বিরোধী দলের অবরোধের চতুর্থ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে ছয় জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া অবরোধকারীদের ধাওয়ায় ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মারা গেছেন চালক ও তার সহকারী। নিহতের তালিকায় রয়েছেন পেট্রোল বোমায় দগ্ধ এক বৃদ্ধও।
Published : 03 Dec 2013, 05:23 PM
এর মধ্যে সাতক্ষীরায় তিনজন, চাঁদপুরে দুইজন এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম নগরী ও সীতাকুণ্ডে মারা গেছেন আরো চার জন।
বিস্তারিত আমাদের ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
চাঁদপুর
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চাঁদপুরের জে এম সেনগুপ্ত রোড এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আল আমিন মডেল মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সিয়াম হোসেন (১৪) ও চাঁদপুর সরকারি কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. রতন (২১) নিহত হয়।
ঘটনার শুরু সকাল সাড়ে ১০টায়। ১৮ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা শহরের জে এম সেনগুপ্ত রোড এলাকায় বিএনপি কার্যালয় থেকে মিছিল বের করে। মিছিলটি শহরের কালীবাড়ি এলাকা থেকে দলীয় কার্যালয়ের ফেরার সময় জে এম সেনগুপ্ত রোড এলাকায় মিছিলে কয়েকটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটে।
এ সময় পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে। বিক্ষুব্ধ ১৮ দলের নেতা-কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে পাল্টা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। পরিস্থিতি শান্ত করতে পুলিশ রবার বুলেট ও টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। এ সময় দুইজন নিহত হয়।
সিয়াম বুকে ও পিঠে গুলিব্ধি হয়ে এবং রতন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে বলে চাঁদপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসক রুহুল আমিন জানিয়েছেন।
অবশ্য চাঁদপুরের পুলিশ সুপার মো. আমির জাফর দাবি করেন, ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা পুলিশের উপর হামলা চালানোর কারণেই ওই দুইজনের মৃত্যু হয়েছে।
এ ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা বেলা ১১টায় চাঁদপুর-কুমিল্লা সড়কের বাকিলা, দেবপুর, মহামায়াসহ বিভিন্ন স্থানে টায়ার জ্বালিয়ে ও গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ করে। এছাড়া চাঁদপুর শহরের চিত্রলেখা ও স্টেডিয়াম রোডসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সাথে বিএনপি নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে বিএনপির আরো ২০ নেতা-কর্মী আহত হয়।
এদের মধ্যে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি শরীফ মো. ইউনুসসহ (৪৫) অন্তত ৭/৮ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আহতদের মধ্যে গুরুতর আহত আল আমিন (২৫) ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
সাতক্ষীরা
সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার সখিপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দুই শিবিরকর্মী নিহত হয়েছে। এ সময় আহত হন আরো পাঁচজন।
নিহতরা হলেন উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামের রজব আলীর ছেলে হোসেন আলী (১৪) ও একই উপজেলার গরানবাড়িয়া গ্রামের ছফেদ আলীর ছেলে আরিজুল ইসলাম (২০)।
জামায়াত নেতা দাবি করেন, আহত রশিদ মোল্যা ও সাদ্দাম হোসেনের পায়ে ও আব্দুল্লাহ’র পেটে গুলি লেগেছে। তাদেরকে অজ্ঞাত স্থানে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
এদিকে অভিযানে থাকা সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়দেব চৌধূরী সাংবাদিকদের জানান, ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধের প্রথম দিন থেকেই সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়কে গাছের গুঁড়ি, পাকা রাস্তার ওপর ছয় ফুট উঁচু মাটি ফেলে জনসাধারনের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে অবরোধকারীরা। এতে সাতক্ষীরা জেলা সদরের সাথে দেবহাটা উপজেলা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সোমবার গভীররাতে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা রাস্তা পরিস্কারের অভিযানে নামে।
