somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সফলদের স্বপ্নগাথা: ইতিহাস জানো, নিজেকে জানো

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সবাইকে স্বাগত!
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান একবার বলেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে নতুন কাজ হলো অজানা ইতিহাস জানা। আঠারো শতকের দার্শনিকের লর্ড বোলিংব্রকের কথায় সায় দিয়ে বলতে হয়, ‘ইতিহাসই হচ্ছে একমাত্র দর্শন, যা উদাহরণ দিয়ে শেখা যায়।’ আপনি যদি চিন্তা করেন, অতীতে কেউই বাস করত না, তাহলে বর্তমানের কোনো কিছুর সঙ্গেই মিল খুঁজে পাবেন না। অতীতে আসলে কেউ কখনোই বাস করত না। জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন—সবাই তাঁদের ‘বর্তমান সময়ে’ বাস করতেন। পার্থক্য হলো, তাঁদের বর্তমান আমাদের বর্তমান নয়। আমরা যেমন জানি না সামনে কী হবে, তাঁরাও সেটা জানতেন না। সহজেই অতীতের মানুষের ভুল ধরা যায়—তাঁরা যা করেছেন, তার ভুলও ধরা যায়, যা করেননি, তারও। এটা সহজ কারণ, আমরা তাঁদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগও ছিল না আমাদের।
নিজে থেকেই কোনো মানুষ কখনোই তৈরি হয়নি। আমরা সহজেই অন্য মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, পরিবর্তিত, আকর্ষিত বা কখনো বাধাগ্রস্ত হই। আমরা সবাই জানি, আমাদের ব্যক্তিজীবনে তাঁরা আমাদের উৎসাহ দেন, নিদের্শনা দেন, মনোবল বৃদ্ধি করেন। মাত্র একটা বাক্য কিংবা সামান্য কিছু কথাতেই পরিবর্তন করে দেয় আমাদের। এ ধরনের আরও মানুষ ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে আমরা কখনোই দেখা করতে পারিনি। আমাদের কাছে তাঁরা বেশ অজানা। কারণ, তাঁরা আমাদের থেকে অনেক আগের এক বর্তমানে বাস করতেন। তাঁরা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁদের সৃষ্টি, কাজকর্ম, সাহিত্যকর্ম নির্মাণ করছে আমাদের। আমাদের চারপাশে দৈনন্দিন জীবনে আমরা কখনো শেক্সপিয়ার, কখনো আলেক্সান্ডার পোপের কথা স্মরণ করি, যাঁরা আমাদের অনেক আগে জীবিত ছিলেন; তাঁদের অবহেলা করা নিজেকে অবহেলার শামিল। যাঁদের জন্য আমরা আজ এখানে, যাঁরা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন, যাঁদের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছি; তাঁদের কথা আমরা না জেনে কীভাবে থাকতে পারি—এটা তাঁদের প্রতি সম্মান। যাঁরা আমাদের জন্য সংগ্রাম করেছেন, যুদ্ধ-আন্দোলন চালিয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন আমাদের জন্য, তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য; তাঁদের প্রত্যেকেরই ছিল নিজ দুঃখ, কষ্ট ও দুর্বলতা। প্রত্যেকেরই জীবন নিয়ে আমাদের মতোই আক্ষেপ ছিল। মূল কথা হলো, একত্র হয়ে এই অসম্পূর্ণ মানুষগুলোই যা করে গেছেন, তার একটাই কারণ ছিল—মানবিকতা। আমরা বর্তমানের মানুষ শুধু আমাদের ব্যর্থতা, দুর্বলতা কিংবা পাপ নিয়ে পরিচিত হই না, আমরাও মাঝেমধ্যে একত্র হয়ে জেগে উঠি, তৈরি করি নিজেদের পথ, নিজেদের শক্তি।
