somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজব দুনিয়া - তাইওয়ানের পেশাদার কাঁদুনে লিউ

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কোনো দুঃখ কষ্ট ছাড়া প্রতিদিন কি কেউ কাঁদতে পারে-এমনি এমনি? কেউ পারুক বা না পারুক, দিনের পর দিন এ কাজটি করে যাচ্ছেন তাইওয়ানের মেয়ে লিউ জুন লিন। প্রতিদিন অচেনা অজানা লোকজনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় গিয়ে কেঁদে বুক ভাসায় সে।

তাইওয়ানের একজন নামকরা কাঁদুনে লিন। মৃত মানুষদের জন্য শোক প্রকাশে কান্নাকাটি করাটা একসময় সে দেশে সম্মানজনক পেশা হিসেবে বিবেচিত হতো।

শোক প্রকাশের এই বাণিজ্যিকীকরণের প্রক্রিয়াটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও লিউর মতো কাদুনিদের জন্য তাইওয়ানে একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কেননা সেখানে মৃত ব্যক্তির জন্য চিৎকার করে কান্না করাকে ঐতিহ্য হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।

লিউ বলেন, ‘কারো প্রিয়জন মারা গেলে তার পরিবার পরিজনরা এত বেশি কান্না করেন যে, তার অন্তোষ্টিক্রিয়ার সময় তারা এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলতে পারেন না।’

আপনি যখন তখন এভাবে কাঁদেন কি করে? বিবিসি প্রতিবেদকের এ প্রশ্নের উত্তরে লিউ জানায়, ‘প্রতিটি অন্তোষ্টিক্রিয়ায় মৃতের পরিবারটিকে নিজের পরিবার ভেবে নেই। তখন আর কান্না করতে কষ্ট হয় না।’

আগের দিনে পরিবারের মেয়েরা প্রায়ই বিভিন্ন শহরে কাজ করতে যেতো। তখন পরিবহন ব্যবস্থা ভালো না থাকায় পরিবারের কেউ মারা গেলে সময়মতো তাদের অন্তোষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেওয়া সম্ভব হতো না। পরিবারের লোকজন তখন শোক প্রকাশের জন্য বাইরে থেকে মেয়ে যোগাড় করে আনতো। তাইওয়ানে এদের বলা হয় ‘ফিলাল ডটার’।

ত্রিশ বছরের লিউ কান্না করার সময় সাদা রংয়ের একটি বিশেষ পোশাক পড়ে থাকে। হাত আর হাটুজোড়া দিয়ে কফিনের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে কাঁদতে থাকে সে। কান্নার পাশাপাশি সে নানা শারিরীক কসরৎও করে থাকে। আর এ সময় তার ভাই পাশে বসে বাদ্যযন্ত্র বাজায়।

মিষ্টি সুরে নানা কথায় বিলাপ করে কাঁদে সে। কেঁদে কেঁদে বলে-‘প্রিয় বাবা, আপনার মেয়ে আপনাকে মিস করছে। আপনি আমাদের মাঝে ফিরে আসুন। প্লিজ,প্লিজ, প্লিজ।’

লিউ জানায় সে তার ইচ্ছে মাফিক কান্নার কাজটি করতে পারে। তার দীর্ঘ আখি পল্লব নেড়ে, গালে টোল ফেলে মিষ্টি কণ্ঠের লিউ জানায়, ‘আমাকে অনেক অন্তোষ্টিক্রিয়ায় যেতে হয়। যেখানে যাই তাদেরকে নিজের পরিবার বলে ভাবি। তখন কান্নার কাজটা সহজ হয়ে যায়।’

বয়সের তুলনায় বেশ ছোট দেখায় ত্রিশ বছরের লিউকে। তার বাড়িতে আমার সঙ্গে যখন কথা বলছিলো তখন তার পরনে ছিলো কমলা রংয়ের জগিং পোশাক। নখগুলোতে জ্বলজ্বল করছিলো গ্লিটারিং নেইল পলিশ। এসময় আমার কাছে তাকে কাঁদুনে নয়, বরং নার্সারি স্কুলের শিক্ষক বলে মনে হয়।

তবে লিউর দীর্ঘদিনের সহকারী লিন ঝেনঝাং মনে করেন এ পেশায় সাফল্য পেতে লিউর শারীরিক সৌন্দর্য অনেক ভূমিকা রেখেছে।

তিনি বলেন, ‘ঐতিহ্যগতভাবে আমি মনে করি এ পেশাটি মেয়েদের জন্য অনেকটা পুরনো ধরনের। তবে লিউ এখনও তরুণী আর সুন্দরী। এ দুটো কারণে অতি সহজে সে লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।’