তিনি আরও জানান, অভিযান চলাকালিন সময়ে দেবহাটা উপজেলার সখিপুর ও গরানবাড়িয়া এলাকায় অবরোধকারী জামায়াত-শিবির কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা। এ সময় অবরোধকারীরা যৌথবাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে ককটেল ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে তারা পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করলে ছত্রভঙ্গ করতে যৌথবাহিনী গুলি ছোঁড়ে।
এদিকে শহর জামায়াতের আমির ফখরুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সাতক্ষীরা জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করেছে জামায়াত।
সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি এনামুল হক জানান, আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর কলেজ অধ্যক্ষ জামায়াত নেতা মুজিবর রহমানকে মঙ্গলবার ভোররাতে সদর উপজেলার ভোমরা পোর্ট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জামায়াত নেতা মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে হরতাল ও অবরোধে নাশকতা সৃষ্টিকারীদের মদদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে সাতক্ষীরা জেলা ওলামালীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল ওহাব সদর উপজেলার বাঁশদহা থেকে শহরে আসার পথে আগরদাড়ী ইউনিয়নের মল্লিকপাড়া মোড়ে পৌঁছালে অবরোধকারীরা পিটিয়ে আহত করে।
এছাড়া মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সদর উপজেলার তালবাড়িয়ায় সাতক্ষীরা-ভোমরা সড়কে সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য গিয়াস উদ্দিনকে (৩২) পিটিয়ে হত্যা করে বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা।
তিনি শহরের ইটাগাছি এলাকার মনিরউদ্দিনের ছেলে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
সদর থানার ওসি এনামূল হক জানান, পৌনে ৬টার দিকে গিয়াস ব্যক্তিগত কাজে মোটরসাইকেলে করে ভোমরা স্থলবন্দর যাচ্ছিলেন। পথে তালবাড়ি এলাকায় বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা তার গতিরোধ করে এবং মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে ঘটনাস্থলেই পিটিয়ে হত্যা করে।
সীতাকুণ্ড
সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম জানান, সোমবার গভীর রাতে উপজেলার মান্দরিটোলা এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এ ঘটনা ঘটে।
তিনি বলেন, “ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাণ্ডারিটোলা এলাকায় গাড়ি ভাংচুরের চেষ্টাকালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় রাসেল।”
নিহত শরিফুল ইসলাম রাসেলের (২০) বাড়ি সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নের হাসনাবাদ গ্রামে। তার বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম।
বিএনপি নেতারা বলছেন, শরিফুল স্বেচ্ছাসেবক দলের মুরাদপুর ইউনিয়ন কমিটির সহ সভাপতি ছিলেন।
স্থানীয়রা জানান, রাতে অবরোধকারীরা মহাসড়কে যানবাহনে হামলা চালালে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান শরিফুল।
এ ঘটনার প্রতিবাদে উত্তর চট্টগ্রামে বুধবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে সংগঠনটি।
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামে গভীর রাতে অবরোধকারীদের বোমা হামলার পর কভার্ড ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মারা যায় এক চালক। বিকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চালকের সহকারীও।
বিরোধীদলের অবরোধের তৃতীয় দিন সোমবার রাত পৌনে ২টার দিকে বন্দরনগরীর ইপিজেড থানাধীন সি মেনস হোস্টেল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহত মাহবুব আলমের (২৩) বাড়ি ভোলার চরফ্যাশনে। তার বাবার নাম মো. নুরুন্নবী। অপরজন হলেন মিজানুর রহমান (২০)।
এদিকে পটুয়াখালীতে অবরোধের প্রথম দিনে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ এক বৃদ্ধ তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন।
মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মোজাম্মেল হক জানান, মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে মারা যান মাওলানা আবদুস সাত্তার (৬৫)।
এ নিয়ে বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধের মধ্যে দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে আসা দশ জনের মৃত্যু হলো।
নিহতের ভাতিজা রেজাউল করিম হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, গত শনিবার সন্ধ্যায় পটুয়াখালী সদরের বদরপুর এলাকায় একটি নসিমনে অবরোধকারীদের পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হন সাত্তার।