায়না। এক ডাক্তারের সাথে তার রফা হলো ১২ ঘন্টার মধ্যে সে গরুকে দাড় করাবে এবং পরবর্তি ২৪ ঘন্টার গ্যারান্টি দিল। তিন হাজার টাকায় চুক্তি হলো। এবার অবশ্য খবরে দেখলাম কর্তৃপক্ষ প্রতিটি গরুরহাটে বিষাক্রিয়া শনাক্তের ব্যবস্থা করেছে। যতই বিষাক্ত হোক না কেন এ্যাট এ টাইম এই বিশাল পরিমানের মাংশ আমাদের মত অনাহারী দেশে পুরোটাই ভক্ষণ হয় সত্য কিন্তু কিভাবে হয় তাও আমরা দেখি। কোরবানী পরবর্তী ঢাকায় ফেরা লঞ্চ যাত্রীদের কাছে এ অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়। পাতিল ভরা, বালতি ভরা, বস্তা ভরা গোস্ত। ঝুড়া গোস্ত, হলুদ মাখাগোস্ত, গোস্তের শুটকি, বাশি গোস্ত, ফুলপাক/অর্ধ্বপাক গোস্ত..বাহারি গোস্তের নষ্ট গন্ধে ভরপুর চারপাশ। সারা বছর মহা মুল্যবান, দু¯প্রাপ্য গোস্ত কোরবানিতে এসে খুবই সহজ প্রাপ্য হয়ে যায় বলে ঢাকায় নিম্ন আয়ের মানুষ কোরবানির দিনে সবাই কসাই বনে যায়। গোস্ত কাটার খাটিয়া, কয়েকটি ছুড়ি, ড্যাগার এবং ২/৩ জনের একটি গ্র“প হলেই হলো, কোন অভিজ্ঞতারও প্রয়োজন নেই। পেশাদার, অপেশাদার কিংবা ছদ্মবেশী কসাই সবারই একই রেট, গরুর মোট মূল্যের ২৫%। পেমেন্ট ১০০% ক্যাশ। গোস্ত, চামড়া, যাকাত কিংবা ফেতরা দিয়ে এর কম্পেনসেশন হবে না।

এবার দেখা যাক বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা কতটুকু মাংস খাই। মাছে ভাতে বাঙালি বলেই বোধ হয় আমাদের গোস্তের সাথে দোস্তি হয়নি। বাংলাদেশ পৃথিবীর ৭ম বৃহত্তম গরুর দেশ। বিশ্বে মোট গরু সংখ্যা ১.৪ বিলিয়ন, আর আমাদের আছে ২৫ মিলিয়ন। কিন্তু মাথা পিছু গোস্ত ভক্ষনের তালিকায় আমাদের অবস্থান সর্বপশ্চাতে। ২০০২ সালের ফাও ডাটা অনুযায়ী মাথা পিছু গোস্ত ভক্ষনের বাৎসরিক পরিমান- আমেরিকা ১৯৭০ সালে ১০৫.৯ কেজি, ২০০২ সালে বেড়ে দাড়ায় ১২৪.৮ কেজি। ইংল্যান্ড ১৯৭০ সালে ৭৩ কেজি ও ২০০২ সালে ৭৯.৬, ভারত ৩.৬ ও ৫.২, পাকিস্তান ৭.৫ ও ১২.৩, মালেশিয়া ১৫.৫ ও ৫০.৯, চীন ৯ ও ৫২.৪। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিরামিষাসী দেশ ভারত, যার প্রায় ৩৫ তেকে ৪০ শতাংশ মানুষ ভেজিটেরিয়ান, সেদেশেও মাথা পিছু গোস্ত ভক্ষনের পরিমান ৫.২। ব্যতিক্রম একমাত্র বাংলাদেশ ১৯৭০ সালে ৩.৭ কেজি ২০০২ সালে তা কমে দাড়ায় ৩.১ কেজি । বর্তমান বিশ্বে মাথা পিছু গোস্ত ভক্ষনের গড় ৪২ কেজি। মুসলিম অধ্যুষিত দেশ গুলোতে গড় ভক্ষণ ২৫ থেকে ৩০ কেজি। আর আমাদের ৩.১ কেজি। আমাদের মত কিংবা তারচেয়েও কম গোস্ত ভক্ষন করে পৃথিবীতে একটি মাত্র দেশ ভূটান; জনপ্রতি বাৎসরিক ৩ কেজি কিন্তু ভূটানেও ভেজিটারিয়ানের সংখ্যা অনেক। সেই হিসেবে বিশ্বে এই বাঙালির পাতেই সবচেয়ে কম গোস্ত জোটে। সবার পাতই ক্রমস্ফীত আর আমাদেরই উল্টো এবং যথারীতি প্রান্তপাত।

