সন্ধা বাজারের পাশে ওয়াসার পানির লরি গুলো সারি বেঁধে দাড়িয়ে আছে। তার ফাকে ফাকে ড্রেনের স্লাবের উপর অস্থায়ী চায়ের দোকান। প্রতিদিনের আড্ডায় পরিচিত মুখগুলো এসে জড় হয়েছে। শুধু একজন নেই। তাহের। ওকে ফোন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রচন্ড মাইগ্রেইনের পেইনের দোহাই দিয়ে আসেনি। তবে আসল রহস্যটা বের হল রুবেলের কাছ থেকে। তাহেরের প্রায় সত্তুর হাজার টাকা গ্যাপ পড়েছে কোম্পানিতে।
সবার মুখ হা হয়ে গেল। জাহিদ বলেই ফেললো, ‘স্যার তাহলে আবার ধরা খেয়েছে...!?’
রুবেল ‘হু’ বলতেই সাকিব, জনি ও তাহের প্রায় একসাথে বললো, ‘এখন উপায়...?’
রুবেল এক চুমুক চা মুখে নিয়ে বললো, ‘উপায় আর কি, দিতে হয়েছে...কোম্পানির টাকা, না দিলে চাকরি থাকবে..? শেষে টাকাও দেবে চাকরিও যাবে...’
জনি বললো, ‘পেলো কই এত টাকা..?’
রুবেলের সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘আমি দিলাম...’
সবাই আবার প্রায় এক সাথেই ‘ও..’ বলে এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলো। সাকিব বললো, ‘টাকা ব্যাক দেবে কবে...?’
‘পনেরো দিনের কথা বলেতো নিছে..তাতো ওভার হতে চললো, এখনতো কোন ভাব বুঝতেছিনা..’
জাহিদ উত্সুক হয়ে বললো, ‘আমরা চাইলে তুই নানা প্রবলেম দেখাস..কিন্তু স্যারকে আবার এতগুলো টাকা দিয়ে দিলি..বুঝলাম না...’
‘না সেদিন এসে প্রায় কাঁদ কাঁদ হয়ে বললো..রুবেল তুই একটা ব্যবস্থা কর..তাই...আর তোমরাতো জানো চরম বিপদে বন্ধুদের আমি না বলতে পারিনা।’
হ্যা এটাই ওর অভ্যাস। কিন্তু তাহের যে নিল তার কি হবে..? কি করে এতগুলো টাকা ব্যাক দেবে? এই নিয়ে দুইবার এমন করলো। প্রথমবার কোম্পানির টাকা নিজের কাছে রেখে মোটরবাইক কিনলো, কুয়াকাটা ঘুরতে গেল, পাঁচ টাকার জায়গায় অযথা দশ টাকা খরচ করল, পেট ভারা থাকলেও মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে পিজা, বার্গার, কোক খেল। যেখানে সবাই র’চা খায় সে দুধ চা বা কফি ছাড়া খেত না, সবাই গোল্ডলিফ সিগারেট খেত কিন্তু সে খেত ব্যানসন। সবাই ভেবেছিল তার নিজের টাকায় সে যা ইচ্ছা তাই করে এতে তাদের কি? কিন্তু জুন ক্লোজিং এর সময় বোঝা গেল বন্ধুদের মাঝে তার এই ফিটফাট থাকা নিজের টাকায় নয় বা তার বাপের পয়সায়ও নয়। ওটা কোম্পানির অর্থে! বন্ধুদের ভেতর হাসাহাসি পড়ে গেল। আবার খারাপও লেগেছিল। কিন্তু ভালমন্দ কয়েকটা উপদেশ দেওয়া ছাড়া কারও সামর্থ ছিল না টাকা পরিশোধ করার। বন্ধুরাই বা কেন দেবে। ভাব নেওয়ার সময় সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে দিত, এতে তারা কম কষ্ট পায়নি। সাধে কি আর তারা বন্ধুকে নামে না ডেকে ‘স্যার’ বলে ডাকে!
