somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পতাকা

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

”ধুত্তুরি বালো লাগে না, মা ক্যান যে আমার নাম রাজু রাখলো তা ভাইবা পাই না। ইস্ আমার নামটা বিজয়,,,হুম,,,স্বাধীন রাখলে খুব বালো হইতো। মা কইছে আমার জন্ম নাকি ডিসেম্বর মাসে হইছিল।’ তার চোখে মুখে খুশীর ঝিলিক দিয়ে যায়। রাজু মিরপুর রোড ধরে ধীর পায়ে হাটছে আর মাঝে মাঝে ভাবনার সাগরে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। হাতে ধরা পতাকার লাঠি। পিঠে রয়েছে আরো একটা ব্যাগ। তাতে আরো পতাকা আছে। কেউ কেউ এসে তার নিকট হতে পতাকা নিচ্ছে। খুশীমনে পতাকা বিক্রি করছে।
এবার রাজু ডান হাত দিয়ে চুলগুলো পিছনের দিকে ঠেলে দেয়। পিঠের পতাকার ব্যাগটা আবার ঠিক করে নেয়। ’মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার বয়স নাকি ১৪ বছর আছিল। বাবা নাকি পাকহানাদার আর রাজাকারগো খবর মুক্তিযোদ্ধাগো কইয়া দিত। আর মুক্তিযোদ্ধারা আচ্ছামতো রাজাকার আর পাকীদের প্যাদানী দিত। একবার পাকহানাদাররা ২জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধইরা নিয়া গেল । বাবা দৌড়াইয়া অন্য মুক্তিযোদ্ধাগো খবর কইল। আর হক্কলে আইসা ঢিস,,,ইসসসসস, গুরুরুরুমমম কইরা সব কটা পাকী মাইর‌্যা সাফ কইরা দিল। ঐসময় নাকি ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা মইর‌্যা গেল। আহারে রে। আমার বাবার পায়ে একটা গুলি আইসা লাগছিল। বাবা গড়াইতে গড়াইতে ঝোপের আড়ালে পইড়্যা আছিল। তা না হইলে কিযে হইতো। বাবারেও মাইর‌্যা ফ্যালাইতো। কত কষ্টেযে বাবা ঐহান থিকা উইঠ্যা আইছিল। সেই থিকা বাবা আর আগের মত হাটতে পারত না। ইসসিরে আমি যদি ঐ সময় বড় থাকতাম,,, সব কটা রাজাকার আর পাকীদের মাইর‌্যা সাফ কইর‌্যা ফালাইতাম। এহন বাবার মত আমার বয়স ১৪ বছর।,,,’ এমন সময় একজন স্কুল ছাত্র আসে, বলে ’একটা পতাকা দেন’। রাজু পতাকা দেয়। রাজুর কথামত সে দাম দেয়। রাজু ভাবতে থাকে ’আমি যদি আবার স্কুলে যাইতে পারতাম, কত্ত কিছু শিখতে পারতাম। বাবা মইরা গেল, আর পড়তে পারলাম না, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে’। কাঁধে রাখা গামছা দিয়ে চোখ মুছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে স্কুল ছাত্রটিকে ডাক দেয়,’ ও ভাই হুনেন’। ছাত্রটি রাজুর কাছে আসে, বলে ,’ কি বলেন?’ রাজু তার হাতে পতাকার টাকাটা তুলে দেয় এবং বলে,’ এই ট্যাহাটা রাইখা দেন। ট্যাহা লাগবো না। ছাত্রটি বলে,’ টাকাটা আপনি রাখেন।’ রাজু বলে,’ অনেক পতাকা বেছুম, এইট্যা আমি আপনারে এমনিই দিলাম।’ ছাত্রটি খুশী হয়। সে ব্যাগ খুলে পাঁচটি লজেন্স দেয়। বলে,’ এইট্যা আপনি খাবেন।’
