somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুরআনের আলোকে বাকস্বাধীনতা

৩০ শে নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ৭:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাকস্বাধীনতা মৌলিক মানবাধিকার। মানুষকে চিন্তাশীল জীব হিসেবে মর্যাদা দেয়ার ক্ষেত্রে যেমন বাকস্বাধীনতার প্রয়োজন আছে তেমনি ভিন্নমতামত উপস্থাপনের মাধ্যমে মানুষের তথ্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতেও বাক-স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। মানবীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত কোন ধর্মই বাক-স্বাধীনতা বিরোধী হতে পারে না।

কুরআন অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মানুষের বাকস্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে। ইহুদি, খ্রিষ্টান কিংবা অন্য কোন ধর্মাবলম্বীদেরকেও তাদের দাবির পক্ষে যুক্তি ও প্রমাণ উপস্থাপনের অধিকার দেয়া হয়েছে। কুরআন বলছে - “তারা বলে, ‘ইহুদি ও খ্রিষ্টান ব্যতীত কেউ কখনও জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ এ তাদের মিথ্যা আশা। বলো, ‘যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তবে প্রমাণ উপস্থিত করো।’ (২ সুরা বাকারা : ১১১)।

ইসলামের বিরুদ্ধে কেউ বক্তব্য দিলেও এমন পাল্টা বক্তব্য দেয়া যাবে না যাতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় কিংবা শাস্তিদানের ক্ষমতা থাকলেও শাস্তি দেয়া যাবে না কিংবা তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা যাবে না। কুরআন সাবধান করে দিচ্ছে - “স্মরণ করো যখন তোমাদের কাছ থেকে আমি এই অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা কেউ কারও রক্তপাত করবে না ও নিজেদের লোকজনকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে না। (২ সুরা বাকারা : ৮৪)।

মুসলিম মাত্রই আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী। মুসলিম জানেন এক ব্যতীত আর কিছু নেই। সর্বাবস্থায় এক-এ থাকাই মুসলিমের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা। যদি কেউ তাঁকে ব্যতীত অন্য কাউকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে কুরআনিক মুসলিম ক্রোধান্বিত হবে না। কারণ তিনি জানেন, মানুষের কোন ক্ষমতা নেই আসমান ও জমিনের মালিক সর্বশক্তিমানকে অবমাননা করে। তাই মুসলিম কুরআন মেনে এমন ব্যক্তিকে স্বপক্ষে বক্তব্য ও প্রমাণ উপস্থাপনের সুযোগ দেয়। মহান প্রভুর আদেশ - “ওরা কি তাঁকে ছাড়া অন্য উপাস্য গ্রহণ করেছে? বলো, ‘তোমরা প্রমাণ উপস্থিত করো।’ (২১ সুরা আম্বিয়া : ২৪)। “তবে কি তোমরা উপদেশ নেবে না? নাকি তোমাদের কাছে কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে? তোমরা যদি সত্য কথা বল তবে তোমাদের কিতাব নিয়ে এসো”। (৩৭ সুরা সাফ্‌ফাত : ১৫৫-১৫৭)।

এমনকি শেষ বিচারের দিন যেদিন কোন যুক্তি তর্ক ব্যতীতই মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেকের বিচার করতে পারেন এবং সত্য-মিথ্যা সকলের সামনে উপস্থিত করতে পারেন সেদিনও আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক সমপ্রদায় থেকে একজন সাক্ষী দাঁড় করাবেন এবং তাকে প্রমাণ উপস্থাপনের সুযোগ দেবেন (২৮ সুরা কাসাস : ৭৫)।

কুরআন বাকস্বাধীনতার পক্ষে কিন্তু বাকস্বাধীনতার নামে হিংসা, বিদ্বেষ কিংবা সামপ্রদায়িক উস্কানির পক্ষে নয়। মহান প্রভু বিশৃঙ্খলা ও ফেৎনা ফ্যাসাদ পছন্দ করেন না। তাই কুরআনে সত্যানুসন্ধানের যে কোন প্রয়াসকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু সত্যানুসন্ধানের বদলে বাদানুবাদের মাধ্যমে নিজের কৃতিত্বকে জাহির করার চেষ্টাকে আল্লাহ তায়ালা ধিক্কার দিয়েছেন। গোঁয়ার্তুমিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা কোনো বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন, স্বীয় মতকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য যারা ভ্রান্তযুক্তির আশ্রয় নেন, তাদের বিষয়ে সুরা বাকারার ২০৪ ও ২০৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যাদের পার্থিব জীবনের কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করবে। আর তারা নিজেদের মনের কথার ব্যাপারে আল্লাহকে সাক্ষ্য স্থির করে। আসলে তারা (সত্যের) জঘন্যতম শত্রু। আর যখন তারা ফিরে যায় তখন প্রচেষ্টা চালায় যাতে সেখানে অকল্যাণ সৃষ্টি এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবন ধ্বংস করতে পারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা পছন্দ করেন না।”