গ্রিকরা মনে করত, আদর্শই গন্তব্য তৈরি করে দেয়। আমি যতই ইতিহাস পড়ি, ততই নিশ্চিত হই যে গ্রিকরাই সঠিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৈরির পেছনে যাঁদের অবদান আছে, তাঁদের নিয়ে অনেক বিখ্যাত চিত্রকরের ছবি আছে। এই চিত্রকরেরা সে সময়ের ‘বর্তমানে’ বাস করতেন। চিত্রকরদের আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে শুধু অঙ্কনগত সাদৃশ্যই ছিল না, ছিল আদর্শের মিল। আমাদের সে সময়কে বুঝতে হবে, অনুধাবন করতে হবে ছবিগুলোকে। এই ছবিগুলো আমাদের বলে দেয়, সে সময়ের মানুষ সবচেয়ে ভালো কিংবা নিখুঁত ছিলেন না। এটাই কাজে লাগিয়েছে তাঁদের পরের প্রজন্মের বাসিন্দারা। এই ছবিগুলো আমাদের বলে দেয়, তখনকার সমাজে কী খুঁত, ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল, যা সে সময়ের মানুষজন দূর করতে পারেনি। ইতিহাসের পথপরিক্রমায় আমাদেরই দূর করতে হবে সেই খুঁতগুলো।
আঠারো শতকের শেষের দিকে আমরা যখন স্বাধীনতা লাভ করি, তখন আমাদের কিছুই ছিল না। আমাদের ছিল না কোনো প্রবীণ রাজনীতিবিদ কিংবা সামরিক বাহিনীর নেতা। আমাদের জর্জ ওয়াশিংটনের বয়স ছিল সবচেয়ে বেশি—৪৩, যেখানে জেফারসনের বয়স ৩৩ আর জন অ্যাডামসের বয়স ছিল ৪০। সবচেয়ে কম বয়সে নেতৃত্বে ছিলেন বেনজামিন রাশ—মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে সই করেন। সবাই ছিলেন তরুণ, স্বপ্নচারী। ২৫ লাখ মানুষের দেশে ছিল মাত্র একটি সেতু, নিউইয়র্ক-বোস্টনের সংযোগ ছিল এই সেতু। কিন্তু ঘোষণাপত্রে সই করা সবাই ছিলেন তরুণ, নিজেদের দুর্বলতা ঢেকে খুঁতকে দূর করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সই করা ৫৬ জনই আমাদের কাছে খুবই পরিচিত, তাঁদের কাজের জন্যই আমরা জানি তাঁরা কারা।
আমাদের জানতে হবে, আমরা কোথা থেকে এসেছি। আমরা যদি তা না জানি, তাহলে আমরা কোথায় পৌঁছাতে চাই, তা অনুধাবন করতে পারব না। আমাদের কাছে যাঁরা অতীত, তাঁদের মূল্যবোধ ও আদর্শ আমাদের জানতে হবে। নইলে আমরা হারিয়ে যাব। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের বর্তমানে আমাদের মনে রাখবে না। ইতিহাস নিয়ে জানাশোনা শুধুই জ্ঞান বাড়ায় না, সুনাগরিক হওয়ার পেছনে সরাসরি কাজ করে। এই জানাশোনা আমাদের মনকে আমাদের অতীতের আদর্শ, চিন্তাভাবনাকে অনুসরণে নির্দেশ দেয়। যার জন্যই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাই।
ইতিহাসবিদেরা বলে থাকেন, আমাদের নিজেদের জানতে হলে ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে। ইতিহাস মানেই আমাদের চেনা-জানা অতীতের মানুষের গল্প। তাঁদের কথাই আমাদের সামনে নিয়ে যায়। আঠারো শতকে জন অ্যাডামস তাঁর সহধর্মিণী অ্যাবিগেইলকে যুদ্ধের ময়দান থেকে চিঠি লিখেছিলেন, ‘আমরা যুদ্ধে সফলতার নিশ্চয়তা দিতে পারি না, কিন্তু আমরা ভালো কিছু করতে পারি। আমরাই সেই ভালো কিছুরই প্রত্যাশা করি।’ ২০০ বছর আগের কথা আমাদের এখনো পথ দেখায়। আমার এখন সফল ও সবল জাতি; কোনো অভাব, বাধা-বিপত্তি নেই। তার পরও সে কথাগুলো আমাদের উদ্দীপ্ত করে। অতীতের সেই যুদ্ধের ফলাফল ছিল অসংজ্ঞায়িত, স্রষ্টাই ছিলেন শেষ ভরসা। কিন্তু তখনকার মানুষ কীভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তা বুঝতে পেরেছিলেন। নিজেদের জন্য সবচেয়ে ভালো ফলটাই আশা করছিলেন। যখন আমি এই কথাগুলো পড়ি, বাস্তবিকভাবেই কথাগুলো আমাকে উদ্দীপ্ত করে! আমি আরও আলোড়িত হই, যখন একই কথা আমি জর্জ ওয়াশিংটনের চিঠিতে পাই! আমাকে অবাক করে দেয়, যখন আমি দেখি অনুরূপ বক্তব্য আমি খ্রিষ্টের জন্মের আগের রোমান রাজনীতিবিদ মার্কাস ক্যাটো রচিত ভিন্ন ভাষার একটি বইতে খুঁজে পাই! অতীতের সেই লাইনগুলো তাঁদের কাছে শুধু একটি বাক্য ছিল না, ছিল জীবন-নির্দেশিকা। সেই নির্দেশিকা গ্রহণের সময় এখন আমাদের। ইতিহাসের সেই শব্দ অনুসরণ করে আমাদের ভবিষ্যতের দিকে যেতে হবে।
আমি উপস্থিত সবাইকে অভিবাদন জানাই শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ও হিলসডেইলে শিক্ষা গ্রহণের জন্য। বাধা-বিপত্তির কথা বলবে অনেকেই, কিন্তু সেটা তো থাকবেই। জাতি হিসেবে আমরা একত্রে সেই বাধা-বিপত্তি পার করার জন্যই অনেক খারাপ অধ্যায়কে অতিক্রম করেও আজ আমরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের ছিল না কোনো শক্তি, কোনো হাতিয়ার বা অর্থ। ছিল শুধু আমাদের পূর্বপুরুষের চেতনা, তাঁদের প্রতি সম্মান। গন্তব্যই তাঁদের এত দূর নিয়ে এসেছে। এই গন্তব্য তখনো যা ছিল, সব সময়ের জন্য তা কালো, কিন্তু স্বপ্নিল।
সবাইকে আগামী পৃথিবী নির্মাণে স্বাগত।
(দুবার পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন লেখক, জীবনীকার ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ডেভিড ম্যাকোলার জন্ম ৭ জুলাই ১৯৩৩। ট্রুম্যান ও জন অ্যাডামস বইয়ের জন্য তিনি ১৯৯৩ ও ২০০২ সালে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ২০০৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের হিলসডেল কলেজের ন্যাশনাল লিডারশিপ সেমিনারে ‘আমেরিকান হিস্ট্রি অ্যান্ড আমেরিকাস ফিউচার’ নামের নিচের বক্তব্য দেন।)
(সূত্র )
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আব্বাসীয় কুরাইশ বেশি যোগ্য

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৫




সূরাঃ ২ বাকারা, ১২৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১২৪। আর যখন তোমার প্রতিপালক ইব্রাহীমকে কয়েকটি বাক্য (কালিমাত) দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, পরে সে তা পূর্ণ করেছিল; তিনি বললেন নিশ্চয়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

বামিঙ্গিয়ান উপাখ্যান

লিখেছেন যুবায়ের আলিফ, ১০ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২০




মাঝ রাতে কড়া একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙলো জ্যাকের৷ ঘুমের ঘোরে দেখতে পেল কেউ চোখ ধাঁধানো পোষাক পরে ডাইনিংয়ে একটা চামচ রেখে দরজা গলিয়ে চলে যাচ্ছে৷ গা ও পোষাকের উজ্জ্বলতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×