উল্লেখ্য পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় শুকরের গোস্ত। ২০১২ সালে ১১১.৭ মিলিয়ন টন শুকরের গোস্ত, ১০৩.৫ মিলিয়ন টন পোল্ট্রি, ৬৭.৫ মিলিয়ন টন গরু ও ১৩ মিলিয়ন টন ছাগল/ ভেড়ার গোস্ত উৎপন্ন হয়েছে।
কোরবানীর অর্থনীতি নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ কোন গবেষণা এখনও হয়নি। আমাদের দেশে জবাইকৃত প্রায় সকল পশু চামড়াই বিভিন্ন হাত ঘুড়ে সবশেষে ট্যানারীতেই আসে। ট্যানারী মালিকদের দেয়া তথ্যের উপর ভিক্তি করে অর্থনীতিবিদ মামুনুর রশীদ হিসাব করে দেখিয়েছেন এবারের কোরবানিতে লেনদেন হবে ১৫ হাজার কোটি টাকার উপরে। এর মধ্যে রয়েছে ৭০ লাখ পশু যার ৩০ শতাংশ ছাগল বা ভেড়া ও মসলাপাতি। টোটাল লেনদেনটাই হবে শতভাগ ক্যাশ টাকায়। এই বিশাল অংকের টাকার ব্যবস্থা করতে বেড়ে যায় কলমানি রেট; বাংলাদেশ ব্যাংককে নতুন নোট ছাপাতে হয় যার কারণে বেড়ে যায় মুদ্রাস্ফীতি। যে পরিমান গরু কোরবানিতে জবাই হয় তার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশই আসে ভারত থেকে। কিছু গরু মায়ানমার থেকেও আসে কিন্তু সেগুলো ঢাকা পর্যন্ত আসতে পারে না, গরুপ্রেমী চিটাগাংবাসীই তা হজম করে। ইদানিং ভূটান থেকেও সামান্য কিছু গরু আসা শুরু হয়েছে। যাই হোক গরু আমদানীর জন্য কোন এলসি বা ঋণপত্র হয় বলে শোনা যায় না। গোটাটাই চোরাকারবারী। পেমেন্টে হয় হুন্ডির মাধ্যমে অথবা পন্য বিনিময়ে যার মধ্যে মাদকই প্রধান।
ভারতে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া সব প্রদেশে গরু জবাই নিষিদ্ধ। রাজস্থান বা হরিয়ানায় যে গরুর দাম ১০০০ রুপি পশ্চিম বঙ্গে আসলে তা দাড়ায় ৫০০০ রুপি আর সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকলেই তার দাম হয়ে যায় ২০০০০ টাকা; ঢাকা বা অন্য জেলায় গেলে দাম দাড়ায় আরো বেশী। ব্যবসাটা প্রায় পুরোটাই মধ্যসত্বভোগীদেরহাতে যাদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, সীমান্ত রক্ষী ও প্রশাসনের লোকজনেরই ভাগ বেশী। এরপর আছে মোটা তাজাকরনের নামে বিষাক্ত রাসয়নিক খাবার ও ইনজেকশন দেয়া। এই গোটা যজ্ঞটাই ঘটে কোরবানি কেন্দ্র করে।

বাংলাদেশের কোরবানী রীতি হচ্ছে একদম “ফ্রি-স্টাইল”। একটি রক্তাক্ত ছুড়ি হাতে একজন হুজুরের নেতৃত্বে কয়েকজন রক্তমাখা উম্মত্ত মানুষ ছুটে বেড়ায় এবাসা থেকে ও বাসা, এ পাড়া থেকে ও পাড়া। পশুর সামনে দাড়িয়ে মৃত বা জীবিত যার নামে কোরবানি দেয়া হয় সেই নামগুলো পড়া হয় আগে যদিও শুধু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করার কথা। তারপর যত্রতত্র প্রকাশ্যে শিশু কিশোরদের সামনেই ছুড়ি চালিয়ে দেয়। ফিনকি দিয়ে যখন রক্ত বেড়ায় তখন দৃশ্যটি ইসলামিক হতে পারে কিন্তু আমার কাছে এই মাঝ বয়সেও এটি ভয়াবহ, লোমহর্ষক লাগে। হুজুররা জবাইয়ের পর সম্মানী শুধু পকেটেই ভরে না চামড়ার বানিজ্যেও অংশ নিতে চায়। কোরবানি দাতা চামড়ার টাকার প্রায় শতভাগই দান করা হয় বিভিন্ন কিসিমের মাদ্রাসায়। মাদ্রাসার কোমলমতি শিশুদের চাঁদার রশীদ ধরিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় বাড়ি বাড়ি। উত্তেলিত সেই টাকা কোথায় ব্যয় হয় সে খবরও আমরা রাখি না। ধর্মের মধ্যে অধর্মের অনুপ্রবেশ সবদেশেই কম বেশী হয়েছে। ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয় বলে আমরা যৌক্তিক চিন্তা করতে ভয় পাই। উৎসর্গের উৎসবকে কেন্দ্র করে যে ফুটানী ও অপচয় হয় তাকে ধর্মীয় কোন বিধি বিধান দিয়ে জাস্টিফাই করা উচিত নয়। কোরবানির সামাজিকতা রক্ষায় ট্রিপিক্যাল মধ্যবিত্তের জান কোরবান করা প্রচেষ্টা এই নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দেশে বড়ই বেমানান।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১:৫৪
১২টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

---অভিনন্দন চট্টগ্রামের বাবর আলী পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয়ী---

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫৫





পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন বাবর আলী। আজ বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টায় এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন তিনি।

রোববার বেসক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×