এ আয়াতে তিন ধরনের বাদানুবাদের নিন্দা করা হয়েছে। ১. ‘মিরা’ অর্থ কারও বক্তব্য শুধু ভাষাগত ত্রুটি দেখিয়ে অমত করা। এর উদ্দেশ্য বক্তাকে তুচ্ছ এবং নিজেকে উত্তম প্রমাণ করা। ২. ‘জিদাল’ অর্থ ভিন্নমত প্রকাশ করা এবং স্বীয় মতকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য সচেষ্ট হওয়া। জিদাল বা ভিন্ন মত পোষণ ন্যায়ের কিংবা অন্যায়ের পক্ষে, দুই ধরনেই হতে পারে। ৩. ‘খুসুমাত’ অর্থ জোরালোভাবে অযৌক্তিক দাবি উপস্থাপন করা। এর লক্ষ্য হচ্ছে, অর্থ-সম্পদ বা অন্য কোন স্বার্থ হাসিল করা। কখনো কখনো উপযাচক হয়ে এ বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়। আবার কখনোবা অন্যের কথার রেশ ধরে বিতর্ক বাধানো হয়। ‘মিরা’ কখনো নিজে উপযাচক হয়ে করা হয় না, কোনো বক্তব্যের সূত্র ধরেই করা হয়। আর শেষের দুটি কারও কোনো কথার আগে উপযাচক হয়েও করা যায়, আবার পরেও করা যায়। এ তিন ধরনের বিতর্কের প্রতিটির উদ্দেশ্যই খারাপ ও গর্হিত।

মানুষ ধর্মে বর্ণে যত ভিন্নই হোক না কেন সকলেই এক আল্লাহর সৃষ্টি। মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ থেকে শান্তিতে থাকার জন্যই আল্লাহপাক যুগে যুগে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। মানুষে মানুষে কোনও ভেদাভেদ নেই। তাই একজন মানুষ যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন মানুষ হিসেবে সবাই একই সম্প্রদায়ভুক্ত। তাই কাউকে অবজ্ঞা করার কোনও সুযোগ নেই। আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে সবাইকে এক ধর্মেরই অনুসারী বানাতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি নিজেই যেহেতু মানুষকে বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত করেছেন, তাই আমাদেরও ভিন্নমত পোষণকারীদের প্রতি মন্দ আচরণ করা ঠিক নয়। মুসলিমের দায়িত্ব হলো উত্তম কৌশল ও সুন্দর যুক্তি দিয়ে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করা। কেউ আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রকাশ করলেও যে নম্রভাবে উত্তর দেয় এবং উত্তেজিতদের শান্ত থাকার জন্য আহ্বান জানায় তারাই কুরআনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে।

প্রত্যেক মুসলিমকে জনসমক্ষে বক্তব্য রাখার সময় বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে যেন এমন কোন কথা না বলে যার ফলে ফ্যাৎনা-ফ্যাসাদের সৃষ্টি হয়। যুক্তিসহকারে নীচু স্বরে কথা বলতে হবে। দ্বীনের নবী (সা.) এমনভাবে কথা বলতেন যেন সবাই অনায়াসে তা শুনতে পায় তিনি আস্তেও বলতেন না আবার উচ্চস্বরেও বলতেন না। প্রয়োজনাতিরিক্ত উচ্চ স্বরে কথা বলা কুরআনে নিষিদ্ধ হয়েছে। কুরআনের আদেশ - “তুমি সংযতভাবে পা ফেলো ও তোমার গলার আওয়াজ নিচু করো; গলার আওয়াজের মধ্যে গর্দভের গলাই সবচেয়ে শ্রুতিকটু”। (৩১:১৯-২০)। নবী (সা.) সর্বদা প্রসন্ন ও হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। তার চরিত্রে ছিল নম্রতা, আচার ব্যবহারে বিনয়। তিনি উচ্চস্বরে কথা বলতেন না এবং কাউকে দোষ দিয়ে বক্তব্য রাখতেন না। কুরআনের আদেশ মতো তিনি অন্যদের দোষত্রুটি উপেক্ষা করতেন। কুরআনের উপদেশ হলো - মূর্খ ধর্মান্ধদের সাথে তর্কে লিপ্ত না হয়ে তাদেরকে উপেক্ষা করাই শ্রেয় (৭ সুরা আরাফ :১৯৯)।

কুরআন মতে, প্রত্যেক মানুষেরই কথা বলার অধিকার আছে, আছে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার। কিন্তু তাই বলে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার ধারণা ফাঁকা, উদ্ভট ও অবাস্তব। প্রত্যেকেরই বাকস্বাধীনতা আছে কিন্তু গালাগালি দেবার, অপমান করার, নিন্দা করার, দোষারূপ করার, উপহাস ও বিদ্রুপ করার, অবমাননা করার কিংবা গর্দভের মতো চিৎকার করার স্বাধীনতা নাই। প্রত্যেকের স্বাধীনতা অন্যের স্বাধীনতাকে হরণ না করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।

১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৩


মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×