somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জ্যামিতি বক্স

১৩ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গ্রাম থেকে এসে দ্বিতীয় বার ক্লাস ফাইভে ভর্তি হল রুহিন। গোপালগঞ্জ এস. এম. মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়ের হাই স্কুল শাখার ভর্তি পরীক্ষায় উত্ত্বীর্ন হতে পারেনি বলে দ্বিতীয়বার একই ক্লাসে পড়তে হচ্ছে। গ্রামের স্কুলে যদিও সে প্রথম স্থান অধিকার করতো সব সময়। ওই স্কুলের পড়া লেখার মান কতটা নিচে তা বোঝা গেল এখানে এসে। একাডেমিক পড়ালেখায় ভাল না করলেও তার অন্যান্য বিষয়ে বেশ দক্ষতা ছিল। ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা, বাগান তৈরী, সাধারণ জ্ঞানের অনুষ্ঠান, বিজ্ঞান মেলা ইত্যাদিতে সে বরাবরই সবার থেকে ভাল। স্কুলের কিছু টিচার এই জন্য তাকে বেশ স্নেহ করতেন, উত্সাহ দিতেন। বন্ধু-বান্ধবও জুটে গেল অনেক।
সে তাদের ক্লাস ম্যাডামের কাছে প্রাইভেট পড়তো। অনেকেই পড়তো সে ব্যাচে। স্কুলে তাদের এই ব্যাচটা আন্য রকম ছিল। ম্যাডাম বেশ গর্ব করতেন এই ব্যাচের একান্ত টিচার হয়ে। এই গর্বটা কেন জানি কিছু টিচার ভাল চোঁখে দেখতেন না। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও একটা না একটা ঝামেলা পাকাতেন। মার্ক কম দেওয়া, পড়া পারলেও এক্সট্রা কিছু জিজ্ঞাসা করে মানসিক চাপ দেওয়া, অতিরিক্ত পেটানো, সার্বক্ষণিক এদের দোষ খুঁজে বের করা ইত্যাদি। সেই সব টিচারের কাছে যারা পড়তো তারাও সব বিচ্ছুর মত লেগে থাকতো পিছে। কিছু একটা হলেই নালিশের উপর নালিশ। আর তখন অবধারিতভাবে বেত্রাঘাত!
তখন সে বুঝতে পারেনি এই ঝামেলার মূলে ছিল টিচারে টিচারে অন্তর্দ্বন্দ্ব, হিংসা, ও সামান্য বিষয়ে জিতে থাকার প্রবণতা। এর ভয়াল রূপ তাদের কচি মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতো। শুধু তাদের স্কুলেই এটা সীমাবদ্ধ ছিলনা। অন্যান্য স্কুলেও সমান তালে দ্বন্দ্ব চলতো। এমনকি এক স্কুলের সাথে অন্য স্কুলের পাল্লা কতটা খারাপ প্রভাব ফেলতো তা বড় হয়ে বুঝেছে। স্যার-ম্যাডামরা অযথাই একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার দেয়াল গড়ে তুলতেন। প্রাইমারি, হাইস্কুল, কলেজ ইত্যাদি পাশ করে এসে দেখেছে তার এক সময়ের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বি ছেলেটাই তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তার সাথে এক বেঞ্চে বসবেনা বলে যে মেয়ে কান্নাকাটি করেছিল, সে একসময় নিজে হ্যান্ড নোট বানিয়ে তাকে দিয়েছে! অন্যরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে জীবনের তাগিদে। দেখা হলে আগে বুকে জড়িয়ে ধরে। এই জড়িয়ে ধরাই প্রমান করে ছোটবেলার সেই পরিচয়ই মূল পরিচয়। সারা পৃথিবী চষে বেড়ালেও এদের মত সুহৃদ পাওয়া যাবেনা।
তার কচি মনে একটা গভীর ক্ষত এখনো ফিরে ফিরে আসে। একটা আক্ষেপ। এই আক্ষেপটা আর কোনদিন পূর্ণ হবেনা। একদিন ম্যাডাম এসে বললেন, ‘ক্লাস ফোর আর ফাইভ মিলিয়ে সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা হবে। তোদের নাম দিয়ে এসেছি...।’
সে খুবই খুশি হল। কারণ, তার অনেক পুরস্কার জেতা আছে এই বিষয়ে। ম্যাডাম আবার বললেন, ‘রুহিন...তোর যে লাল সাধারণ জ্ঞানের বইটা আছে ওটা নিয়ে আসবি।’
সে এবার মহা খুশি হল। তার বইটা সম্পূর্ন মুখস্থ। এ বই থেকে যদি প্রশ্ন করে তো ফার্স্ট সেই হবে। টিফিনের ছুটিতে বাসায় গিয়ে বইটা এনে দিল।
পরদিন বেলা দেড়টার সময় প্রতিযোগিতা শুরু হল। সবাই লাইন দিয়ে পূর্ব পাশের ফাইভ ‘গ’ শাখার বাইরে দাড়িয়ে। একজন একজন করে ভিতরে ডাকা হচ্ছে। যারা বেরিয়ে আসছে তারা কি প্রশ্ন হল তা ভুলেও উচ্চারণ করছেনা। সোজা মাঝের ‘খ’ শাখায় গিয়ে বসছে। একসময় তার ডাক পড়লো। ভিতরে গিয়েই দেখলো তারই বইটা ধরে বসে আছেন এক স্যার। অন্য পাশে ফোরের এক ক্লাস ম্যাডাম। উনার হাতেও একটা বই। ফোরের স্টুডেন্টদের সাথে যাতে দুর্নীতি করা না হয় সেটাও দেখছেন। রুহিন গিয়ে সালাম দিল। স্যার বসতে বললেন। বসলেই ম্যাডাম একটা প্রশ্ন করলেন। উত্তরটা ঠোঁটের আগায় ছিল। ঝটপট দিয়ে দিল। এবার স্যার প্রশ্ন করলেন। সেটাও পারলো। এভাবে নয়টা প্রশ্নের উত্তরই ঠিক হল। বাকি একটা প্রশ্ন। স্যার এই প্রশ্নটা এমন ভাবে উচ্চারণ করলেন যে সে কিছুই বুঝতে পারলোনা। আবার জিজ্ঞাসা করলো প্রশ্নটা। এবারো স্যার একই ভাবে বললেন। যথারীতি প্রশ্ন না বুঝে, ‘স্যার...’ বলে মুখের দিকে তাকাতেই উনি বললেন, ‘তোমার সময় শেষ। এক প্রশ্ন দুবারের বেশি করা হবেনা...।’