শেষে কি হল; মোটরবাইক বিক্রি করতে হল। চাকরিটা গেল। এবং তার পরেও যে আশি হাজার টাকা দেনা ছিল তা শোধ করতে তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল! অত টাকা তার পরিবার দিতে পারবেনা। তাই বুদ্ধি করে ছেলের বিয়ে দিতে চাইলেন তাহেরের বাবা-মা। শর্ত, যে মেয়ে আসবে তার বাবার প্রায় লাখ খানেক টাকা দিতে হবে! বন্ধুরা তেমন কেউ জানতো না এই প্লান-প্রোগ্রাম। শুধু রুবেল ও জনিই একটু জানতো অল্প অল্প।
তো হুট করেতো আর বিয়ে হয় না। তাই এমন মেয়ে দেখ যার বাবার ঘাড়ে সে বোঝা হয়ে আছে, বা মেয়ের একটু সমস্যা আছে! টাকা চাই। আগে ছেলের বিপদ ঠেকাতে হবে, পরে ছেলের বৌ এর রূপ-গুণ বিচার করা যাবে! এই শর্তে পেয়েও গেল একটা মেয়ে। ঢাকঢোল পিটিয়ে অবশ্য বিয়েটা হয়েছিল। আচার অনুষ্ঠানের কিছুই বাদ গেলনা, যাতে অন্যেরা টের না পায়। বন্ধুরাও বেশ মজা করে বিয়ে দেখলো।
তখনকার মত বিপদ কেটে গেল। বেশ ভালই দিন কাটছিল। নতুন বৌকে নিয়ে এদিক ওদিক প্রায়ই ঘোরা হত তার। বন্ধুদের আড্ডায় সময় যদিও একটু কমে গিয়েছিল। নতুন একটা চাকরিতে ঢুকলো। খরচ করত চাপিয়ে। সবাই ভাবলো এবার বুঝি স্যারের একটা গতি হয়। কিন্তু কোথায় কি...।
বৌ এর সাথে বনিবনা হল না। ব্যাপারটাও গোপন ছিল বেশ কিছু দিন। পরে এক কান দু কান করে সবাই জেনে গেল। তখন এসে জানালো হাজারটা সমস্যা বৌ এর। সে নাকি পাগল, একা একা রাতে কথা কয়, বাইরে বেরিয়ে হাটে, স্লিপিং পিল খায় সাথে নাকি গুল বা জর্দাও নেয়! কি সব আজগুবি কথা। বৌ রাখা যাবেনা।
বন্ধুদের মধ্য থেকে তখন প্রশ্ন এসেছিল, ‘বৌ রাখা যাবেনা মানে..!?’
‘মা আর ওর সাথে বনতেছে না, প্রতিদিন ঝগড়া হচ্ছে..আগেতো মা...তারপরেতো বৌ, তাই ভাবছি ডিভোর্স দিব...!’
