somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার যদি শীতের কাপড় না থাকতো...

০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ঝড় বৃষ্টি রোদ যাই থাকুক, আড্ডা মিস হয়না আমাদের। এই প্রচন্ড শীতের রাতেও কাপড়ের উপর কাপড় চড়িয়ে, মাঙ্কি ক্যাপে মুখ ঢেকে একেকজন মঙ্গোলিয়ান যোদ্ধা সেজে চলে আসে সবাই আড্ডায়। তারপর কাঁপতে কাঁপতে চা সিগারেট আর চলতে থাকে চাপাবাজি। কিন্তু ভিক্ষুকদের জ্বালায় মাঝে মাঝেই আড্ডা দেয়া বিরক্তিকর হয়ে পড়ে। প্রতিদিন রাত ১০টা ১১টা পর্যন্ত এদের ওভার টাইম সহ ডিউটি চলে; বাদ যায় না শীতের রাতগুলোও। গতরাতে হঠাত পায়ের কাছে টোকা পড়লো। তাকিয়ে দেখি পিচ্চি এক মেয়ে, কোলে আবার একেবারেই অল্প বয়সী একটা বাচ্চা; হাত পেতে আছে। বেশিরভাগ সময় যা করি, তাই করলাম। কঠিন একটা ধমক দিয়ে বিদায় করলাম। মেয়েটি নির্বিকার চিত্তে আরেক বন্ধু মাসুমের কাছে হাত পাতলো।

“কিরে, টাকা দিয়া কি করবি?”
“ভাইরে লইয়া ভাত খামু।” রিন রিনে গলায় উত্তরটা কানে যেতেই ভাল মত তাকালাম। মেয়েটির পরনে পাতলা একটা সোয়েটার আর ছোট্ট হাফপ্যান্ট। আর বাচ্চাটির গায়ে শুধু বেঢপ একটা জ্যাকেট, আর কিছু নেই।

শীতে জমে যাওয়া চিন্তা চেতনাগুলো কিছুটা কাজ করা শুরু করলো। ভাবলাম, আমরা পূর্ণ বয়স্ক মানুষ এতগুলো জামা কাপড় পড়েও শীতে কাঁপছি। হাতে ঠান্ডা লাগে বলে হাত মোজা পড়ে আছি। ঠান্ডায় মাথা, কান ব্যাথা করে বলে পড়ে আছি মাঙ্কি ক্যাপ। বাসার নিচে আড্ডা মারতে এসেছি মোজা আর কেডস পড়ে। তারপরেও কাঁপছি। একের পর এক চা খাচ্ছি, সিগারেট ধরাচ্ছি।

তাহলে এই মেয়েটি আর বাচ্চাটি এই অল্প কাপড়ে টিকে আছে কিভাবে? আর ওইযে বিরক্তিকর বুড়ো; শুধু লুঙ্গি আর চাদর জড়িয়ে ভিক্ষা করছে! মানুষের করুণা পেতে এরা এই রাস্তা ধরেছে? হাড় কাঁপানো শীতে এরা ভিক্ষা বেশী পাবার আশায় মোটা কাপড় খুলে ফেলেছে? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার? না, আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারলাম না। তাহলে এরা কি অমানুষ? পশু শ্রেণীর? তাও সম্ভব না। এরা মানুষের মতোই দেখতে।

ভোর বেলা অফিস যাবার সময় দেখি, কুয়াশা ফুড়ে কাঁপতে কাঁপতে হেটে আসে কিছু যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ। বয়স্ক, মধ্যবয়স্ক, তরুণ, শিশু – সব শ্রেনীর। এরা কামলা জাতীয় মানুষ। গায়ে শীতের কাপড় নেই অনেকের। কোনমতে কাজের জায়গায় পৌছুতে পারলেই ওম পাওয়া যাবে; দাঁতে দাঁত চেপে এই ভরসাতেই হয়তো শীতের কষ্ট সহ্য করার প্রাণশক্তি এসে যায় এদের।

শীতের কষ্ট কেমন আমি কি জানি?
টের পাই সকালে গোসল করার সময়। আর তখন, যখন মাঝে মাঝে শীতের রাতে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরাই। একটু পরেই ঠান্ডায় ঠকঠক করে হিস্টিরিয়াগ্রস্তদের মত কাঁপি। দাঁত কপাটি লেগে যায়। একলাফে ঘরের ভেতর এসে ঢুকে যাই লেপের নিচে। যাঃশালা, কঠিন শীত পড়সে।

বাজারে, ফুটপাতে কত শীতের কাপড়! কিন্তু এও বুঝি এই সামান্য সস্তা কাপড় কেনার সামর্থও অনেক মানুষের নেই। না হলে, কেন শুধু শুধু গরীব মানুষ গুলো এই অমানুষিক কষ্ট করবে শীতের মধ্যে? গরীবি দেখানোর জন্য? কিন্তু; গরীবি তো বিলাসিতা নয় যে লোক দেখাতে হবে!



আমি যদি বাচ্চা মেয়েটির জায়গায় কিম্বা সেই বুড়ো মানুষটির জায়গায় থাকতাম, অথবা আমার যদি শীতের কাপড় না থাকতো, যখন দেখতাম কত মানুষ কত ফ্যাশনের জামা পড়ে শীত কাটাচ্ছে, কত অজস্রই না আছে তাদের, আর আমার কিছুই নেই। এত শীত লাগছে, কুকড়ে যাচ্ছি যন্ত্রনায়, অবশ হয়ে যাচ্ছে আঙ্গুল, ঠোট ফেটে বেরুচ্ছে রক্ত, চামড়া হয়ে গেছে মাছের আঁশের মত; তখন আমার কেমন লাগতো?