তিনি নেক্সট স্টুডেন্টকে ডাকলেন। আর তার বেরিয়ে যেতে হল। মন খারাপ হয়ে গেল তার। কিছুক্ষণ পরে এসে স্যার তাকে বললেন, ‘কি ব্যাপার...তুমি শেষ প্রশ্নটা পারলেনা কেন..?’
সে বলল, ‘আমি প্রশ্ন বুঝতে পারিনি স্যার..’
স্যার বললেন, ‘পৃথিবীতে কোন পিপড়ার সংখ্যা বেশি, এটা জিজ্ঞাসা করেছিলাম...তুমি তো বুঝলেই না। তুমি পারতে না...?’
সে মুখ গোমড়া করে উত্তর দিল, ‘পারি স্যার...লাল পিপড়া...।’
স্যার তখন হেসে বললেন, ‘এখন পেরে তো লাভ নেই...পরের বার ভাল করো’
উনি উঠে গেলেন। রুহিন কেঁদে দিল। স্যার এই মাত্র কত সুন্দর করে প্রশ্নটা করলেন। সব গুলো শব্দই পরিষ্কার বোঝা গেল। আর তখন কি বিড়বিড় করে বলেছিলেন তা উনি আর উপর আল্লাহই ভাল জানেন।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হল। সে সেকেন্ড হয়েছে। দুর্ভাগ্য যে, একমাত্র ফার্স্ট ব্যতীত অন্য কেউ পুরষ্কার পাবেনা। ফার্স্ট হল ওই স্যারের কাছেই প্রাইভেট পড়া এক ছাত্র যে আগে সাধারণ জ্ঞানের অনুষ্ঠানে তৃতীয় নাম্বারও হয়নি। পুরষ্কার ছিল ‘একটা জ্যামিতি বক্স!’ যেটা ওই ছেলেকে পেতে দেখে তার মন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। আবার কান্না পেয়েছিল। এবং সে এসে বসেছিল তাদের ‘ক’ শাখায়। একা! একসময় ম্যাডাম এসে তাকে বইটা ফেরত দিলেন। একটু আদর করে দিয়ে বললেন, ‘মন খারাপ করিস না। আমি শুনেছি তোকে ঠিক মত প্রশ্ন করা হয়নি। ফোরের ম্যাডামই বলেছেন। নেক্সট থেকে উনাকে আর এসব অনুষ্ঠানে না রাখতে হেডমিস্ট্রেসকে অনুরোধ করবো...।’ সে বইটা নিয়ে আর এই বিষয়ে কথা বলল না। ম্যাডামের পিছেপিছে বেরিয়ে এল।
এই স্কুলে পড়া কালিন কখনো আর সে কোন কুইজ বা সাধারণ জ্ঞানের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি। তার মনে এই ঘটনা থেকে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল। এখন সে বোঝে যে ওই রকমভাবে হারিয়ে স্যার হয়তো সে দিনের মত একজনকে জিতিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। যে ভাবনা গুলো জীবনের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর ঐ জ্যামিতি বক্সটা খুবই সুন্দর ছিল! ওটার প্রতি তার আকর্ষন ছিল, না পাওয়ার আক্ষেপ ছিল এবং আজও আছে। এখন সে হাজারটা জ্যামিতি বক্স কিনতে পারে কিন্তু ওটার মূল্য অনেক। ওই সময়টা যে আর নেই। এই জিনিসের প্রয়োজনও শেষ হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। তবুও....!
শাশ্বত ২৩.০৭.১৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভুল শুধু ভুল নয়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৬

এক
লেখাটা একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি। ১৯৯৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে শফিপুর আনসার একাডেমিতে বিদ্রোহ হয়। ৪ ডিসেম্বর পুলিশ একাডেমিতে অভিযান চালায়। এতে চারজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছিল। এটি ছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। VF 3 Mini: মাত্র 60 মিনিটে 27 হাজার বুকিং!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:০৪



আমার ব্যাক্তিগত গাড়ি নেই কিন্তু কর্মসূত্রে বেঞ্জ , ক্যাডিলাক ইত্যাদি ব্যাবহার করার সুযোগ পেয়েছি । তাতেই আমার সুখ । আজ এই গাড়িটির ছবি দেখেই ভাল লাগলো তাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাময়িক পোস্ট: বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন

লিখেছেন করুণাধারা, ২১ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন! view this link

সামহোয়্যারইনব্লগ থেকে কয়েকজন ব্লগার আলাদা হয়ে শুরু করেছিলেন সচলায়তন বা সংক্ষেপে সচল ব্লগ। এটি বন্ধ হবার মূল কারণ উল্লেখ করা হয়েছে দুটি:

১)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×