somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঠগী: এক খুনী জাতি (২)

১১ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মহিষাসুরের অত্যাচারে দেবালয় কাপছে। কোন দেবতাই মহিষাসুরের সামনে টিকতে পারছে না। কারন, মহিষাসুর বর পেয়েছিলেন কোন পুরুষই (মানব বা দেবতা ) তাকে হারাতে পারবে না। তখন সব দেবতার শক্তি নিয়ে জন্ম হল দেবী দূর্গার ( দেবী দূর্গার আরেক নাম ভবানী ) । শুরু হল দেবী দূর্গার সাথে মহিষাসুরের যুদ্ধ। প্রথমে মহিষাসুর মহিষের রূপ ধারন করে দেবী দূর্গার সাথে যুদ্ধ করে, যেখানে মহিষাসুরের প্রতিটি রক্তের ফোটায় আর একটি নতুন মহিষাসুরের জন্ম হয়। এভাবে যুদ্ধ করতে করতে দেবী দূর্গা ক্লান্ত হয়ে পড়লে, তার ঘাম থেকে জন্ম হয় দুই জন মানুষের, যাদেরকে দেবী দূর্গা একটি হলুদ রুমাল দেন। এরপর এই দুই জন মানুষই একে একে সব মহিষই মেরে ফেলে কোন রক্তপাত ছাড়াই। আর এই দুই জন মানুষই হল ঠগীদের পূর্বপুরুষ যারা কিনা দেবী দূর্গার ঘাম থেকে জন্ম নিয়েছে, আর তাদের কাজই হল দেবী ভবানীর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা। আব এভাবেই জন্য হয় ঠগীদের। এটাই হল ঠগীদের মধ্যে প্রচলিত কিংবদন্তী। যারা নিজেদেরকে ভবানীর সন্তান বলে মনে করত। এরা এমন এক জাতি যাদের পেশাই ছিল মানুষ খুন করে তার সব কিছু লুট করা। ঠগীরা তেরো শতক থেকে উনিশ শতক বাংলাসহ উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এরা মানুষ খুন করত কোনরূপ রক্তপাত ছাড়াই। এদের হাতিয়ার ছিল এক ফালি হলদে কাপড়ের টুকরো। তাতে একটা রুপোর টাকা বা তামার ডবল পয়সা বাধা। আর এই কাপড়ের টুকরো দিয়ে শ্বাসরোধ করে তারা মানুষ হত্যা করত। এরা সব সময় দলগত ভাবে তাদের শিকার ধরত। একেক দলে ৩০-৪০ জন সদস্য থাকত, কখনো বা তার চেয়েও বেশী। তিন চারটি দলে ভাগ হয়ে এরা শিকার ধরতে ঝাঁপিয়ে পড়ত। প্রত্যেক দলের আলাদা নাম ও কাজ ছিল। ঠগীদের দলে সবার আগে চলত ‘সোথা’রা। সম্ভাব্য শিকার চিহ্নিত করে প্রাথমিক পর্যায়ে ভাব জমানো ছিল তাদের কাজ। ইতিমধ্যে দলের খানিকটা পিছনে চলতে শুরু করবে ‘তিলহাই’রা। গুপ্তচর ও পুলিশের গতিবিধি নজরে রাখত তারা। ‘নিসার’ বা নিরাপদ জায়গা দেখে তাবু গাড়া হত। খাবার পর বাসন মাজার অতি স্বাভাবিক নির্দেশ। কিন্তু, ‘বিয়াল’ বা কবর তৈরি করার দায়িত্ব যার, সে জানত সময় এগিয়ে আসছে। এবার ‘ঝিরনী’ উঠবে অর্থাৎ হত্যার আদেশ আসবে। সে আদেশ হল ‘তামাকু লাও’। এক লহমায় ফাঁস জড়াবে শিকারের গলায়। ‘চামোচি’ ধরে থাকবে শিকারকে। ‘চুমোসিয়া’ তার হাত আটকে রাখবে, যাতে সে বাধা দিতে না পারে। ‘চুমিয়া’ তার পায়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেবে। একজন যাত্রীকে খুন করত তিনজনের একটি দল। একজন মাথা ঠেলে দিত, অন্যজন ফাঁস পরাত, অন্যজন পা চেপে ফেলে দিত। কেউ পালিয়ে গেলেও রক্ষা নেই, কাছেপিঠেই ওৎ পেতে থাকত ঠগীদের অন্য কোন দল । তারপর ‘ভোজারা’ দেহগুলোকে নিয়ে যাবে কবরে। ‘কুথাওয়া’র দায়িত্ব হল দেহগুলোর হাঁটু ভেঙে থুতনির সঙ্গে লাগিয়ে ভাঁজ করে কবরে দেওয়া। মৃতদেহ যাতে ফুলে উঠে কবর থেকে বেরিয়ে না পড়ে। সাদা কাপড়ের ফালি নিয়ে পাহারায় থাকবে ‘ফুরকদেনা’। বিপদের গন্ধ পেলে জানান দেবে এরাই। এরপর অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় জায়গাটা সাফসুতরো কওে ফেলবে ‘ফুরজানা’। এরপর সবাই মিলে সেখানেই ভুরিভোজ করবে। তারপর সবাই মিলে লুটের টাকা ভাগ করে নেবে। একেক জন হয়ত ২ টাকা বা ৪ টাকা পাবে। কেউ যদি উপস্থিত না থাকে তবে সেও তার ভাগের টাকা পাবে। এদের শিকার থেকে কেউই রেহাই পায়নি সওদাগর থেকে সিপাহী, মোগল রাজকর্মচারী থেকে ইংরেজ সাহেব সবাই। তবে এরা