somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুরতাদ মাওলানা!

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রূপপুর গ্রামের জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা বশির খাঁ চুপচাপ দাঁড়িতে হাত বোলাচ্ছেন। তাঁর উঠোন জুড়ে অজস্র মানুষের একটা জটলা গোল হয়ে ঘিরে আছে তাঁকে। তিনি যে চেয়ারটিতে বসেছেন সেটিতে কোন আরাম নেই, এক ধরণের অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। এই মুহূর্তে কাউকে চেয়ার পাল্টাতে বলাটাও ঠিক হবে না। গুরুত্বপূর্ণ একটা সালিশ বসেছে, বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি নিজেই। সালিশের বিষয়বস্তু জমি-জমা সংক্রান্ত। গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন দুই পরিবারের মধ্যে জমি-জমার মালিকানা বিষয়ক বড় ধরনের গোলযোগ হয়েছে, সেটাই মিটমাট হবে আজ। দুই পরিবারের কর্তা ব্যক্তি যথাক্রমে- সোবহান আলী এবং কাদের ব্যাপারি। সোবহান আলী নাকি ইতোমধ্যে কাদের ব্যাপারির বাড়িতে হামলাও করেছে। ব্যাপারখানা বেশ জটিল হয়ে গেছে, কোর্ট-কাছারির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে পারলেই ভালো হত। কিন্তু গ্রামের অল্পশিক্ষিত মানুষ, সালিশেই তাদের সন্তুষ্টি।

তাঁর চারপাশে আরো দু’চারজন হুজুর বসে আছেন। সামনের দিকে দু’পাশের দু’টো চেয়ারে বসেছেন সোবহান আলী এবং কাদের ব্যাপারি। সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। সালিশ শুরু করতে হবে। মানুষ অপেক্ষা করছে।
বশির খাঁ কাশি দিয়ে কথা শুরু করলেন- “সোবহান আলী, আপনার বক্তব্য পেশ করেন।“

সোবহান আলী শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়লেন। তারপর বক্তব্য শুরু করলেন।–
“জনাব, আমার প্রতিবেশী কাদের ব্যাপারি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে না। সারাদিন সে বিবিধ প্রকারের বিদ’আত কাজ-কারবারে লিপ্ত থাকে। লোকমুখে শুনি, সে নাকি আল্লাহ-খোদা মানে না। ছিঃ ছিঃ! এইরকম একজন কাফেরের শাস্তি হওয়া উচিৎ।“

কাদের ব্যাপারি হঠাৎ ক্ষেপে গেলো-
“হই মিয়া! ফালতু কথা বলেন! উপস্থিত আলেমগণ এর বিচার করেন। সোবহান মিয়া নিজেই একজন কাফের। তাঁর দোকানে অশ্লীল, বেগানা নারীর ছবি পাওয়া যায়। তারে আমি কোনদিনই জুম্মাবারে মসজিদে দেখি নাই। দুনিয়ার যত বেদ’আত কাজ কারবার আছে, সেইগুলা সেই বেশি করে। আপনি পারলে এখানে উপস্থিত মানুষগোরে জিগাইতে পারেন।“

মাওলানা বশির খাঁ বেশ বিরক্ত হলেন। তিনি বললেন- “দ্যাখেন ভাই, আমরা এখানে বিচার করতে আসছি জমি-জমা নিয়া। পুকুর পাড়ের জমিখানার আসল মালিক কে, আমরা সেইটা নিয়ে কথা বলব। আর তাছাড়া, গতকাল রাইতে যে মাইর-পিট খানা হয়েছে, সেইটা নিয়া কথা হবে। আপনারা এখানে আল্লাহ-খোদা, নামায-রোজা নিয়া আসছেন ক্যান! সেইগুলা নিয়া পরেও আলোচনা হতে পারে। এখন কাজের কথায় আসেন! বলেন সোবহান আলী, আপনি যে জমির মালিক তার প্রমাণ কি?”
সোবহান আলী জোর গলায় ঘোষণা করলেন- “আমিই পুকুর পাড়ের দুই বিঘা জমির মালিক। কারণ আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ি। রোজা রাখি, তাহাজ্জুদ পড়ি...”
কাদের ব্যাপারি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “নাউজুবিল্লাহ! এত্ত বড় মিছা কথা ক্যামনে কইলেন। খোদা তায়ালা সাক্ষী আছেন। এই জমির মালিক আমি। কারণ, আমি সারাদিন-রাইত নফল ইবাদতে মশগুল থাকি। আপনার মত কাফের-মুরতাদ এই জমির মালিক হইতে পারেন না।“ কাদের ব্যাপারির সমর্থকগণ হই হই করে তাঁকে সমর্থন যোগাতে থাকে।

