জাতীয় পার্টি নেতা কাজী জাফর আহমদ ‘নীতির প্রশ্নে’ অটল থাকার কথা বলার পরদিনই তাকে বহিষ্কার করলেন দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
Published : 28 Nov 2013, 12:42 PM
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বারিধারায় সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময়ে তিনি বলেন, জাফর একের পর এক আমার বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট দিয়ে যাচ্ছেন। দলের শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করে যাচ্ছেন।
“আমি তার বহিষ্কার আদেশে সই করে এসেছি। তাকে ইতোমধ্যে পাঠিয়েও দেয়া হয়েছে। তিনি আর দলে নেই।
“আমাকে তিনি হুমকি দিয়েছিলেন, প্যান্ডোরার বাক্স খুলবেন। এখন তিনি তার প্যান্ডোরার বাক্স সাথে করে যেখানে, যে দলে খুশি যেতে পারেন। তাকে আমাদের আর প্রয়োজন নেই।”
জাতীয় পার্টি শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নেয়ায় গত ২৩ নভেম্বর এক বিবৃতিতে এরশাদকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর।
তখনই জাফরকে দল থেকে বহিষ্কারের গুঞ্জন উঠলেও তা নাকচ করে এরশাদ সে সময় বলেন, ‘অভিমানী’ কোনো বক্তব্যের কারণে তিনি শাস্তি দেবেন না। জাফর জাতীয় পার্টির সঙ্গেই থাকবেন।
ওই বিবৃতি আসলেই জাফরের কি-না তা নিয়েও সে সময় সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এরশাদ।
সাবেক এই সামরিকশাসক ২৪ নভেম্বর বলেন, “আমরা তাকে ছাড়তে চাই না। সে (কাজি জাফর) এই বিবৃতি দিলেও আমাদের সঙ্গে আছে, না দিলেও আমাদের সঙ্গে আছে। সবাইকে নিয়েই জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় যেতে চায়।”
কিন্তু এরপরও নিজের অবস্থানে অটল থাকেন কাজী জাফর। বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, প্রেসিডিয়ামের অধিকাংশ সদস্যকে অবহিত না করেই এরশাদ সর্বদলীয় সরকারে যোগ দেয়ার এবং নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
সাবেক এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জাফর বলেন, “পার্টির সর্বোচ্চ ফোরাম প্রেসিডিয়ামের সদস্য হিসেবে তার (এরশাদ) এই অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা ছিল আমার দায়িত্ব। আমি তা করেছি।”
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ‘চিকিৎসাধীন’ এই রাজনীতিক বলেন, “প্রতিটি মানুষের কিছু মৌলিক নীতি থাকে, যেগুলোর সঙ্গে আপস করা যায় না। আমি যখন বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম, আমার পিতা সেটা মেনে নেননি। তখন আমি আমার পিতার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করেছিলাম। নীতির প্রশ্নে আমি কখনো আপস করিনি, করব না। আমি আমার অবস্থানে অনড় থাকব।”
তার ওই ‘অনড়’ থাকার ঘোষণার পরই ‘শাস্তি না দেয়ার’ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেন এরশাদ।
সাংবাদিকদের সঙ্গে মত বিনিময়ে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “অসুস্থতার সময় আমি ৩০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। তিনি তখন বলেছিলেন, আমি তাকে জীবন দিয়েছি, তিনি চিরকাল আমার সঙ্গে থাকবেন। তিনি সেই কথা রাখলেন না।”
কাজী জাফর ‘মিথ্যাচার’ করেছেন বলেও অভিযোগ করেন এরশাদ।
“গতকাল বিডিনিউজে দেখলাম, এক সাক্ষাতকারে সে (জাফর) বলছে আমি তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম বিএনপির সাথে নিগোশিয়েট করার জন্য- এটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। তার সাথে আমার এ সম্পর্কিত কোনো কথাই হয়নি।”
বিএনপির সঙ্গে ‘নিগোশিয়েট’ করার প্রয়োজন হলে জাতীয় পার্টির প্রধান হিসাবে তিনি নিজেই তা করতেন বলেও এরশাদ মন্তব্য করেন।
১৯৩৯ সালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে জন্মগ্রহণকারী জাফর পড়ালেখা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে।
ছাত্রজীবনে ‘পিকিংপন্থী’ ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির পর ১৯৬৬ সালে তিনি ‘চীনপন্থী’ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন।
টঙ্গীর শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক রাজনীতিতে জড়িয়ে শ্রমিকনেতা হিসেবে পরিচয় গড়ে ওঠে তার।
স্বাধীনতার পর তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং পরে পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন।
১৯৭৪ সালে তিনি ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন চীনপন্থী কমিউনিস্টদের সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস পার্টিতে (ইউপিপি) যোগ দেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকারে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন ইউপিপির সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর।
জেনারেল জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর আরেক সামরিক অভ্যুত্থানে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সরকারকে হটিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক ফরমান জারি করে ক্ষমতা নেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ।
সে সময় বিএনপি ঘুরে আসা কাজী জাফর আবার ইউপিপি পুনর্গঠন করেন। তবে এর কিছুদিন পর ইউপিপি বিলুপ্ত করে যোগ দেন এরশাদের সরকারে। ১৯৮৯-৯০ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন তিনি।