সব শুনে বন্ধুরা বলেছিল না তুমি এটা করো না। এক বিপদ থেকে উদ্ধার হতে বিয়ে করলে এখন ডিভোর্স দিলে দেনমোহরের টাকা দিতে হবে কিন্তু পুরোটা। তুমিতো কানা কড়িও শোধ করো নি...। আবার লাখ টাকা নিয়ে বিয়ে করেছ।
এরপর তার মায়ের কাছে গিয়েও বুঝিয়ে বললো। তার মা শুনলেন বটে তবে বৌ কে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল। তাহেরকেও মানা করে দেওয়া হল যোগাযোগ করতে। এমন অবস্থা যে ফোন নাম্বার পর্যন্ত চেঞ্জ করে ফেললো। এমত অবস্থায় দু মাস হয়ে যেতে বৌ এর বাপের বাড়ির লোকজন দেখলো জামাই বা তার বাড়ির কেউ মেয়েকে নিতে আসছে না, ফোন দিলে ধরে না তখন তাদের একজন এ বাড়িতে আসলো। এবং তাহেরের মা বেটার বৌ এর একগাদা দোষ সামনে উপস্থিত করলেন। এবং সময় হলে বৌ আনা হবে বলে জানালেন। সাথে বলে দিলেন মাসে মাসে খরচ পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু বৌকে আনার কোন আগ্রহ দেখালেন না। ও বাড়ি থেকে ওই ব্যক্তি চলে এসে যথারীতি জামাই এর বন্ধুদের খুঁজে বের করলেন। এবং ভালমন্দ বললেন ও দাওয়াত করে গেলেন। সেই দাওয়াতে জনি ও রুবেল সবার তরফ থেকে গেল। যাবার আগে তাহেরের মা অবশ্য কিছু কথা শিখিয়ে দিয়েছিল। এক গাদা দোষের বর্ণনা দিয়েছিল। কিন্তু ও বাড়িতে গিয়ে সেই কথার সাথে কিছুই মিল খুঁজে পেল না তারা। বরঞ্চ তাহের ও তার মায়ের দোষ প্রকট আকারে ধরা পড়লো। অনেক মান অভিমানের পরে বৌ নিয়ে আসার একটা ফয়সালা হল।
বন্ধুরা ভাবলো এবার বোধ হয় সব সমস্যার সমাধান হয়েছে।
বৃথাই ভাবনা! এক দিন কথায় কথায় তাহের বলে ফেললো গুরুতর একটা ব্যপার। কয়েকদিন ধরে মন খারাপ থাকার পরে সবার চাপাচাপিতে কারণটা জানালো যে, তার মা তাদের দুজনকে রাতে এক সাথে থাকতে দিচ্ছেনা! এমনকি দিনের বেলাও দেখা হয় খুব কম। সকালে সে বেরিয়ে যায় তখন বৌ থাকে ঘুমে, দুপুরে বাসায় গেলে বৌ আন্য রুমে থাকে মায়ের সাথে, আর রাতে গিয়ে দেখে বৌ ছোট বোনের রুমে ঘুমিয়ে গেছে!
এই গুরুতর অভিযোগ সবার অমানবিক মনে হল। এবং সত্যিই দেখা গেল তার বৌ এখন বাপের বাড়িই চলে যেতে চায়! গেলে আর আসতে চায় না। এরাতো না আসলেই বেশি খুশি কিন্তু ও বাড়ি থেকে পাঠাতে চাইলেও মেয়ে আর আসতে চায়না। যে মেয়ে থাকতে চাইতো না আর এখন সে যেতে চাইছে না! চাপাচাপি করাতে কারণটা একদিন সে বলেই দিয়েছিল তার এক ক্লোজ সম্পর্কের মামির কাছে। আর যায় কোথায়...। সাথে সাথে রুবেলের কাছে ফোন। সে-ই গতবার তাদের ঝামেলাটা মিটিয়ে দিয়েছিল। তাই তারা ধরে নিল জামাই এর বাড়ি গেলে সমাধান হবেনা। জামাই এর বন্ধুদের বলতে হবে। যেন এরাই তার গার্জেন! এবং এতে কাজ হল। অনেক বেশি কথা শোনানো হল তাহেরকে। লজ্জার মাথা খেয়ে তার মা বেটার বৌকে নিয়ে আসলেন। এবার আর উনি কোন লাইন পাচ্ছেন না। সংসার ভালই চলছে। একসময় তার ফুটফুটে একটা ছেলে হল। সবাই খুশি।