হয়তো হাত পাততাম বর্তমানের আমার মত কারো কাছে। আমিই হয়তো ধমক দিয়ে আমাকে তাড়াতাম, অথবা কোমল গলায় বলতাম, মাফ কর। আমার তখন কেমন লাগতো? আমার চাউনিতে কি থাকতো?



বিস্ময়? আরে আমি শীতে কষ্ট পাচ্ছি, আর তোমার কাছে আমাকে দেবার মত কিছু নেই?

অভিমান? স্রষ্টার উপর? কেন কষ্ট দিচ্ছ আমাকে? ওদের মত আমিও তো তোমার বান্দা...

রাগ? হারামজাদা বড়লোকের বাচ্চা, মাফ করতে বলিস ক্যান?

কিম্বা অনুভূতিহীন দৃষ্টি? কষ্ট পাওয়াই নিয়তি ভেবে সঁপে দেয়া জীবন?

মাসুম যখন সেই ভাই বোন দুটিকে নিয়ে খাওয়াতে নিয়ে গেল, আমি তখন ভাবছিলাম, কার বাসায় আছে এরকম ছোট্ট শিশু? মনে পড়লো শেখরের ভাতিজি রাধিকা’র কথা; যাকে দেখলেই মনে হয় আমার এমন একটা বাবু লাগবে, এখনি। যার এটাই প্রথম শীত, তার আবার পুরোন জামা আসবে কোথেকে? তারপরেও গেলাম রাধিকা’দের বাসায়। আমাকে দেখেই দুষ্টুটা আমার দুরোভিসন্ধি বুঝতে পেরে উল্টো হামাগুড়ি দেয়া শুরু করলো। সব শুনে হাসিমুখে বউদি বের করে দিলেন কিছু কাপড়। এক দৌড়ে চলে এলাম নিচে। মাসুম আর আমি মিলে সেগুলো পড়িয়ে দিলাম পিচ্চি মেয়েটির সেই ভাইটিকে।

প্রতি শীতের শুরুতেই আমাদের মসজিদ থেকে এলাকা ভিত্তিক ভাবে সংগ্রহ করা হয় মোটা কাপড়। তারপর একসাথে করে পাঠিয়ে দেয়া হয় প্রত্যন্ত কোন শীতার্ত এলাকায়। সব সময়ই বেশ ভালো ভাবে কন্ট্রিবিউট করে এ বছর আর দেয়ার মত তেমন কিছু ছিলনা আমাদের পরিবারের। ফজরের নামায পড়ে বাসায় ফিরেন আমার বাবা; তার সাথেই হেঁটে যেতে থাকে পাতলা কাপড় গায়ে দেয়া কিছু মানুষ, কাজে যাচ্ছে। তিনি মন খারাপ করেন। বাসায় ফিরে খুঁজে বের করেন কিছু মোটা কাপড়, আর পরদিন ভোর বেলায় দাঁড়িয়ে থাকেন সেই দুঃখী মানুষদের অপেক্ষায়। ডেকে ডেকে হাতে তুলে দেন অকিঞ্চিতকর একটি মোটা জামা আর তাদের অবাক দৃষ্টিতে ভাষা ফোটার আগেই সরে পড়েন।

ব্লগার শিপু ভাই আর বাংলার হাসান ভাই; তারা নিজেদের উদ্যোগে শীতার্ত মানুষের জন্য সেই লক্ষীপুরে শীত বস্ত্র বিতরন করে এসেছেন।
"সামহোয়্যারইন ব্লগারদের উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম-২০১২" সফল ভাবে সমাপ্ত

আমরা হয়তো অনেকেই তাদের মতো ডেডিকেটেড নই, তাদের মতো অর্গানাইজডও নই, কিম্বা সব শীতার্তদের গায়ে ওম দেয়ার সামর্থও নেই। কিন্তু হয়তো আমাদের মনও কাঁদে সেইসব কষ্ট পেতে থাকা মানুষদের জন্য, ইচ্ছা হয় তাদের তরে কিছু করার জন্য। কি করতে পারি আমরা?

অন্তত একজন মানুষের সাথে শীতের তীব্রতা ভাগাভাগি করতে পারি, অন্তত একজন মানুষকে ওম দিতে পারি, অন্তত একজন মানুষের কষ্ট লাঘব করতে পারি। আড্ডা দিতে যাবার সময় নিয়ে যাই না একটা গরম কাপড়! সামনে যাকেই পাই, তাকে পড়িয়ে দেই। অফিসে যাবার সময় সাথে নেই একটা সোয়েটার, দিয়ে দেই আমার মতই শ্রম দিতে যাওয়া আরেকজন মানুষকে। অথবা অল্প দামে কিনে নেই কিছু বাচ্চাদের জামা কাপড়, নিজের সন্তান, ভাই কিম্বা বোনের কথা মনে করে; মমতা নিয়ে জড়িয়ে দেই অন্য কোন দূর্ভাগা মানব শিশুকে। ভিক্ষা চাইতে আসা কোন বুড়োকে মাফ করতে বলার আগে একটু ভাবি, আগামী শীতে এই বুড়ো হয়তো আমাকে আর জ্বালাতে নাও আসতে পারে।

অন্তত শুধু এটুকু ভাবি, এই তীব্র শীতে আমার যদি মোটাকাপড় না থাকতো?
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:৪৫
৫৬টি মন্তব্য ৫৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×