দুই পক্ষ হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
মাওলানা বশির খাঁ পড়লেন মহা বিপাকে। এইভাবে তো সালিশ চলতে পারে না। তিনি উভয় পক্ষকে শান্ত হবার নির্দেশ দিলেন।

“ভাইসব, আপনারা একটা ব্যাপার বুঝতে পারতেছেন না। এইখানে কে নামায পড়ে, কে পড়ে না, কে কাফের, কে কাফের না... এইসব নিয়া কথা হইতাছে না। কথা হইতাছে জমি নিয়া। আবারও বলি, কথা হইতাছে জমি নিয়া। আপনারা দলিল-দস্তাবেজ নিয়া আইসা প্রমাণ করেন যে, জমির মালিক আপনাদের মধ্যে কে। আর কালকের মাইর-পিট এবং লুটপাটের ঘটনার সাক্ষী কারা কারা আছেন, তাদের নিয়া আসেন। সাক্ষ্য-প্রমাণ দেইখা বিচার করব। হুদাই আল্লাহ-খোদার পিছনে লাগছেন ক্যান।“
এই কথা শুনে জনতা নীরব হয়ে গেলো। কুতকুতে চোখে সবাই মাওলানা বশির খাঁকে দেখছে। বশির খা’র ব্যাপারটা খুব ভালো ঠেকছে না।

সোবহান আলী হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন- “হুজুর, তারমানে আপনি বলতে চাইতেছেন নামাজ-রোজা এইখানে বিষয় না? এত বড় গুনাহের কথা আফনে বলতে পারলেন। আফনে তো মুরতাদ। এই সালিশ মানি না!” বেশ কিছু মানুষ চিৎকার করে তাঁকে সমর্থন যোগাতে থাকে।

তার কথায় সায় দিয়ে কাদের ব্যাপারি উঠে দাঁড়িয়ে দ্বিগুণ জোরে ঘোষণা করলেন- “মাওলানা বশির খাঁ, আল্লাহ পাক আপনার ওপর বেজার হয়েছেন। আফনে খোদার সাথে বেঈমানি করেছেন, রসূলের সাথে বেঈমানি করেছেন! এজন্যই তো বলি, আফনে গতকাল এশার নামাজ পড়ান নাই কেন! আফনে কাফের! আফনে মুরতাদ!”
উপস্থিত জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ল।

সোবহান আলী চিৎকার করে বলতে লাগলেন- “ইনার সালিশ মানি না। ইনার পেছনে আর নামাযও পড়ব না। এই মুরতাদ মাওলানারে দোর্‌রা মাইরা আজকেই গেরাম ছাড়া করন লাগবো।“
জনতা আবারও চরম আক্রোশে হই হই করে উঠলো- “ হ হ, গেরাম ছাড়া করন লাগবো, গেরাম ছাড়া করন লাগবো।“
সবাই ধীরে ধীরে বশির খাঁর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।

মাওলানা বশির খাঁর শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। তিনি মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলেন। হঠাৎ খেয়াল করলেন, কেউ তাঁকে পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দিলো। মাওলানা সাহেব চেয়ার থেকে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। “কাফের মাওলানা! মুরতাদ মাওলানা!” বলতে বলতে মানুষ তাঁর দিকে ছুটে আসতে থাকে। মাওলানা বশির খাঁ গায়ের অগণিত পায়ের চাপ অনুভব করছেন। কেউ একজন প্রচন্ড বেগে তাঁর তলপেটে লাথি ছুড়লো। বশির খাঁ ব্যথায় মুখ বিকৃত করে ফেললেন। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন- “ভাই, আমি কাফের না। আমি কাফের না। আমি আল্লাহ-খোদা মানি। আমারে আল্লাহর ওয়াস্তে ছাইড়া দ্যান।“ কিন্তু কেউ তাঁর সে কথা শুনতে পেলো না।
বশির খাঁর দৃষ্টি অস্পষ্ট হতে শুরু করল। জিভে গলা বেয়ে উঠে আসা রক্তের নোনতা স্বাদ অনুভব করতে থাকেন।

প্রচন্ড ব্যথায়, যন্ত্রনায় মাওলানা বশির খাঁ মূর্চ্ছা গেলেন।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রফেসদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×