somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লেখক হতে চাই না

১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বছর খানেক আগে একটা জাতীয় দৈনিকের সাপ্তাহিক ‘সাহিত্য সাময়িকীতে’ হঠাৎ চোখ পড়েছিল। দেখলাম ‘খ্যাতিমান’ লেখকগণ তাদের ‘প্রিয় গ্রন্থ’ নিয়ে আলোচনা করেছেন। পুরো সাময়িকীটি আমাদের সেই লেখক-সাহিত্যিকদের প্রিয় গ্রন্থের আলোচনা নিয়েই সাজানো হয়েছিল। এটা পড়ে বর্তমান নামকারা লেখকদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি কিছু গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্পর্কেও একটা মোটামুটি ধারণা লাভ করতে পেরেছি। আর এগুলো নিয়ে ‘ধারণা’র বেশি কিছু অর্জন প্রয়োজনও নেই। তাই এই ধারণার উপর ভিত্তি করেই আমার লেখক হওয়ার ইচ্ছেটা হঠাৎ বিপরীত দিকে মোড় নিল।

গত ১০ বছর ধরে যদিও মনের ভেতর লেখক হওয়ার একটা তীব্র বাসনা লালন করে আসছিলাম। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ‘লেখক’ হওয়ার কোনো দরকারই নেই। কারণ এ ধরনের অবাস্তব, কল্পনাপ্রসু, অর্থহীন, হেঁয়ালী লেখা ও ‘কথা সাহিত্যে’ প্রকৃতপক্ষে মানবসমাজের ন্যূনতম উপকার আছে বলে মনে হয় না, সময় নষ্ট ও মেধার অপচয় ছাড়া। ডায়রিতে প্রতিক্রিয়া লিখেছি, “লেখক হওয়াটা হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। যদি কিছু না হতে পারি, লেখক হব। আমাদের চেনা-জানা পৃথিবীর বড় বড় লেখক-সাহিত্যিকগণ ব্যর্থতা থেকেই সম্ভবত ‘লেখক’ হয়ে ওঠেছেন।”

আমি মনে করি একজন চিন্তাশীল ও বিপ্লবীর চোখে সমাজের অসঙ্গতি ও এর সমাধানগুলো প্রকাশের ভাষা আরও ‘সরাসরি’ হওয়া উচিত। গল্প-উপন্যাসের নামে পাঠকদের সাত সমুদ্র তের নদী পার করানোর কোনোই প্রয়োজন নেই। নিজেও এসব ‘অবাস্তব’ নদী সাগরে কিংবা হাঁটুপানিতে ডুবে মরে লাভ নেই। অবশ্য যারা মানবজীবনের ‘চূড়ান্ত সমাধানে’ ‘বিশ্বাস’ করেন না; দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ, কলহ, অশান্তি ও নৈরাশ্যকেই জীবনের একমাত্র নিয়তি মনে করেন, তাদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি আর কী আশা করা যায়! সাময়িক ভোগ-বিলাস, ক্ষণকালের প্রেম-রোমাঞ্চ, অবাস্তব কাহিনীর টার্নিং পয়েন্ট ও কল্পনার ফানুশ ওড়ানো ছাড়া?

বাস্তব জীবনে ‘এরা’ আদর্শ নন। আজ বাস্তব জগতে যেখানে সমস্যার অন্ত নেই, সেখানে গল্প-উপন্যাসে মেধার অপচয় যথেষ্টই হচ্ছে। এটা এক প্রকার নেশা, মানসিক রোগ বা আসক্তি। যুব-প্রজন্মের সিংহভাগই আজ চিন্তাসমৃদ্ধ ও গবেষণামূলক বই-পুস্তক পাঠে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আজকাল চিন্তা ও গবেষণার কথা শুনলে তরুণদের গায়ে জ্বর ওঠে, তারচেয়ে বরং তারা মনে করে হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ে মগ্ন হয়ে একটু ‘রোমাঞ্চ’ খোঁজা ভাল। এতে নাকি ‘জ্ঞান’ বাড়ে, আবিষ্কারের নেশা জাগে। অথচ এই প্রজন্ম বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাসটাই ভালো করে জানে না। অথচ এই বয়সটাই ছিল একটি ‘জ্ঞানসমৃদ্ধ সমাজ’ গঠনে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের প্রকৃত বয়স। বিশেষ সময় ও পরিস্থিতিতে কবিতার অবশ্য একটা আবেদন আছে। কবিতা আবেগ সৃষ্টি করে, উদ্দীপনা জাগায়, হৃদয়ে ঝড় তোলে। বিশেষ সময় ও পরিস্থিতিকে কাজে লাগায়, তবে জ্ঞান বাড়ায় না।

