somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন আলোকিত মানুষের গল্প

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




গ্রামটি এখন আর নেই। কীর্তিনাশা পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ‘গ্রাম’ শব্দটি শুনলেই আমাদের কল্পনার ক্যানভাসে সবুজে ঘেরা-ছায়াসুশীতল যে দৃশ্যপট ফুটে ওঠে গ্রামটি একেবারেই সেরকম নয়। গাছপালাবিহীন একটি গ্রাম। শুধু এই গ্রামটিই নয়, পদ্মা নদীর গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা বিশ-তিরিশ মাইলের মধ্যেকার গ্রামগুলি মরুভূমির মতই রুক্ষ এবং শুষ্ক লাগে।



সেই গ্রামের বালুময় পথ ধরে ছোট্ট একটি ছেলে বস্তা ঘাড়ে নিয়ে তার বাবার পেছনে ছুটছে। ছেলেটির বাবা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষের চুল কাটেন এবং তার বিনিময়ে ধান-চাল-আটা সংগ্রহ করেন। ছোট্ট ছেলেটি বস্তা কাঁধে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো কিন্তু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কোন ছায়ার আশ্রয় পেলনা। প্রখর রোদে গ্রাম থেকে গ্রামে চলতে চলতে ছেলেটি ভাবে, এখানে যদি একটা গাছ থাকতো! ছেলেটি ভাবে, গ্রামে গ্রামে গাছ থাকলে কতই না সুন্দর লাগতো এ পথ! এভাবেই চলতে থাকে। থামেনা ছেলেটির ভাবনা, শেষ হয় না ছেলেটির পথচলা…………

গ্রামটির নাম রাধাকান্তপুর। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের একটি গ্রাম। আর ছোট্ট ঐ ছেলেটির নাম………… থাক! ছেলেটির নাম একটু পরেই বলি। বাংলা ’৪৫ সনের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বছরখানেক পরে গ্রামে চুল-দাঁড়ি কেটে আর ধান-চাল পাওয়া যেত না। অভাবের তাড়নায় ছেলেটির বাড়ির উনুনেও কয়েকদিন হাঁড়ি চড়েনি। তার উপর দেশভাগ হয়ে যাওয়ার কারণে ছেলেটির আত্মীয়স্বজন গ্রাম থেকে ভারত পাড়ি দেয়। কিন্তু ছেলেটির বাবা সিদ্ধান্ত নেন যে তারা এদেশেই থাকবেন। তারা একা হয়ে পড়ে। তখন তারা শ্যামপুর গ্রামে চলে আসে। এটা দেশভাগের দু’-তিন বছর পরের কথা। ছেলেটির বয়স তখন মাত্র নয় বছর।




নতুন জায়গায় এসেও ছেলেটির মন টেকেনা। কারণ এখানেও তেমন গাছপালা নেই। কোথাও ক্লান্তি দূর করার জন্য সামান্য ছায়া পাওয়া যায়না। ছেলেটির বুকের ভেতরের চাপা কষ্ট আরও বাড়তে থাকে।

১২-১৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাজারে যেতে হয়। প্রখর রৌদ্রে রাস্তার তপ্ত ধুলায় পায়ে ফোস্কা পড়ে যায়। ছেলেটি কেঁদে ফেলে। বাবাকে বলে, “কোন দেশে নিয়ে এলে ? চলো, অন্য জায়গায় চলে যায়।” বাবা ছেলের মুখ মুছে দিয়ে বলেন, “দুঃখ করিস না বাবা, দেখবি কেউ একজন ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে। গাছ লাগাবে, ওর দেখাদেখি তখন আরও কেউ গাছ লাগাবে। দেশ গাছে গাছে ভরে যাবে। গাছ লাগানো অনেক পুন্যের কাজ। কি হবে গয়া-কাশি গিয়ে ? তার থেকে বেশি পুণ্য হবে গাছ লাগালে।” কথাগুলো ছেলেটির খুব ভালো লাগে। সে সিদ্ধান্ত নেই, সেই দাঁড়াবে গাছ লাগানোর জন্য। মা’র সাথে কাকার বাড়ি বেড়াতে যেয়ে পাকুড় গাছের চারা পায় সে। চারাটি নিয়ে এসে শ্যামপুর গ্রামের তিন রাস্তার মোড়ে লাগায়। এটিই তার জীবনের প্রথম গাছ লাগানো। গাছটি বড় হতে থাকে। বৈশাখ মাসের শেষ দিকে একদিন প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। ছেলেটি ঝড়ের মধ্যে ভগবানকে ডাকতে ডাকতে গাছের কাছে যেয়ে গাছটি বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে। অন্তরের সমস্ত ভালবাসা দিয়ে গাছটি আগলে রাখে। ৬০ বছর পার হয়ে গেছে। গাছটি এখন হাজারো মানুষকে ছায়া দিচ্ছে। ছেলেটিও জীবনের অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু সে এখনও মাঝে মাঝে গাছটি দেখতে যায়। আরও অনেক গাছ লাগিয়েছে সে।

সে বাবার মতই হাটে-বাজারে নাপিতের কাজ করে। শ্যামপুর ছেড়ে তারাপুর গ্রামে চলে আসে। বছর বছর গাছ লাগাতে লাগাতে ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গাছে গাছে ভরে গিয়েছে। গ্রামের রাস্তাঘাট, হাটবাজার, ঈদগাহ-গোরস্থান সব জায়গায় গাছ লাগিয়েছে সে। পরের চুলদাড়ি কেটে পাওয়া সামান্য মজুরি থেকে কিছু টাকা রেখে গাছ লাগিয়েছে। তার পরিবার হয়তো কোন সময় উপোষ থেকেছে, তাকে গাছ লাগাতে বারণ করেছে, গ্রামের লোকজন তাকে পাগল বলেছে। কিন্তু কোন কিছুই তার অদম্য ইচ্ছাকে আটকাতে পারেনি। সে গাছ লাগানোকে সন্তান জন্ম দেওয়া ও পালনের মত কর্তব্য মনে করে। সে তার গাছের যত্ন নেয়, তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে। গাছ নিয়ে অনেক স্বপ্ন তার। বার্ধক্য, দরিদ্রতা, গ্রামের মানুষের তাচ্ছিল্য- কোন কিছুই এই স্বপ্নবাজ মানুষটিকে আটকাতে পারেনি।




এতক্ষণে অবশ্যই বুঝে গেছেন মানুষটির পরিচয়। অদম্য, স্বপ্নবাজ এই মানুষটিই কার্তিক পরামানিক। একজন সাদা মনের মানুষ। একজন আলোকিত মানুষ।



গাছ লাগানো শুরুর ৫৩ বছর পর তিনি পরিচিতি পান। ২০০৩ সালের ২ নভেম্বর “বিরাট বিরাট বৃক্ষ যেন একেকটি কার্তিকনামা” নামে দৈনিক প্রথম আলোতে তাকে নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়। গাছ লাগানোর জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৭ সালে পেয়েছেন চ্যানেল আই কৃষি পদক। সম্মানের আশায় তিনি কখনো গাছ লাগাননি। তিনি নিজের ভালোলাগার, ভালবাসার তাড়নায় গাছ লাগিয়েছেন। সম্প্রতি ৮ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে তাকে নিয়ে একটি অধ্যায় সংযুক্ত হয়েছে। তার জন্য আমরা গর্বিত। ‘কার্তিক পরামানিক’ নামটি আমাদের জন্য এক অপরিমেয় প্রেরণার উৎস।






৫৬ হাজার বর্গমাইল।

আমাদের প্রিয় এই ৫৬ হাজার বর্গমাইল।

আমাদের প্রিয় এই ভূখণ্ডে রয়েছে হাজারো সমস্যা। কিন্তু সব কথা কি এখানেই শেষ।

না।

এই ৫৬ হাজার বর্গমাইল তার কথাগুলোর শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকতে অভ্যস্ত নয়। এই ভূখণ্ড বিস্ময়সূচক চিহ্ন এঁকে এসেছে, ভবিষ্যতেও এর অন্যথা হবে না।

৩০ লক্ষ মানুষের রক্তের স্রোতে যে ভূখণ্ড ভেসে যায়নি, বার বার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারিয়েও যে ভূখণ্ডের পথচলা থেমে থাকেনি, দালাল-কুচক্রীদের শত অপচেষ্টা উপেক্ষা করে যে ভূখণ্ড এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে – তাকে এত সহজে পরাজিত করা যাবে না।

যদি হাজার হাজার সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে লক্ষ-কোটি কার্তিক পরামানিকেরা নীরবে-নিভৃতে প্রতিনিয়ত সে সকল সমস্যার সমাধান করে চলেছেন। আমরা মাথা নোয়াতে শিখিনি। আসুক বাঁধা, আসুক প্রতিবন্ধকতা। আমাদের আলোকিত পথচলা থামবে না। আমাদের আলোকিত মানুষগুলোর গল্প এত সহজে ফুরোবে না…………..







তথ্যসূত্রঃ
১. Click This Link Poramanik.html
২. Click This Link
৩. Click This Link
৪. Click This Link

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪৯
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×