সেদিন আকাশের সীমানায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
আবীরমাখা রঙে উজ্জল হয়েছিল চারিদিক ।শুধু মনের গহীনে ছিল এক বিষাদ ভরা অন্ধকার।সেই অন্ধকারের মধ্যে ছিল বুদ বুদ উঠা ক্রমাগত দুঃখের বলক ।
আমি স্থীর আর স্তব্ধ হয়ে ছিলাম ।
আমার চোখ দুটোয় কোন নিয়ন্ত্রন ছিলনা ।ইচ্ছামত ঐ জমজ চোখজোড়া অনর্গল অশ্রু উপচে দিচ্ছিল নিরবে । কিছুক্ষন আগে আমি আমার পিতাকে আলতো করে কবরে শুইয়ে দিয়ে এসেছি ঘুমন্ত শিশুকে যেমন শুইয়ে দেয় বিছানায় । হাতে তখনো আমার কাফন, কর্পুর আর মাটির গন্ধ লেগে আছে ।হাতে লেগে থাকা কবরের মাটি ইচ্ছে করেই ধুয়ে ফেলিনা ।থাকুক লেগে ।যতক্ষন রাখা যায় থাকুক না ।
দূরে কোলাহলের শব্দ পাই ।
আমি জনকোলাহল থেকে নিজেকে সরিয়ে এই আবীরমাখা দিগন্তে দাঁড়িয়ে আল্লাহর আরশের দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি পিতার কবরে মুনকার নকীর কি চলে এল? সওয়াল –জবাব কি শুরু হইয়ে গেল ?
পশ্চিম আকাশকে আজ এত বর্নিল মনে কেন মনে হচ্ছে আমার !আমার পা দুখানা যেন শেকড়ের মত দেবে যাচ্ছে ।
নড়তে পারছিলাম না কিছুতেই ।
এ সময় ফ্লাশব্যাকের মত পিতার আবাল্য স্মৃতির ক্যাসেট পেছনে চলা শুরু করার কথা ।
অথচ আমার নিউরনে কি এক দুঃসপ্নের পোকারা কিলবিল করছে ।আমার আস্তিনে দুঃখের প্রলেপ ।
আমার বুকভেঙ্গে চিৎকার করে কাঁদা উচিত কিন্ত তা করতে পারছি না । আমি নীরবে অশ্রুপাত করে করে স প্নালোকিত স ন্ধ্যায় স্থানুর মত দাঁড়িয়ে কিম্বা বূড়ো বটগাছের মত ।
এরমধ্যেই যেন কাল মহাকালের পৃষ্টারা উল্টে গেল ।
কত ধুসর ইতিহাস শেষ করে নিমগ্ন জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে আছি যেনবা আমি হাজার হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে ।পিতাকে হারিয়ে যেন আমি এক বৃক্ষ মানবের মত হয়ে গেছি যার শেকড় বাকড় পিতার কবর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেছে ।
সম্বিত ফিরে পেলাম কারো স্পর্শে
সম্বিত হারাই পিতার স্পর্শের আকাঙ্খায় ।
কেউ আমায় টেনে নিয়ে আসে বাস্তবতার নিরেট চাতালে, আলোচনায় অথবা সামাজিকতায় ।কেউ হয়তো সান্তনার বানী শোনাতে উদগ্রীব ।কোন স্কুল বন্ধু কিছু একটা বলার চেষ্টা করে গলার আড়ষ্টতায় ।আমি নির্বাক চেয়ে দেখি চারিধার ।
যেন টের পাই আমার নির্মোহ ধার্মিক পিতা মুনকার নকীরকে নিশ্চই হাসিমুখে বিদায় দিয়েছেন ।কিন্ত পিতার দীর্ঘদিনের অসুস্থতার কারনে তাঁর হাসিমুখটা খানিক বেদনাক্লিষ্ট মনে হল আমার ।
কিন্ত মুনকার নকীর চলে যাবার পর কি তার অনন্ত ঘুম ?
তারপর কি তার অসীম অপেক্ষা কেয়ামতের ??
সম্বিত হারানো আর না হারানোর দোলাচালে আমি আচ্ছন্ন হয়ে থাকি ।
কেউ একজন আমার ঠোঁঠে একটা সিগারেট গুজে দিয়ে চলে যায় ।
আমি ঘাসের মধ্যে বসি, মাঠের মধ্যে বসি ,মাটির মধ্যে বসি।
আহারে ! আমার গ্রামের মাটি !এই মাটিতে বৃষ্টি কাঁদায় কত মাখামাখি করেছি আমরা ।হয়ত আমার পিতারাও ।
সেই মাটিতে পিতা আমার শুয়ে পড়েছে মাটিতেই মিশে যাবার প্রক্রিয়ায় ।
একদিন আমরাও ।
আমি ধোঁয়া উদগিরন করি ।আমি দুঃখ উদগিরন করি ।
আমার বুকে আশি মনের পাথর আটকে থাকে ।
আমি কি বলব কি করব বুঝে উঠতে পারিনা
পুরো নিয়ন্ত্রনহীন একটা সময়ের প্যাঁচে শুধুই পেঁচিয়ে যাচ্ছি ।
যেবার আমার প্রিয় নানাজান মারা গেলেন সেদিন আমার বালক বুকের মাঝে একটা পাথর আটকে যায় ।এক বালিকা এসে কত কি বলে বা কত চেষ্টা করেও পাথর নামাতে পারলনা ।
তারপর ধীরে ধীরে চোখের জলে সে পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে সহনশীল অবস্থায় এসেছিল।
এবারতো বুকজোড়া বিশাল পাথর!
কেউ কি এসে নামিয়ে দেবে সে পাথর ?
কোন এক সময় হাতপা ছড়িয়ে ঘাসের মধ্যে শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করে ।
দারুন ঘুম পায় আমার ।মাঠের মধ্যে এই শুয়ে পড়ায় আমার বুকে জেকে বসা পাথর গলতে শুরু করে ।
আহা ! আমার পিতাও এই মাটিতে শুয়ে আছেন ।মাত্র আড়াইহাত নীচে তিনি ।আমি উপরে যেন তার বুকের উপর । যেমন ছোটবেলায় তার বুকের উপর শুয়ে থাকতাম ।
আমি এক ধরনের আত্মিক টান খুঁজে পাই ।
আমার মধ্যে গহীন ঘুমের হাতছানি টের পাই ।
আমার পিতার স্নেহমাখা স্পর্শ টের পাই ।
এইত ক’দিন আগে আমার রোড এক্সিডেন্টে পায়ের যে জায়গাটার চামড়া উঠে গিয়েছিল সেখানে তিনি ভীষন মমতায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন ।আমি সেই স্পর্শ টের পাই ।
আমি ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকি, ডুবে যেতে থাকি
আমি পিতার স্পর্শের কাছে ডুবে যেতে থাকি
আমি ডুবে যেতে থাকি মাটির গন্ধে, ঘাসের গন্ধে- - - - - -