somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবার বন্ধু, বাবার একাকীত্ব, আমাদের অসম্পূর্ণতা

১০ ই নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাবা অবসরে নিলেন এই বছরের প্রথম দিকে, মায়ের স্কুল আছে, আর আমরা চার ভাইবোন পড়াশোনার জন্য নিজেদের জায়গায় থাকা। অবসরের প্রথম দিকে সারাটা দিন বাবা একলাই কাটাতেন।

কদিন পর বাবার একজন পুরোন বন্ধুর সাথে আবার ও মেলামেশা শুরু করলেন, তারা দুজনেই একই ব্যাংক থেকে অবসরে গেলেন,নিজেদের মাঝে ভালো বোঝাপড়াও ছিলো।
সকাল হলেই মা আর বাবা একসাথে খেয়ে নিয়ে মা বের হতেন স্কুলের জন্য, ফিরতেন বিকেলে, ৫টা বাজে। মা বের হওয়ার পর আসতেন ওই কাকু। এসে নিজেরাই চা বানিয়ে খেয়ে নিতেন, গল্প, গান শোনা, দুইজনের আড্ডা। আবার চা বানানো, মা পিঠা বানিয়ে রেখে যেতেন, সেটা দুইজন মিলে অলস দুপুরে খেতেন। খাওয়ার সময় কাকু চলে যেতেন, কাকি একা খেতেন না, তাই। তাঁদের কোন ছেলেমেয়ে নেই বলে আমাদের চারজনকে খুব আদর করতেন, আমাকে বলতেন, তুমি একবার আমাকে বাবা বলো, আমার ভালো লাগবে। আমি হাসতাম,কিছু বলতাম না। আজকাল বড়ো আফসোস হয়।
সন্ধ্যার পর বাবা আর কাকু বের হয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি। চটপটি খাওয়া, ফুচকা কিনে হেঁটেহেঁটে খাওয়া। খবরের কাগজ কিনে সেখানকার খবর পড়ে সেগুলো নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা। বাবা কাকুর সাথে ছাড়া বাকি সময়টা খাওয়া, ঘুম আর বই পড়ায় যেতো- সেটা খুব কম অংশ। একেবারে প্রাণের বন্ধু তাঁরা।


পুজা, ঈদের বন্ধে আমরা বাসায় এলে উনাদের বাসায় নিমন্ত্রনে যেতে হতো। এটা ওটা রান্না করা, মা নিজেও খুব পছন্দ করেন রান্না করে মানুষদের খাওয়াতে, আর তাঁরা দুইজন তো পুরোই ভোজনরসিক। বাবার হাইপারটেনশন, মেদ তো পুরো ভুড়ি জুড়েই। কাকুর তা নেই, লম্বা, মেদের ছিঁটেফোটাও নেই। বাবাকে তো বলতেন, তোমার তো পেট টাই তোমার আগে যায়!!

বাবার খুব পছন্দ সাদা রং। প্রায়ই একটা সাদা টিশার্ট পরতে দেখা যেতো, আর খাওয়ার সময় সেটায় বুকের কাছে, পেটের উপর খাবার পড়তো, ঝোলের ফোঁটা পরতো, মায়ের কাজ ছিলো সেটা তুলে আগের মতোন ধবধবে করে দেওয়া।

