টানা পাঁচদিন ধরে দফায় দফায় বৈঠকের পর দুই প্রধান দলকে সংলাপে বসিয়ে তা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ঢাকা ছাড়লেন অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকো।
Published : 11 Dec 2013, 05:29 PM
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দুই প্রধান দলের দূরত্ব আরো বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে হরতাল-অবরোধে সহিংসতায় প্রাণহানির মধ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবের দূতের এই সফরকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সঙ্কট এড়াতে শেষ সুযোগ হিসেবে দেখে আসছিলেন কূটনীতিকরা।
চার দিনের সফরকে পাঁচ দিনে দীর্ঘায়িত করার পর ঢাকা ছাড়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে আর্জেন্টাইন এই কূটনীতিক সন্তোষের সুরেই বললেন, দুই দলকে একত্রে বসাতে পারায় নিজেকে ‘সফল’ মনে করছেন তিনি।
তবে সঙ্কট এড়াতে এটা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন ফার্নান্দেজ-তারানকো। সংলাপ এগিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন জানিয়ে তিনি আশা প্রকাশ করছেন, দুই দলের সংলাপ অব্যাহত থাকবে এবং এর মধ্য দিয়েই সমাধানের পথ বের হবে।
সাত মাস আগে সংলাপের তাগিদ দিয়ে যাওয়ার পর শুক্রবার ঢাকায় নেমে পরদিন থেকে অন্তত ২২টি বৈঠক করেন তিনি। শেষ দিনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের কথা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত হয়নি।
এর আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে এক দফা, খালেদা জিয়ার সঙ্গে দুই দফা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে আলাদা বৈঠকের পর মঙ্গলবার দুই পক্ষকে একসঙ্গে নিয়ে প্রথম বৈঠক করেন জাতিসংঘ দূত।
সংবাদ সম্মেলনে ফার্নান্দেজ-তারানকো বলেন, “জাতিসংঘের প্রথম লক্ষ্য ছিল দুটি দলকে আলোচনায় নিয়ে আসা, আমরা তা শুরু করেছি। সমাধান এখনো সম্ভব, তবে তা আসতে হবে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে।”
আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান না হলে পরিণতি কী হতে পারে, তা সবারই বোধগম্য- এই মন্তব্য করে এই সংলাপ টিকিয়ে রাখতে দুই দলের নেতাদের দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করেছেন তিনি।
জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব আশা প্রকাশ করেছেন, তার রচিত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে সংলাপের প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে এবং তার মধ্য দিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের পথ বের করবে দুই দল।
তিনি বর্তমান পরিস্থিতিতে সংঘাত বন্ধ, আটক রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি এবং নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল নিয়ে চলমান উদ্বেগ প্রশমনের ওপর জোর দেন।
দুই দফা আলোচনায় কোন বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে কিংবা বিএনপির বয়কটের মুখে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো কথা বলেননি ফার্নান্দেজ-তারানকো।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে মঙ্গলবার প্রথম দফা আলোচনার পর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার বিষয়ে বৈঠকে মতৈক্য হয়েছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, হরতাল, অবরোধসহ সব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করলেই নির্বাচনকালীন সরকারসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে।
এই সংলাপের পুরোটা সময়জুড়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের ডাকে অবরোধ চলছিল এবং আলোচনার পাশাপাশি কর্মসূচি চালানোর কথা বুধবারও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
দ্বিতীয় দফা বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, সেই বিষয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই দলের কেউই মুখ খোলেনি। জাতিসংঘ দূত কোনো কিছু সুনির্দিষ্ট না করে বলেছেন, এই সংলাপে সব বিষয় নিয়েই ‘গঠনমূলক’ আলোচনা হয়েছে।
সমঝোতার মনোভাব নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে দুই পক্ষকে উৎসাহিত করেছেন জানিয়ে ফার্নান্দেজ-তারানকো বলেন, দুই দলের কাছ থেকে তৃতীয় দফা সংলাপের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার বৈঠকের পর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংলাপের বিষয়ে দুই দলের মতৈক্য হয়েছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বক্তব্য ছিল, হরতাল, অবরোধসহ সব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করলেই নির্বাচনকালীন সরকারসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে।
তারানকোর সংবাদ সম্মেলন যখন হচ্ছিল; সেই সময়ই বিএনপির পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সংলাপের পাশাপাশি আন্দোলনের কর্মসূচিও চলবে।
অন্যদিকে রাতে গণভবনে এই বৈঠকের পর আওয়ামী লীগ নেতা মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত এখনো বহাল; যে নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেয়ার সুযোগ নেই।
তার ঢাকায় অবস্থানের মধ্যেই বিকালে বান কি-মুনের ফোন আসে শেখ হাসিনার কাছে, যাতে সংবিধান অনুসারে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশা তিনি প্রকাশ করেন বলে প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব জানান।
সঙ্কট নিরসনে আশাবাদী ফার্নান্দেজ-তারানকো বাংলাদেশকে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরে তার এই সফরের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন।
সফরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এছাড়া কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন নাগরিক সমাজের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গেও তার আলোচনা হয়। তিনি দেখা করেছেন কূটনীতিকদের সঙ্গেও।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের খুঁটিনাটি বিষয়ও শোনেন তিনি। তবে নির্বাচন যে জাতিসংঘ এখন পর্যবেক্ষণ করে না, যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের তাও বলে গেছেন তিনি।
সফরের সময়ও রাজপথে সংঘাতের সাক্ষী জাতিসংঘ দূত পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। সবাইকে শান্ত থাকতে বলেছেন তিনি; বলেছেন মানবাধিকার রক্ষার কথা, সেই সঙ্গে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার কথাও।
তিনি মনে করেন, সব পক্ষ দায়িত্বশীল আচরণ করলে অস্থিরতার এই পাক থেকে বের হতে পারবে বাংলাদেশ।