সাহিত্যে এ বছর নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন ছোটগল্পকার এলিস মুনরো, প্রাঞ্জল গদ্যে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা ফুটিয়ে তোলায় মুনশিয়ানার জন্য যাকে বলা হয় ‘কানাডার চেকভ’।
Published : 10 Oct 2013, 05:22 PM
সুইডিশ অ্যাকাডেমি বৃহস্পতিবার সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ১১০তম লেখক হিসাবে মুনরোর নাম ঘোষণা করে। অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি পিটার ইংলান্দ তাকে অভিহিত করেন সমসাময়িক ছোটগল্পের ‘দিকপাল’ হিসাবে।
নোবেল পুরস্কারের ১১৩ বছরের ইতিহাসে এলিস মুনরো হলেন ত্রয়োদশ নারী, যিনি সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে এ পুরস্কার পাচ্ছেন।
তার লেখনিতে বালিকা থেকে নারী হয়ে ওঠার পথে মেয়েজীবনের গল্পগুলো যেমন এসেছে, তেমনি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজে ‘গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার’ সংগ্রামে মানবিক টানাপড়েন ও নৈতিক দ্বন্দ্বের বিষয়গুলোও।
তার গল্প বলার অনবদ্য কৌশল পাঠককে টেনে নিয়ে যায় কাহিনীর গভীরে। এসব গল্পে প্রায়ই এসেছে অখ্যাত ছোটখাট বিভিন্ন শহরের জীবন, যেখানে প্রতিদিনের টুকরো ছবিগুলোই এক সময় চরিত্রকে দাঁড় করিয়ে দেয় জীবন বদলে দেয়া কোনো এক মুহূর্তের সামনে। আর সেই মুহূর্তে পুরো গল্প বিদ্যুৎচমকের মতো আলোকিত হয়ে ওঠে মানব অস্তিত্বের কোনো এক গুঢ় প্রশ্নে।
পরিবারের দেয়া নাম এলিস অ্যান লেইডল; জন্ম ১৯৩১ সালের ১০ জুলাই, অন্টারিওর ইউংহ্যামে । মা অ্যানি ক্লার্ক লেইডল ছিলেন স্কুলশিক্ষক, বাবা রবার্ট এরিক লেইডল পোল্ট্রি ও ফারের জন্য চালাতেন খামার।
স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে সাংবাদিকতা ও ইংরেজি সাহিত্য পড়তে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিওতে ভর্তি হন এলিস। কিন্তু ১৯৫১ সালে বিয়ের পর পড়ালেখার পাট চুকে যায়। জেমস ও এলিস মুনরো দম্পতি ঘর বাঁধেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ভিক্টোরিয়ায়। সেখানে একটি বইয়ের দোকান খোলেন তারা। সেই ‘মুনরোস বুকস’ আজও বইয়ের পোকাদের রসদ যুগিয়ে যাচ্ছে।
কৈশরে লেখালেখির শুরু হলেও মুনরোর প্রথম গল্প ‘ছায়ার যতো মাত্রা’ (দি ডাইমেনশনস অফ আ শ্যাডো) প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, পড়ার খরচ জোটাতে অবসরে কাজ করেন রেস্তোরাঁ বা তামাক ক্ষেতে, কখনোবা লাইব্রেরিতে।
১৯৬৮ সালে প্রথম গল্প সঙ্কলন সুখি রঙের নৃত্য (ড্যান্স অফ হ্যাপি শেডস) প্রকাশিত হওয়ার পরপরই কানাডীয় সাহিত্য সমালোচকদের মনোযোগ কাড়েন মুনরো। কানাডার সবচেয়ে সম্মানজনক সাহিত্য পুরস্কার ‘গভর্নর জেনারেলস অ্যাওয়ার্ড’ জিতে নেয় বইটি। বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীতেও তার গল্প নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে।
১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় মুনরোর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘বালিকা ও নারী জীবন’ (লাইভস অফ গার্লস অ্যান্ড উইমেন), যাকে সমালোচকরা চিহ্নিত করেন ‘বিল্ডুংস্রোমান’ ধরনের কাজ হিসাবে, যেখানে পরস্পর সম্পর্কিত অনেকগুলো ছোটগল্পে ব্যক্তির মনোজীবনের পরিবর্তনগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়।
১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় একই ধারার আরেকটি সঙ্কলন- ‘হু ডু ইউ থিংক ইউ আর?’ ১৯৮২ সালে বাজারে আসে ‘দি মুনস অফ জুপিটার’।
২০০১ সালে প্রকাশিত মুনরোর ‘হেইটশিপ, ফ্রেন্ডশিপ, কোর্টশিপ, লাভশিপ, ম্যারেজ’ অবলম্বনে পরিচালক সারা পলি ২০০৬ সালে নির্মাণ করেন ‘চলচ্চিত্র অ্যওয়ে ফ্রম হার’। অস্কার পুরস্কারেও ছবিটি মনোনয়ন পায়।
১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া, চীন আর স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোয় ঘুরে বেড়িয়েছেন মুনরো। ১৯৮০ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ও কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন ‘রাইটার-ইন-রেসিডেন্স’ হিসাবে।
মুনরোর গল্পে বার বার ছায়া ফেলে গেছেন আন্তন চেকভ। কালজয়ী এই রুশ গল্পকারের মতোই সময়কে নিয়ে মুনরোর ‘অবসেশন’ আর কালের প্রবাহকে ‘ক্ষণিকের জন্য হলেও থমকে দেয়ার ইচ্ছা’ উঁকি দিয়েছে গল্পের বাঁকে বাঁকে।
১৯৮০ ও নব্বইয়ের দশকে প্রতি চার বছরে মুনরোর অন্তত একটি গল্প সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। ২০০৪ সালে তার হাত দিয়ে আসে ‘রানঅ্যাওয়ে’, ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘দি ভিউ ফ্রম ক্যাসেল রক’।
ওই বছরই এক সাক্ষাৎকারে মুনরো বলেন, আর কোনো সঙ্কলন তিনি প্রকাশ করবেন না। তবে তার কলম সেই পথে হাঁটেনি। ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘টু মাচ হ্যাপিনেস’।
টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে এসে ওই বছর মুনরো জানান, তাকে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। হৃৎপিণ্ডের অবস্থাও ভাল নয়, বাইপাস সার্জারি লাগতে পারে।
সে সময়ই মুনরো জানান, যৌন জীবনে মানব মনের দোটানাগুলো উঠে আসবে তার পরবর্তী লেখায়।
মুনরোর সর্বশেষ গল্প সঙ্কলন ‘ডিয়ার লাইফ’ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। দক্ষিণ-পশ্চিম অন্টারিওতে শৈশবের শহরের খুব কাছে ক্লিনটনে কাটছে তার বার্ধক্যের দিনগুলো।
৮২ বছর বয়সী এই লেখিকা নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য বাবদ পাবেন ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার। আগামী ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমে আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হবে।
গত বছর চীনের মো ইয়েন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।