লিউর দাদি আর মা দুজনেই ছিলেন পেশাদার কাঁদুনি।

ছোটবেলায় তার মা যখন কোন অন্ত্যষ্টিক্রিয়ায় কাঁদতে যেতো সে তখন শোকার্ত পরিবারের বাইরে খেলতো। আর বাড়িতে ফিরে মা আর বড় বোনের কান্না নকল করে দেখাতো। ‘আমি যে কোন কিছুকে মাইক্রোফোন বানাতাম। ভেবে নিতাম সামনে একটা কফিন আছে যাকে জড়িয়ে আমি কাঁদছি।’

ছোটবেলায় বাব মাকে হারিয়ে দাদির কাছে বেড়ে ওঠে লিউ। তাদের তিন ভাইবোনকে মানুষ করার পাশাপাশি অনেক দেনা ছিলো তার দাদির। তাই সে লিউ ও তার দু ভাইকে পরিবারের পুরনো পেশায় ঠেলে দেন।

লিউ যখন এ পেশায় আসে তখন সে এগার বছরের শিশু। কান্নার মহড়ার জন্য খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হতো তাকে। এ জন্য প্রায়ই স্কুলের পড়া তৈরি করার সময় পেতো না। স্কুলে সহপাঠীরা তার অদ্ভূত পোষাক আর পেশা নিয়ে খুব খেপাতো।

সে সব দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিউ বলেন, ‘কী যে ভয়াবহ ছিলো সে দিনগুলো। খুব হীনমন্যতায় ভুগতাম আমি। ভাবতাম অন্যরা আমাকে পছন্দ করে না।’

আর কান্না করাটাও খুব সহজ ছিলো না এতটুকুন মেয়ের জন্য। মৃতের বাড়ির লোকজনও কিন্তু কাদুনেদের নিচু দৃষ্টিতে দেখতো।

তবে লিউ এখন তার পেশার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে। তার মতে কাজটা মানুষের রাগ কমাতে সাহায্য করে। তারা প্রকাশ্যে যেসব কথা বলতে ভয় পেতো সেগুলো বলতে পারে। যারা কাদতে ভয় পায় তাদের কান্নায় সাহায্য করে। কারণ সবাই দলবেঁধে কাঁদে।

তার দাদি বলেন, লিউকে এ পেশার জন্য তৈরি করতে অনেক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আর এ ব্যবসায় এখন নানা দক্ষতা অর্জন করেছে সে। দরিদ্র পরিবারটিতে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছে। এখন একটি কান্না অনুষ্ঠান থেকে লিউ ও তার কোম্পানি ৬শ মার্কিন ডলার আয় করে থাকে।

তবে তাইওয়ানে আশি দশক থেকে কান্না ব্যবসার পসার কমতে শুরু করেছে। আর্থিক অস্বচ্ছলতা আর আধুনিকতার কারণে তাইওয়ানের পরিবারগুলো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কান্নাকাটির প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে। এ কারণে সেখানকার কাঁদুনেরা এখন বিকল্প পেশার দিকে ঝুঁকছে।

তবে বুদ্ধিমতী লিউর কথা ভিন্ন। এ পেশায় টিকে থাকতে সে এতে নানা বৈচিত্র্য যোগ করছে। ইতিমধ্যে সে ২০ জন সুন্দরী মেয়েকে সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। সাদা কালো পোষাক পরিহিত এসব মেয়েরা যখন অন্ত্যষ্টিক্রিয়ায় লিউর সঙ্গে বসে কাঁদে তখন তাদের প্রতি উপস্থিত দর্শকদের আগ্রহ তৈরি হয়।

উচ্ছ্বসিত হয়ে লিউ বলেন, ‘তাইওয়ানের উত্তরাঞ্চলে এর আগে কেউ এ রকম করেনি। ফলে আমার কল্পনার চেয়েও সফলভাবে শেষ হয় কান্নার অনুষ্ঠানগুলো। আমি জানি এ পেশায় টিকে থাকতে হলে আমাকে আরো অনেক নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করতে হবে।’

তাই যত বাঁধাই আসুক এ পেশা ছাড়ছেন না লিউ। ‘আমাকে একজন দক্ষ কাঁদুনে হিসেবে গড়ে তুলতে আমার দিদিমা অনেক সংগ্রাম করেছেন। তিনি আমাকে যা শিখিয়েছেন আমি তা অন্যদের শেখাতে চাই। আমি তার ঐতিহ্য বহন করে যাবো।’


Click This Link
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×