আসলে আমি লেখা ও সাহিত্যের বিপক্ষে নই। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে ‘সাহিত্য’ কি; সত্যিকার জ্ঞান অন্বেষণে সহায়ক লেখাই বা কি। আমাদের দেশে প্রতিবছর একুশে বইমেলাকেন্দ্রিক যে সাহিত্য গড়ে উঠেছে বা পার্শ্ববর্তী দেশ ও পাশ্চাত্য থেকে সাহিত্যের নামে যা আসছে, আমরা যা আমদানি করছি তাই কি সাহিত্য? প্রতিদিন শত শত জাতীয় দৈনিকে যে হাজার হাজার কলাম ও মন্তব্যধর্মী লেখা ছাপা হয় তাই কি জ্ঞান? প্রশ্নগুলো হয়তো কিছুটা মৌলিক, তাই সামান্য তিক্ত! যদিও কাউকে আক্রমণ বা একপেশে সমালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য না।

সংবাদপত্রগুলো মূলত যা করছে, প্রথমত সংবাদ প্রদান ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি। যেহেতু সামগ্রিকভাবে ভালো সংবাদের ঘাটতি, তাই পত্রিকাজুড়ে শুধু দুঃসংবাদ আর অপরাধ চিত্র। এতে করে সর্বস্তরের অস্বাভাবিক ঘটনা, দুঃসংবাদ ও জঘন্য অপরাধগুলো দিন দিন আমাদের কাছে স্বাভাবিক ঠেকছে। হাল্কা হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে জ্ঞান, ইতিবাচক মানসিকতা এবং ‘শক্তিশালীদের’ পক্ষ থেকে ‘দুর্বলদের’ জন্য গঠনমূলক পদক্ষেপের অভাবে অবাধ তথ্যপ্রবাহ উপকারের পরিবর্তে এখন চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, একদল পেশাজীবী লেখক/কলামিস্ট/সাংবাদিক বিপ্লবাত্মক সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশ না নিয়ে বরং সুসজ্জিত রুমে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কেবল লেখালেখি নিয়েই দিনাতিপাত করেন। আর নিজেদের সুবিধামত সমকালিন ঘটনাবলী ও পরিস্থিতির মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করান। বাস্তব কর্ম ও চিন্তার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকলে খুব বেশি লেখার সময় নেই, প্রয়োজনও নেই।

সেদিন কথা প্রসঙ্গে একজন বললেন, কেবল লেখার জন্য লেখা নয়, লেখার মাধ্যমে বাস্তব জগতে চাই সংস্কার; পরিবর্তন, বিপ্লব। সাবেক সেনাপ্রধান মঈন উদ্দীন আহমেদ ওয়ান-এলিভেনের পর বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেছিলেন। এর সূত্র ধরে পরবর্তীতে তিনি যখন বিশাল এক ‘বই’ লিখে ফেললেন, অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি যে, ‘তিনিও’ লিখতে পারেন। আজকাল ক্ষমতাবানদের অনেককেই বই লিখতে দেখা যায়, সারা জীবনেও লেখালেখির সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাই এক ত্যাগী সাংবাদিক আক্ষেপের সুরে মন্তব্য করেছিলেন, “বাংলাদেশে এখন লেখক-কবির সংখ্যা কাক-পক্ষীর চেয়েও বেশি।” আসলেও তাই। লেখা যেন এখন কিছু লোকের শখ, আর কিছু লোকের পেশা। আত্মসমালোচনামূলক, অনুসন্ধানধর্মী ও জ্ঞানগর্ভ লেখনি এখন বিরল। এর পাঠকও নেই বললেই চলে।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭


জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×