যে যুগে মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষা লাভ করা ছিল বিরল ঘটনা, সেই যুগে তিনি নারীবাদে বিশ্বাসী ছিলেন আর এমন বিশ্বাসী হয়ে ওঠার পেছনে নানা কারণও ছিল। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন এক প্রগতিশীল শিক্ষিত পরিবারে। চন্ডীচরণ সেন একজন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী, বিচারক ও ঐতিহাসিক লেখক ছিলেন। ১৮৭০ খ্রীস্টাব্দে চণ্ডীচরণ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। পরের বছর তাঁর স্ত্রী-কন্যাও কলকাতায় তাঁর কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের বিশিষ্ট নেতা ছিলেন। যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান এই মহীয়সী নারীর নাম কামিনী রায়। তিনি ১৮৬৪ সালের ১২ অক্টোবর বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জের বাসণ্ডা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ভগিনী যামিনী সেন লেডি ডাক্তার হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন।১৮৯৪ খ্রীস্টাব্দে কামিনীর সাথে স্টাটুটারি সিভিলিয়ান কেদারনাথ রায়ের বিয়ে হয়।
এদেরও তো গড়েছেন নিজে ভগবান্ ,
নবরূপে দিয়েছেন চেতনা ও প্রাণ ;
সুখে দুঃখে হাঁসে কাঁদে স্নেহে প্রেমে গৃহ বাঁধে
বিধে শল্যসম হৃদে ঘৃণা অপমান,
জীবন্ত মানুষ এরা মায়ের সন্তান।।
ওরা ভেবেছিল মনে আপনার নাম
মনোহর হর্ম্মরূপে বিশাল অক্ষরে
ইষ্টক প্রস্তরে রচি চিরদিন তরে
রেখে যাবে ! মূঢ় ওরা, ব্যর্থ মনস্কাম।
ছোটবেলা থেকেই কামিনী রায় ছিলেন অসাধারণ মেধাশক্তির অধিকারিণী, ভাবুক এবং কল্পনাপ্রবণ। তিনি ১৮৮০ সালে কলকাতার বেথুন ফিমেল স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৮৩ সালে বেথুন কলেজ থেকে এফ.এ এবং একই কলেজ থেকে ১৮৮৬ সালে ভারতের প্রথম নারী হিসেবে সংস্কৃত ভাষায় অনার্সসহ বি.এ পাস করেন। বলা যায়, তিনিই সংস্কৃত ভাষায় ব্রিটিশ ভারতের প্রথম স্নাতক ডিগ্রি লাভকারিণী। কামিনী রায় উচ্চতর ডিগ্রি লাভের পর কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতা দিয়ে। বেথুন কলেজেই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। অসম্ভব কল্পনাশক্তির অধিকারিণী হওয়ায় কামিনী রায় মাত্র আট বছর বয়স থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেন। কিন্তু এই মহীয়সী নারী কেবল কাব্য রচনা ও অধ্যাপনা নিয়েই সারাজীবন নিজেকে ব্যস্ত রাখেননি। সাংস্কৃতিক ও জনহিতকর কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে নারীকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯২২-২৩ সালে নারী শ্রম নিয়ে কমিশন গঠিত হলে তিনি সেই কমিশনের সদস্য হন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেরও তিনি সহসভাপতি ছিলেন।
জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,-
“মা, তোমারে কত ভালোবাসি!”
“কত ভালবাস ধন?” জননী শুধায়।
“এ-ত।” বলি দুই হাত প্রসারি’ দেখায়।
শৈশবে তাঁর পিতামহ তাঁকে কবিতা ও স্তোত্র আবৃত্তি করতে শেখাতেন। এভাবেই খুব কম বয়স থেকেই কামিনী রায় সাহিত্য রচনা করেন ও কবিত্ব-শক্তির স্ফূরণ ঘটান। তাঁর জননীও তাঁকে গোপনে বর্ণমালা শিক্ষা দিতেন। কারণ তখনকার যুগে হিন্দু পুরমহিলাগণের লেখাপড়া শিক্ষা করাকে একান্তই নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মাত্র ৮ বছর বয়স থেকে তিনি কবিতা লিখতেন। রচিত কবিতাগুলোতে জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনার সহজ-সরল ও সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে। পনের বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ আলো ও ছায়া প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ খ্রীস্টাব্দে। এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু প্রথমে এতে গ্রন্থকর্ত্রী হিসেবে কামিনী রায়ের নাম প্রকাশিত হয় নাই। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে -
আলো ও ছায়া (১৮৮৯)
নির্মাল্য (১৮৯১)
পৌরাণিকী (১৮৯৭)
মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩)
অশোক সঙ্গীত (সনেট সংগ্রহ, ১৯১৪)
অম্বা (নাট্যকাব্য, ১৯১৫)
দীপ ও ধূপ (১৯২৯)
জীবন পথে (১৯৩০)
একলব্য
দ্রোণ-ধৃষ্টদ্যুম্ন
শ্রাদ্ধিকী
কাঁদে প্রাণ যবে, আঁখি সযতনে শুষ্ক রাখি
নির্মল নয়নের জলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত 'মহাশ্বেতা' ও 'পুণ্ডরীক' তাঁর দু'টি প্রসিদ্ধ দীর্ঘ কবিতা। এছাড়াও, ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য গুঞ্জন নামের কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ বালিকা শিক্ষার আদর্শ রচনা করেন।
কামিনী রায় সবসময় অন্য সাহিত্যিকদের উৎসাহ দিতেন। ১৯২৩ খ্রীস্টাব্দে তিনি বরিশাল সফরের সময় কবি সুফিয়া কামালকে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করতে বলেন।
তাঁর কবিতা পড়ে বিমোহিত হন সিবিলিয়ান কেদারনাথ রায় এবং তাঁকে বিয়ে করেন। ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে কামিনী রায়ের স্বামীর অপঘাতে মৃত্যু ঘটেছিল। সেই শোক ও দুঃখ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে, যা তাঁর কবিতায় প্রকাশ পায়। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সংস্কৃত সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
সম্মাননাঃ
০১. ১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কামিনী রায়কে 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' প্রদান করে সম্মানিত করেন।
০২. তিনি ১৯৩০ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গীয় লিটারারি কনফারেন্সের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।
০৩. ১৯৩২-৩৩ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেরও সহ-সভাপতি ছিলেন কামিনী রায়।
মহাপ্রয়াণঃ
জীবনের শেষ ভাগে তিনি হাজারীবাগে বাস করেছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৩ খ্রীস্টাব্দে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
এক নজরে কামিনী রায়ঃ
জীবিকাঃ কবি, সমাজকর্মী, নারীবাদী লেখিকা।
সময়কালঃ বঙ্গীয় নবজাগরণ।
উল্লেখযোগ্য লেখনীঃ আলো ও ছায়া (১৮৮৯), মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩)
উল্লেখযোগ্য পুরস্কারঃ জগত্তারিণী স্বর্ণপদক।
(১৯২৯)
প্রভাবান্বিত হয়েছেনঃ হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রভাব বিস্তার করেছেনঃ সুফিয়া কামাল।
কামিনী রায়ের লেখা দুর্লভ একটি চিঠিঃ
তথ্য সূত্রঃ ইন্টারনেট