আজ নিশ্চয়ই এই খবর টি কম-বেশি সবাই দেখেছেন।
দুটি দশ তলা একটি ছয় তলা ভবনে প্রায় ২০০০০ শ্রমিক কাজ করত। কাল থেকে অনির্দিষ্ট কাল ফ্যাক্টরি বন্ধ, অনেকেই বাক্স-পেঁটরা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছেন, আবার অনেকেই ছবির এই মানুস টির মতো অঝোরে কাঁদছেন, কারন সবার সামনেই এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ .....
সন্তানতুল্য শ্রমিকরাই নিঃস্ব করে দিল
এলাকার গরিব মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে প্রকৌশল পেশা ছেড়ে পোশাক ব্যবসায় নামেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসাইন। নিয়ম মেনেই কারখানা গড়েন, এলাকার গরিবদেরই চাকরি দেন। ‘সন্তানের মতো’ শ্রমিকদের বেতন-ভাতার
বাইরেও দিতেন নানা সুবিধা। সেই শ্রমিকদের দেওয়া আগুনে সর্বস্বান্ত হলেন তিনি। স্রেফ গুজবের আগুনে কারখানাই পুড়ল না, ছাই হয়ে গেল মোশাররফের দীর্ঘদিনের স্বপ্নও।
কোনাবাড়ীর কারখানায় শ্রমিক ছিল ১৮ হাজার ৮০০ জনের মতো। এদেরসহ মোট ২২ কারখানার ৫০ হাজার শ্রমিকের জীবিকার জোগানদাতা স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোশাররফ হোসাইন কান্নাভেজা গলায় কালের কণ্ঠকে বললেন, ‘আমি শ্রমিকদের কখনোই শ্রমিক বা কর্মী বলতাম না। সহকর্মী বলতাম। তাদের বেশির ভাগই আমার এলাকা সিরাজগঞ্জের কাজীপাড়া এলাকার। নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসতাম ওদের। বেতন-ভাতার বাইরেও দিতাম নানা সুবিধা। বহিরাগত সোয়েটার কারখানার শ্রমিকদের ইন্ধন আর গুজবে সন্তানতুল্য শ্রমিকদের দেওয়া আগুনে আমি সর্বস্বান্ত হলাম। এই কষ্ট, এই ব্যথা বোঝানোর নয়। ওপরে আল্লাহ সবই দেখছেন।’
মোশাররফ হোসাইন বলেন, ‘আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। ১০ কোটি, ৫০ কোটি বা ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হলে আমি তা মেনে নিতে পারতাম। আমার পুরো কম্পানিই ধ্বংস হয়ে গেছে। ছাই হয়ে গেছে আমার ৯০০ কোটি টাকার সম্পদ। আরো ২২টি কারখানা থাকলেও কোনাবাড়ীর কারখানাটিই ছিল সবগুলোর মূল কেন্দ্র। সব কারখানার জন্য আমদানি করা ফেব্রিকসও রাখা হতো কোনাবাড়ীর ওই কারখানা ভবনের গুদামে। আবার বিদেশে রপ্তানির জন্য অন্য কারখানায় তৈরি হওয়া পোশাকও আনা হতো কোনাবাড়ীর কারখানায়। সেই কারখানাটি অঙ্গার করে আমার ব্যবসাই পুরোপুরি পথে বসিয়ে দিল ওরা।’
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মালিক বলেন, ‘আমার কারখানার আশপাশের সোয়েটার কারখানার শ্রমিকরা কিছুদিন ধরে আন্দোলন করছিল। ওই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য তারা আমার শ্রমিকদের ডাকলেও যায়নি। ফলে বহিরাগত শ্রমিকরা আমার কারখানায় ঢিল মারত। এ অবস্থার মধ্যে আমার শ্রমিকদের ১৫ দিনের ছুটি দিয়ে দিই। দুই দিন আগে আমি কারখানাটি চালু করেছি। কারখানা চালুর দিন আমি নিজে গিয়ে শ্রমিকদের বলেছি, তোমরা মনোযোগ দিয়ে কাজ করো। সরকার যে মজুরি কাঠামো দিয়েছে, সেইমতো ডিসেম্বর থেকে তোমাদের বেতন-ভাতা বাড়াব। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে আশপাশের সোয়েটার কারখানার শ্রমিকরা আবারও আমার কারখানায় ঢিল ছুড়তে থাকে। তখন শিল্প পুলিশ আমার কারখানার ভেতরে ছিল। একপর্যায়ে বহিরাগত শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে উঠলে পুলিশ রাবার বুলেট ছোড়ে। তাতে আমার কারখানার এক শ্রমিক আহত হয়। তাকে প্রথমে থানায় ও পরে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়।’