দুজন মিলে একরকম পান্জাবি বানাতো, তারপর একসাথে পরে ঘুরতে যেতো। মাঝে মাঝে আরেকজন বন্ধু আসতো। তাদের আড্ডা শুনে মনে হতো আমার বয়েসী কতোজন আড্ডা দিচ্ছে। একবার ইন্ডিয়া থেকে আমার মায়ের কাজিন এলো, তাও তাঁদের বন্ধু! তারপর সব বন্ধুদের খুঁজের বের করে তাদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, বাজার করে মায়ের রান্নাঘর দখল করা! নিজেদের রন্ধনশৈলীর প্রমাণ দেওয়া। খুব ভালো কাটিয়েছিলো তাঁরা এই দিনগুলো। মামা চলে যাওয়ার পর আবার তাদের নিত্যদিনের রুটিন।
সবজির বীজ কিনে এনে বাসার পেছনে লাগাতো, কাকুর বাসার ছাদে, আর আমার বাবা এসব ঘাটতে পছন্দ করতেন না। কাকুর চাপে পড়ে মায়ের সাথে এসবে হাত লাগাতে শুরু করলেন। বিচি একটা লাগিয়ে মাকে এসে বলতেন, এটা লাগিয়ে দেখুন।
আরেক বন্ধুর গাছে দুটো করলা ধরলে একটা বড়ো সাইজের করলা বাকি দুইজনকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা তো মোটে দুইজন করে, এতে হয়ে যাবে, আমার গাছের প্রথম করলা।
এক একদিন কাকুর সেদ্ধপুলি খেতে ইচ্ছে করলো, নারকেল কিনে বলে গেলেন সন্ধায় যেন পাই।
সেই কাকু, আমি সময় পাইনা বলে তাঁর বাসায় অনেকদিন যাওয়া হলোনা, হলোনা গত পূজায় দশমীর খাওয়া। সেই তো গেলাম।গতকাল। আন্টি সাদা থান পরা, ফোলা চোখ, সিঁথির সিদুর মুছে ফেলা হয়েছে। কি ভয়ংকর সেই রূপ।
সেদিন কেবল খেতে বসলাম, কেন জানিনা খেতেই পারছিলাম না, গলায় খাবার আটকে যাচ্ছিল. তবুও খেলাম। একটু পর মা ফোন দিলো, তোর আংকেল নেই, চলে আয় বাসায়। কিছুক্ষণ আগেই মারা গেলেন।

আমার এতো কষ্ট হচ্ছিলো, আসতে পারলাম না, পরদিন এলাম, এসেই মুখে চারটে ভাত গুঁজে গেলাম, বাবাকে দেখলাম শুয়ে থাকতে, আমার সাথে তেমন কথা হলোনা, আমার ভালো লাগছিলোনা। কাকুর বাসায় গিয়েও এক সমস্যা। আমার মনে হলো বারান্দাটা কাকুর খুব প্রিয়। বসে চা খেতেন। পাশের জলপাই গাছটা জলপাই ধরে নুয়ে পড়ছে বারান্দার কাছাকাছি।
তাঁর চেয়ারটা খালি।
কোন কথা বের হলোনা। ঘন্টাখানেক চুপচাপ বসে থেকে চলে এলাম। ভালো লাগলোনা।

আমার বাবার আরো একজন প্রিয় বন্ধু চলে গেলেন। এর আগে এক নববর্ষের দিনে বাবার আরো একজন কাছের বন্ধু চলে গিয়েছিলেন। ফিরে আসার সময় মনে হলো, বাবাকে একা করে দিচ্ছি আমরা। কিভাবে দিনের বেলাটুকু থাকবেন,একটা মানুষ নেই বাসায়, বন্ধুরা একে একে চলে যাচ্ছেন, বাবার মন কি দুর্বল হচ্ছে না?

ঘরে ঢুকতেই বাবা বললেন, ফ্রেস হয়ে চা দেতো মা। বললাম, আচ্ছা। চায়ের পানি বসিয়ে একটু পরে আসতেই বাবা ডাকলেন, বললেন, একলা একলা লাগছে। ও আমাকে নিঃসঙ্গ করে দিলো। কিভাবে থাকবো জানিস?

আমি চুপ করে শুনলাম, কিছু বলার মতো খুঁজে পেলাম না। আমিও তো বাবাকে একলাই ফেলে নিজের পথে চলি। আমরা সবাই। কি বলবো? আমরা কি পেরেছি বাবার একাকীত্ব দূর করতে? না চেষ্টা করি? না পারবো?

আমরা কি এরকম বন্ধু পাবো শেষ বয়েসে, যার জন্য আফসোস হবে, আবার ও ফরমাল পোশাক ছেড়ে একরকম পোশাক বানাতে চাইবো? ঘুড়ে বেড়াবো দিশেহারা হয়ে? নদীর পাড়ে বসে বাদাম ভেঙ্গে মুখে দিতে দিতে বলতে কি পারবো, "ইস, একটু লবন হলে ভালো হতো, না রে?"

৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রফেসদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×