রাজু একটা লজেন্স মুখে দিয়ে হাটতে থাকে। ’গ্রামে যখন থাকতাম, কত্ত মজা করছি, একবার ১৬ই ডিসেম্বরে ইসকুলে কত্ত গান, নাটক, খেলা হইল। সবাইরে একটা কইরা পতাকা দিছিল। আমি ৩টি খেলায় প্ররথম হইছিলাম। তহন ৪র্থ শ্রেণীতে পড়তাম। সেইদিন বাড়ি ফিরনের সময় আমি, ফুলকি আর করিম সরিষা খ্যাত দিয়া পতাকা হাতে দৌড়াইতেছিলাম। চারদিকে সরিষা ফুলের গন্ধ, অহ্ কিযে আনন্দ। এমন সময় কান্নার আওয়াজে আমরা পিছন ফির‌্যা তাকাইলাম। দেহি ফুলকি খ্যাতের আইলের উপরে বইসা কানতেছে। সামুকে পা কাইট্যা রক্ত পড়তেছিল। আমি কইছিলাম, একটুখানি কাটছে তাই কানতোছোস, হাটতে পারতোসোছ না। ঐ দেখলি না নাটকে দেহাইলো, কত্ত জায়গায় গুলি লাগলো, তারপরও যুদ্ধ করতেছে।’ আড়ংএর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আবার ডাক পড়লো, ’এই পতাকা দাও তো’। একটা পতাকা বেচতে যেয়ে রাজুর ২৫টি পতাকা বেচা হয়ে গেল। ওর মনটা খুবই খুশি হয়ে গেল। মনে মনে বলল,’ ঐ স্কুল ছাত্র মনে হয় দোয়া করেছে। সে এইবার দোকান থেকে একটা সিংগারা খেল, সেভেন আপএর দিকে তার নজর গেল। খুব লোভ হলো একটা সেভেন আপ খেতে। রাজু ভাবলো, নাহ্ ওইডা খাইলে ট্যাহা কইম্যা যাইবো। আবার সে হাটতে শুরু করলো। ’ক্লাস ফাইভে ৬ মাস পড়ছিলাম। বাবা অসুস্থ হইলে মার সংসার চালাইতে খুব কষ্ট হইতেছিল। ৬ ভাইবোন। আমিইতো হক্কলের ছোড। দুইভাই বড়, বিয়া কইরা শ্বশুর বাড়ী থাহে। তাগো ছোটখাট মুদির দোহান আছে। আমগো খোঁজ খবর নেয় না। তারা ইচ্ছা করলে আমারে পড়াইতে পারতো। থাইকগ্যা কি আর কিরা। ২ বোইনের বিয়া হইছে। একজনের অবস্থা একটু ভালই। ঐদুলাভাই রাজাকারগো পক্ষে কথা কয়। কয়,’আমরা পাক আমলেই ভাল আছিলাম’। আসলে ওডা একটা শয়তান। এইজন্যই ঐ বাড়ীতে যাই না।’ রাজু পতাকার লাঠি বাম ঘাড় হতে ডান ঘাড়ে নেয়। ’ বাবা মইরা যাওনের পর থিকা মা কত্ত কষ্ট করলো। ভাইরা আগাইয়া আইলো না। আমারে কাম করনের লাইগা শহরে একটা হোটেলে পাঠাইলো। ইস কি যে কষ্ট করছি সেইহানে। ঠিকমত খাইবার দিত না। কতায় কতায় মারতো। পরে ঐহান থিকা এক কাঠমিস্রি তার দোকানে নিয়া আসে। সে অনেক ভাল। অবসর সময়ে আমি অন্য কাজও করতে পারি। মা কইছে ’টাকা জমাইতে হইবো। ছোড বোনটারে বিয়া দিতে হইবো। আর কয়, সব সময়ই সৎ থাকবি। সৎ চিন্তা করবি। কামে ফাঁকি দিবি না।’ আমিতো তাই করি। আমারে একদিন ফরকান কত্ত অনুরোধ কইরা কইছিল, এক ছিলিম গাঁজা খাওনের জন্যি, তাও খাই নাই।,,,, এমন সময় একটা ডাক আসে,,, একটা পতাকা দাও। রাজু পতাকা দেয়। টাকাটা পকেটে রাখে। রাস্তার ধারে বসে পতাকাগুলো ঠিক করে নেয়। একজন ৪০/৪৫ বয়সী লোক রাজুকে বলে এই ছ্যামড়া, অন্য কাম করতে পারোস না।’ রাজু হাসে আর বলে, এইড্যাও তো খুব ভাল কাম। দেশের কাম করা হইতেছে। লোকটি বলে তোর চাপায় দেহি জো-র আছে। কানের কাছে মুখ নিয়া চুপি চুপি বলে তুইতো ঢাকা শহরের অলি গলিতে ঘুরতাছোস, তোর কাছে কয়েকটা প্যাকেট দিমু, তুই শুধু ঠিক জায়গায় পাঠাইয়া দিবি, কারো কাছেই কবি না, কামডা পারবি তো? ভাইবা দেখ, তোরে ম্যালা টাকা দিমু।’ রাজুর মুখটা কালো হয়ে যায়। বলে, আমি পারুম না। এইডাতো খারাপ কাম। লোকটি বলে,’তুমি খুব ভালা কাম করতাছো? পত্তাকা বেইচা কি করবি, বড়লোক হবি?’ বাবার কথাগুলো মনে পড়ে রাজুর। বাবা একদিন কইছিলেন,’ পতাকার দিকে চাইলে দেশের কথা মনে করবি। এই পতাকারে সম্মান করা মানে দেশরে সম্মান করা। দেশের সাথে বেইমানী করবি না।’ রাজু বলে পত্তাকা বলবেন না, বলেন পতাকা। এইড্যা জাতীয় পতাকা। সম্মান কইর‌্যা কথা কন।’ লোকটি বলে ইসরে আমার পত্তাকা, সম্মান কইর‌্যা কথা কওয়া লাগবো।’ রাজুর রাগ নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। সে এক দলা থুথু লোকটির গায়ে ছুঁড়ে দেয়। লোকটি রাজুকে কিল থাপ্পড় মারে। রাজু মাটিতে পড়ে যায়। মাটিতে পড়ে সে লোকটি দিকে তাকায়। রাজুর মনে হয় এই লোকটি পাকী অথবা রাজাকার। সমস্ত শক্তি দিয়ে উঠে লোকটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দুচোখ তার জ্বলছে। লোকটির সামনে গদাম করে একটা লাথি মারে। লোকটি উহ্ করে উঠে। এবার উত্তম মধ্যম দিতে থাকে। লোকটিও অনেক জোরে আক্রমন করে। রাজুর গাঁয়েও এখন অনেক শক্তি জমা হয়েছে। আরো জোরে জোরে লাগাতে থাকে। এক সময়ে আবার সে সামনে গদাম করে লাথি মারে। লোকটি এবার পড়ে যায়। সে আবার উঠে রাজুর চোয়ালে জোরে একটা কিল লাগিয়ে জোড়ে দৌড় লাগায়। রাজুর মাথাটা ঘুরে যায়। সে মাটিতে বসে পড়ে। সামনের দিকে তাকিয়ে লোকটির দৌড় দেখতে থাকে। মুখ দিয়ে বের হয় ’শালা রাজাকার’। পতাকাগুলো এদিক ওদিক পড়ে ছিল। সেগুলো আস্তে আস্তে গুছিয়ে নেয়। একটা পতাকা রাজু পরম মমতায় বুকে আকড়ে ধরে। চোখ দিয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছে আনন্দ ঝর্ণাধারা।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৬
৩৭টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×