‘ওই অবস্থায় বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় আমার কারখানার শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। শ্রমিকরা বাড়ি চলে যায়। ওই সময় অন্য সোয়েটার কারখানার শ্রমিকরা হঠাৎ করেই পাশের মসজিদের মাইকে প্রচার চালায়, পুলিশের গুলিতে দুজন শ্রমিক মারা গেছে। এ খবর শুনে আমার কারখানার শ্রমিকরাও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এ সময় শিল্প পুলিশ কারখানার বাইরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনছিল। হঠাৎ করেই কিছু শ্রমিক কারখানায় ঢুকে মূল গেট ভেতর থেকে আটকে দেয়। ফলে পুলিশ আর তখন ভেতরে ঢুকতে পারেনি। শ্রমিকরা প্রথমেই কারখানার নিচে থাকা পোশাকভর্তি ১৮টি কাভার্ড ভ্যানে আগুন দেয়। মুহূর্তের মধ্যেই আমার পুরো কারখানা ভবনটিও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিল তারা’, ক্রন্দনরত অবস্থায় বলতে থাকেন মোশাররফ হোসাইন।
কারখানার আগুনে যতটা দগ্ধ মালিক, এর চেয়েও বেশি ক্ষতের আশঙ্কা মোশাররফের সামনে। তিনি বলেন, ‘সরকার আমার কারখানা রক্ষা করতে পারল না। আগুনে যে আমার ৯০০ কোটি টাকার ক্ষতি হলো, এই টাকা তো ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া। এখন এই ঋণ পরিশোধ করব কিভাবে? ঋণের সুদই বা দেব কিভাবে? কারখানাটি বীমা করা হলেও এর সুবিধার পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় নগণ্য। সরকারের কাছে অনুরোধ- ঋণের আসল মাফ না করলেও অন্তত সুদ মাফ করলে আমি কিছুটা রক্ষা পাব। না হলে আমার আর কোনো গতি থাকবে না।’
যে শ্রমিকদের আগুনে কারখানা ছাই হলো, সেই শ্রমিকদের কল্যাণে অনেক কিছুই করার চেষ্টা করেছেন মালিক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসাইন। তিনি বলেন, কেনো শ্রমিকের স্বজন মারা গেলে তার দাফন-কাফনের খরচ কারখানা বহন করত। গরিব শ্রমিকদের সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থাও ছিল। সব কারখানাতেই মেডিক্যাল সেন্টার আছে। সেখানে ডাক্তার, নার্স, ওষুধ- সবই বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। গর্ভবতী শ্রমিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও আছে। শ্রমিকদের জন্য সব কারখানায় সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুল্যান্স মোতায়েন রাখা আছে। প্রতি ঈদেই শ্রমিকদের বোনাস দিই। মাসের প্রথম সপ্তাহেই বেতন দিই।
স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোতে পোশাক রপ্তানি করে জানিয়ে মোশাররফ হোসাইন বলেন, ‘গত বছরও আমার কারখানা থেকে ৩০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি হয়েছে। শতভাগ কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলোতে কখনোই বেতন-ভাতা বা অন্য কোনো কারণে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু কোনাবাড়ীতে একসঙ্গে দুটি বড় কারখানা ভবনের মূলটিই অকারণে ছাই করে দেওয়া হলো।
সৌজন্যঃ বাংলা নিউজ ২৪
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪৬