শেষ বারের মতো অধিবেশনে বসলেন ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ীরা; ‘জরুরি’ পরিস্থিতি না হলে আর বসবে না নবম সংসদ।
Published : 20 Nov 2013, 07:38 PM
নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে ধারণার চেয়ে এক মাস বেশি সময় গড়ায় নবম সংসদের ১৯তম অর্থাৎ শেষ অধিবেশন।
বুধবার রাতে এই অধিবেশনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির কথা জানান অধিবেশনে সভাপতিত্বকারী দেশের প্রথম নারী স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
এই সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ পড়ে শোনান তিনি; কেননা সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী সংসদের অধিবেশন আহ্বান ও সমাপ্তি ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি।
তার আগে সমাপনী বক্তব্যে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “এ অধিবেশনই শেষ। ইমার্জেন্সি বা যুদ্ধাবস্থা না হলে অধিবেশন বসবে না। নবনির্বাচিতরা আগামী সংসদে আসবে।”
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনরত বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সংসদের শেষ অধিবেশনের সমাপ্তি হল, যা নিয়ে হতাশার সুরও ছিল প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে।
অধিবেশন শেষ হলেও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের বলে বহাল থাকবে নবম সংসদ। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করা এই সংসদের মেয়াদ ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত রয়েছে। আর এর মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছি নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে। উনি ব্যবস্থা নেবেন।”
বিরোধী দলের ভোট বয়কট ও প্রতিহত করার হুমকির মধ্যে নির্বাচনকালীন ‘সর্বদলীয়’ সরকার গঠনের পথে এগিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা বলেন, “নির্বাচন বাংলার মাটিতে হবেই, বানচাল করার ক্ষমতা কারো থাকবে না।”
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগে বলেছিলেন, ২৫ অক্টোবর নির্বাচনের দিনগণনা শুরুর পর সংসদ অধিবেশন আর বসবে না।
কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে মতানৈক্যের মধ্যে গত ১২ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া ১৯তম অধিবেশনের মেয়াদ দুই দফা বাড়ানো হয়।
২৫ অক্টোবর দুই পক্ষ রাজপথে অবস্থানের ঘোষণা দিলে দেশজুড়ে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়, যদিও পরে সংঘাতের কোনো পরিস্থিতি ঘটেনি।
মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিরোধী দলকে তাদের প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য সময় দেয়াই ছিল উদ্দেশ্য।
অন্যদিকে সংসদে আলোচনার ‘পরিবেশ’ নেই বলে বিরোধী দল অধিবেশন বর্জনের পাশাপাশি নিজেদের সংখ্যালঘিষ্ঠতার কথা তুলে ধরে বলে আসছিল, নির্দলীয় সরকারের বিল তুললে সরকারি দলকেই তুলতে হবে।
সংসদ অধিবেশন আর বসবে না বলে বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের পথ কার্যত বন্ধ হয়ে গেল।
নির্বাচনকালে এখন অনির্বাচিতদের সরকারে যাওয়ার সুযোগ না থাকলেও বিরোধী দলের ‘আস্থা’ অর্জনের লক্ষ্যে ‘সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা’ গঠন করছেন শেখ হাসিনা। তাতে যোগ দিতে বিএনপির প্রতি আহ্বানও জানান তিনি।
সমাপনী অধিবেশনে শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে আশ্বস্ত করে আরো বলেন, “নির্বাচনকালীন সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় নির্বাচনের কমিশনের অধীনে থাকবে। বদলি বা অন্য কোনো আদেশ তারাই করবেন।
সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের পর নবম সংসদেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন হয়, যা চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সূত্রপাত ঘটায় বলে বিএনপির দাবি। সরকারের বক্তব্য, আদালতের আদেশ শিরোধার্য মেনেই এটা করা হয়েছে।
১৯তম অধিবেশনে মোট কার্যদিবস ছিল ২৪টি, বিল পাস হয় ৩৭টি। যার মধ্যে দুটি বেসরকারি বিল। প্রধানমন্ত্রীর জন্য জমা পড়া ১২৯টি প্রশ্নের মধ্যে ৪১টির উত্তর দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
অন্যান্য মন্ত্রীদের জন্য প্রশ্ন জমা পড়েছিল ২ হাজার ৬২৩টি প্রশ্ন। এর মধ্যে উত্তর দেয়া হয়েছে ১ হাজার ৮১৩টির।
১৯তম অর্থাৎ শেষ অধিবেশনে বিএনপি যোগ দিয়েছিল মাত্র একদিন।
এক নজরে নবম সংসদ
নবম জাতীয় সংসদে মোট কার্যদিবস ছিল ৪১৮, যা দেশের সংসদীয় ইতিহাসে রেকর্ড। বিল পাসের ক্ষেত্রেও এ সংসদ রেকর্ড করেছে, মোট পাস হওয়া বিলের সংখ্যা ২৭১।
অন্য যে কোনো সংসদের চেয়ে এবারের সংসদে বিরোধী দলের বর্জন ছিল রেকর্ড পরিমাণ। এ সংসদে বিরোধী দল অনুপস্থিত ছিল ৩৪২ কার্যদিবস, উপস্থিত ছিল ৭৬ কার্যদিবস।
আর বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন ১০ দিন। এ সংসদেই বিরোধীদলীয় নেতা গত ২০ মার্চ ১ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট বক্তব্য দেন, যা সংসদীয় ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
গত ১৮তম অধিবেশন পর্যন্ত নবম সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি ছিল ৩২২ দিন।
সবচেয়ে বেশি কার্যদিবস ছিল প্রথম ও চতুর্থ অধিবেশনে ৩৯ কার্যদিবস। আর ১০ম অধিবেশন স্থায়ী হয়েছিল মাত্র চার কার্যদিবস।
সংসদ সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের পর পঞ্চম সংসদে (১৯৯১-১৯৯৫) প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ২৬৫ কার্যদিবসের মধ্যে ১৩৫দিন সংসদের বাইরে ছিল।
সপ্তম সংসদের (১৯৯৬-২০০১) বিরোধী দল বিএনপি ২১৯ কার্যদিবসের মধ্যে ১৬৩ দিন সংসদের বাইরে ছিল। আর অষ্টম সংসদের (২০০১-২০০৬) বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ৩৭৩ কার্যদিবসের মধ্যে ২২৩ দিন বাইরে ছিল।
বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা পঞ্চম সংসদে উপস্থিত ছিলেন ১৩৫ দিন, আর অষ্টম সংসদে ৪৫ দিন।
অন্যদিকে খালেদা জিয়া বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে সপ্তম সংসদে ছিলেন ২৮ দিন।
বিরোধী দল সংসদে অধিকাংশ দিন না থাকলেও সরকারি দলের সদস্যরাই সরকারের সমালোচনায় সরব হয়েছেন বিভিন্ন সময়। সরব ছিলেন একমাত্র স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিমও।
নবম সংসদেই অশালীন বক্তব্যের ব্যবহার দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়, এজন্য মাইক ব্যবহারের ক্ষমতার প্রয়োগ করতে হয় স্পিকারকে অনেকবার।
বর্তমান সংসদে পাস হওয়া উল্লেখযোগ্য আইনগুলোর মধ্যে রয়েছে: ঢাকা সিটি কর্পোরশেন দ্বি-খণ্ডিত করে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) (সংশোধন) ২০১১, দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) বিল, গ্রামীণ ব্যাংক বিল, রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে তিন বছরের বিধান বাধ্যতামূলক থাকার বিধান তুলে দিয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) (সংশোধন) বিল, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯, তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধন) আইন ২০০৯, ২০১০ (মুক্তিযোদ্ধাদের চাকুরীর বয়স বৃদ্ধি), পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন, ২০১০।
এই নবম জাতীয় সংসদেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা প্রসঙ্গে একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়।
দেশের সংসদীয় ইতিহাসে এবরাই প্রথম অধিবেশনে সবগুলো সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়। গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৫১টি সংসদীয় কমিটি মোট ২ হাজার ১৬টি বৈঠক করেছে। এসব কমিটিগুলো সাব-কমিটি গঠন করেছিলো ১৮২টি। যার বৈঠক হয়েছে ১৮২টি।