কিন্তু তাহের আবার আগের মত চলাচল করতে শুরু করলো। বেহুদা খরচ, অতিরিক্ত স্টাইল...। বন্ধুদের বলার কিছু নেই। সবাই ভাবলো একবার যখন শিক্ষা হয়েছে আর এমন বোকামি করবেনা। যা করছে নিজের গাটের পয়সা থেকেই করছে। কিন্তু আজ জানা গেল, সে বদলায় নি। নিজের অর্থে ভাব মারেনি। কোম্পানির টাকায় এবারো গড়মিল বাধিয়েছে। রুবেল এবার পুরোটাই সবার অগোচরে দিয়েছে। কিন্তু অন্য বন্ধুরা জানলে দিতে দিত না। কারণ তার একটা চরম শিক্ষা হওয়া প্রয়োজন। নেড়ে একবার বেলতলায় যায় কিন্তু স্যার গেল দুবার।
আরো একটা চরম হাস্যকর প্লান শোনা হল সেদিন চায়ের দোকানে। স্যার বৌ ছেড়ে দিবে। ছেলেটা নিজের কাছে রাখবে। আর ডিভোর্স লেটার পাঠানোর আগে একটা নোটারি পাবলিক করবে যে, তাকে তার বাবা-মা ত্যাজ্যপুত্র করেছে! তার সাথে নাকি তাদের কোন সম্পর্ক নেই। তার যাবতীয় কাজের দায় তাকেই নিতে হবে।
হায়, কি চমত্কার ডিসিশানরে বাবা! সবাই উত্সুক হয়ে এই নাটকের কারণ জানতে চাইলে জানা গেল এতে নাকি সুবিধা আছে। ডিভোর্সের কাগজ গেলে বৌ বা তার পরিবার মামলা ঠুকে দিতে পারে তাদের বাড়ির সবার নামে। এক্ষেত্রে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষিত থাকলে অন্তত বাবা-মায়ের আর মামলার দায়ে পড়তে হচ্ছে না! কি দারুণ যুক্তি!
এমন ছেলে লাখে একটাও মেলে কিনা সন্দেহ, যে সেধে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষিত হতে চায়। সামনেতো ঘোর অন্ধকার। রুবেলের সত্তুর হাজার টাকা কিভাবে শোধ করবে তার ঠিক নেই ওদিকে বৌ খেদিয়ে মামলা খেলে তাতে আরো কত টাকা যাবে তার ঠিক কি...।
রুবেলও বুঝি এবার আর কোন ছাড় দিবেনা। বলেই দিল, ‘আমার কষ্টের ইনকামের টাকা..একটাকাও বাকি রাখবোনা..তাতে সম্পর্ক থাকলে থাকবে নাহলে যাবে। এত ভাব ভাল লাগেনা। আমি খরচের ভয়ে নিজে তেমন কিছু করি না, বৌ এর আবদার ভালভাবে মিটাইনা..আর আমি বারবার ওর জন্য ঝামেলায় পড়তেছি...।’
বন্ধুরা শুধু শুনলো। ভালমন্দ তেমন কিছু বললো না। তবে আসন্ন একটা গন্ডোগোল যে তাদের মাঝে হবে এটা বুঝতে পারলো। তাই সাকিব বললো, ‘দেখ্ এমনিতে দেয় কিনা..যদি না দেয় তবুও গন্ডোগোল করার দরকার নেই। ওর বাবা-মাকে গিয়ে বলিস।’
রুবেল শুধু বললো, ‘দেখি...’
নিরবতা নেমে এল সবার মাঝে। সত্যিই খারাপ লাগছে তাহেরের জন্য। ছেলেটা বারবার একই ভুল করছে। আসলে এমন কিছু লোক সমজে থাকে যারা তার সাধ্যের সীমা-পরিসীমা না জেনেই অহেতুক খরচ করে ও বিপদে পড়ে। তখন অবশ্য চোঁখের দিকে তাকালে মায়া হয়। কিন্তু দেখা যায় বিপদ কেটে গেলে তারা স্বরূপে ফিরে গেছে। অতীতের সাত-পাঁচ কিছুই মনে নেই বা মনে করতে চায়না। কবে যে এদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে...
শাশ্বত ৩১.১০.১৩