somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চলে গেলেন নির্মল সেন।। রেজা ঘটক

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানলেন বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ, ব্রিটিশিবেরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সাংবাদিক, বামরাজনীতিবিদ নির্মল সেন। আজ সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে তিনি পরলোক গমন করেন। গত বেশ কিছু দিন তিনি অসুস্থ ছিলেন। ২৪শে ডিসেম্বর ফুসফুসের সংক্রমণ নিয়ে তিনি ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি
হন। সেখানে তিনি স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ সিরাজুল হকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২৬শে ডিসেম্বর থেকে তিনি লাইফ সাপোর্ট নিয়ে বেঁচে ছিলেন। ল্যাবএইডের চিকিৎসক ড. কাজী নাজমুল ইসলাম জানান, তাঁর ফুসফুসে যে ইনফেকশন ছিল তা রক্তের ভেতর দিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল। মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় এটাকে বলা হয় সেপটিসেমিয়া। আজ সন্ধ্যা সাড়ে ছয় টায় নির্মল সেনের লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়। মৃত্যুকালে অকৃতদার নির্মল সেনের বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
১৯৩০ সালের ৩ অগাস্ট গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার দীঘিরপাড় গ্রামে নির্মল সেন জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ছিলেন স্কুল শিক্ষক। মা লাবণ্য প্রভা সেনগুপ্ত ছিলেন গৃহিনী। মা-বাবার নয় সন্তানের মধ্যে (৬ ভাই ৩ বোন) নির্মল সেন ছিলেন চতুর্থ। স্কুলে তাঁর নাম ছিল নির্মল কুমার সেনগুপ্ত। দীঘিরপাড় গ্রামের বাড়ির পাঠশালাতে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু। এরপর কোটালীপাড়ার প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইন্সটিটিউশানে ৪র্থ শ্রেণীতে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতি এম-ই স্কুলে ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। সেখান থেকে চলে যান বরিশাল জেলার বাখেরগঞ্জের কলসকাঠি গ্রামে তাঁর পিসির বাড়িতে। ভর্তি হন কলসকাঠি বিএম একাডেমিতে। ১৯৪২ সালে সারা ভারত জুড়ে যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় তার ঢেউ তখন লাগে কলসকাঠিতেও। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ছাত্র নির্মল সেন জড়িয়ে পড়েন আন্দোলনে। ওই বিদ্যালয় থেকেই মূলত তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি। ১৯৪৪ সালে কলসকাঠি বিএম একাডেমি থেকে প্রবেশিকা (এসএসসি) পাশ করেন। তারপর আইএসসিতে ভর্তি হন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে। এই সময় তৎকালীন বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল রেভ্যুলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি বা আরএসপির রাজনৈতিক মতাদর্শে তিনি দীক্ষিত হন। হয়ে ওঠেন পুরোপুরি রাজনীতির মানুষ। তখন পরিচয় ঘটে আজকের বিখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ও এবিএম মূসার সাথে। ১৯৪৬ সালে নির্মল সেন আইএসসি পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে মা ভাইবোন সবাই চলে যান ভারতে। নির্মল সেন থেকে যান। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৮ সালে বিএসসি পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে রাজবন্দি হিসেবে গ্রেফতার হন। ৪ বছর জেলে থাকার পর ১৯৫৩ সালে ছাড়া পান । পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে জেলখানায় বসে পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাশ করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন।
খুব তরুণ বয়সে নির্মল সেনের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয় কর্মী। বিএম কলেজের ছাত্রাবস্থায় তিনি ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন `অনুশীলন সমিতি'র সক্রিয় সদস্য হন। পরবর্তীতে যোগ দেন রেভ্যুলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি বা সংক্ষেপে আরএসপি'তে। ১৯৫৯ সালে নির্মল সেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যোগ দেন। সেই থেকে তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু। এরপর তিনি দৈনিক আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক বাংলায়ও কাজ করেছেন। দৈনিক বাংলা বিলুপ্তির পর বেতন-ভাতা ও পাওনা আদায়ের জন্যে তিনি অনশন করেছিলেন। নির্মল সেন ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এছাড়া তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অতিথি শিক্ষক ছিলেন। দীর্ঘদিন শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের নেতৃত্ব দেন নির্মল সেন। পরবর্তীতে দলটি গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টিতে একীভূত হলে নির্মল সেন নতুন দলটির সভাপতি হন।
এর আগে ২০০৩ সালে নির্মল সেন একবার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে আক্রান্ত হন। তখন তিনি দেশে ও বিদেশে চিকিৎসা নেন। তার পর থেকেই তিনি কোটালীপাড়ার দীঘিরগ্রামে নিজের বাড়িতেই বসবাস করতেন। ডিসেম্বর মাসে তিনি অসুস্থ হলে ২৪ তারিখ তাঁকে ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি তরা হয়। অসুস্থ অবস্থার মধ্যেও কয়েক মাস আগে ঢাকায় সাংবাদিকদের এক কর্মসূচিতে সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে নির্মল সেন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্যে তাগিদ দেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানের আইউব খানের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ৬৯ এর-গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ, জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সহ গণমানুষের সকল আন্দোলন সংগ্রামেই নির্মল সেন সামনের সারিতে ছিলেন। দেশে আইন বহির্ভুত হত্যার বিরুদ্ধে নির্মল সেনের কলম ছিল সদা জাগ্রত। সরকারের কাছে তখন তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখা ও বক্তৃতায় স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়েছিলেন।
বর্ষিয়ান এই বামরাজনীতিবিদ, সাংবাদিক সমাজের অগ্রণী নেতা, নির্ভীক কলামিস্ট নির্মল সেনের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন শোক প্রকাশ করেছেন। নির্মল সেনের বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বইগুলো হল `মানুষ সমাজ রাষ্ট্র', `বার্লিন থেকে মস্কো', `পূর্ববঙ্গ-পূর্বপাকিস্তান-বাংলাদেশ', `মা জন্মভূমি', `লেনিন থেকে গর্ভাচেভ', `আমার জবানবন্দী', `স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই', `আমার জীবনে ৭১ এর যুদ্ধ' ইত্যাদি। নির্মল সেনের মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারালো এক দুঃসাহসী যোদ্ধা নির্ভীক বিপ্লবীকে। যতোদিন দেশে গণ-মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন থাকবে ততোদিন নির্মল সেন মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। জয়তু নির্মল সেন। বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।







সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:২২
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

টুইস্টেড মাইন্ড অফ আ সিরিয়াল কিলারঃ কবি কালিদাস স্পেশাল

লিখেছেন এইচ তালুকদার, ২৭ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে আমার আগ্রহ শুরু হয় এই ব্লগেরই একজন অসাধারন ব্লগার ''ডক্টর এক্স'' এর লেখা পড়তে যেয়ে। বাংলা ভাষায় সাইকোলজির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেলফ হেল্প ধরনের অসাধারন কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিলিস্তিনে কী শান্তি সম্ভব!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৭ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:২১

এক.
প্রতিদিন ঘুমানোর আগে আলজাজিরা দেখি৷ গাজার যুদ্ধ দেখি৷ রক্ত দেখি৷ লাল লাল৷ ছোপ ছোপ৷ সদ্য জন্মানো শিশুর৷ নারীর৷ কিশোর কিশোরীর৷ বৃদ্ধের৷ সারি সারি লাশ৷ সাদা কাফনে মোড়ানো৷ ভবনে চাপা পড়া৷... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রাকৃতিক দূর্যোগে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫

আমার জীবনে আমি সরাসরি প্রাকৃতিক দূর্যোগের ভেতরে পড়েছি বলে আমার মনে পড়ে না । ২০১৯ সালের ঘটনা। ঘূর্ণিঝড়ের নাম সেবার ছিল সম্ভবত বুলবুল ! সেটা যখন আসছিল তখন আমি ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

উপকূলের ভাই-বোনদের প্রতি গভীর সমবেদনা

লিখেছেন বিষাদ সময়, ২৭ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৭




আমরা ঢাকার পাকা দালানে বসে যখন আয়েস করে চায়ে চুমুক দিয়ে বৃষ্টি বিলাসে বিভোর, ঠিক সেই সময় আমাদের উপকূেলের ভাই-বোনেরা হয়তো কেউ স্বজন, কেউ ঘর, কেউ ফসল, কেউবা গবাদী... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা: অশ্লীলতা কি পোশাক দিয়ে নির্ধারণ করা উচিৎ নাকি মানসিকতা ও চরিত্র দিয়ে?

লিখেছেন লেখার খাতা, ২৭ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫২


ছবিটি -ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

কহিনুরের, ফ্লোরা ওরিয়েন্টাল বিউটি সোপ।১৯৭৮ সালের বিজ্ঞাপন। ছবিটি ফেসবুকে পেয়েছি। ব্লগার সোনাগাজী, ব্লগার কামাল ১৮ সহ যারা মুরুব্বি ব্লগার রয়েছেন তারা হয়তো এই বিজ্ঞাপনটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×