মেয়েদের, ফকির-সন্নাসীদের কোন ক্ষতি করত না। এমন ঘটনা আছে যে, মোঘল রাজদরবারের জন্য নাচনেয়ালী গায়ে ভর্তি অলংকার কিন্তু এরা কোন ক্ষতি করেনি। একবার এক ইংরেজ সাহেব নিখোজ হলে ইংরেজ সরকার প্রথম ঠগীদের সম্পর্কে জানতে পারে, কিন্তু তখন তারা বিষয়টি তেমন আমলে নেয়নি, কিন্তু পরে ইংরেজ সরকার একজন অফিসারকে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেয়। অফিসারে নাম ছিল, মেজর উইলিয়াম শ্লীম্যান। ( আমার জানামতে ইংরেজ শাসনামলে একমাত্র ভাল মানুষ ) এই শ্লীম্যান সাহেব ফোর্ট্ উইলিয়ামের একজন তরুন অফিসার ছিলেন। কোম্পানির আর্মি অফিসারদের মধ্যে যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে কোম্পানির অভিযোগ ছিল তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। উইলিয়াম শ্লীম্যানই সর্বপ্রথম ঠগীদের কার্যপ্রনালী সম্বন্ধে আঁচ করতে পারেন। তিনি জানতেন ঠগীদের দমন করা সহজ না। কেননা, অন্যান্য দুস্কৃতিকারীদেও থেকে ঠগীদের আলাদা করা যাচ্ছিল না। তাছাড়া সুকৌশলে অপরাধ ঢেকে রাখছিল তারা। উইলিয়াম শ্লীম্যান গুপ্তচর নিয়োগ করেন, গঠন করেন পুলিশ ফোর্স। এরই পাশাপাশি শ্লীম্যান ঠগীদের অপরাধস্থল সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষন করে মানচিত্র তৈরি করেন এবং অপরাধের দিনক্ষণের একটি তালিকা তৈরি করেন; যার ফলে তিনি পরবর্তী গনহত্যার সময়কাল আঁচ করতে সক্ষম হন। নিজের লোকদের ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে অস্ত্রসহ পাঠান। কিন্তু তাতেও বিশেষ লাভ হচ্ছিল না। কারন তাদের বিরুদ্ধে কোন কিছুই প্রমান করা যাচ্ছিল না। তখনই একজন ঠগী ধরা পড়ে এব্ং সে নিজেকে ঠগী হিসেবে দাবি করে। তখন তাকে রাজসাক্ষী করে ঠগীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ঠগীদের সম্পর্কে প্রচুর বিশেষ ট্রাইবুনাল ও দ্রুত বিচার আদালত গঠন করেন। কিন্তু তাতেও কোন বিশেষ লাভ হয় না। কারন তখন সবে মাত্র সিপাহী বিদ্রোহ শেষ হয়। কোম্পানির শাসন শেষ আর ইংরেজ শাসন শুরু হয়। সিপাহী বিদ্রোহ ইংরেজদের ভীত করে তোলে, তারা ভারতীয়দের ধর্ম নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করার সাহস পা্চ্ছিল না। যেহেতু ঠগী একটি গুপ্ত ধর্মীয় সংগঠন তাই ইংরেজ সরকার তাদের নাম মাত্র শাস্তি দিচ্ছিল। একবার এক বিচারক এক ঠগীকে ফাসির আদেশ দিলে, ঠগী তখন জয় মা, ভবানী বলে চিৎকার করলে বিচারক ভয়ে তাকে খালাস করে দেয়। তখন শ্লীম্যান সাহেব তার উচ্চ পদস্থ অফিসারদের রাজী করিয়ে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করেন। মূলত তারই চেষ্টায় এই খুনী জাতিদের সমূলে নির্মূল করা সম্ভব হয়। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতবর্ষে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। যাত্রীরা পায়ে হাঁটার বদলে রেলে ভ্রমন করতে শুরু করে। ঠগীদের দৌরাত্ব ধীরে থীরে কমে আসছিল। এরপর অনেক বছর কেটে যায় মেজর শ্লীম্যান থেকে মেজর জেনারেল (অর্ঃ) উইলিয়াম শ্লীম্যান, বাংলাতে থাকেন। একদিন সকালে চারদিকের চিৎকার শ্লীম্যান সাহেবের ঘুম ভাংল। চোখ মেলে তাকাতেই তিনি দেখলেন এক শক্তিশালী শারীরিক গঠনের ঘুবক তার সামনে দাড়িয়ে। শ্লীম্যান সাহেব বুঝলেন, তাকে খুন করার জন্যই এই লোকটি এখানে এসেছে, আর তাই খোজে সবাই চিৎকার করছে। শ্লীম্যান সাহেব এতটুকু ভয় না পেয়ে তাকে বললেন, যাও চলে যাও, আর কোনদিন আমার সামনে আসবে না। লোকটি চলে গেল। এরপর তার স্ত্রী তাকে প্রশ্ন করেন কে এসেছিল? তখন শ্লীম্যান সাহেব বললেন ঃ The last Thugs of India"

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:২৯
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×