somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, মুক্তিযোদ্ধা আলমগীর কবিরের ৭৫তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথিকৃত এবং আধুনিক চলচ্চিত্রের জনক আলমগীর কবির। এ ছাড়াও তাকে সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, মুক্তিযোদ্ধা প্রভৃতি বিশেষণে ভূষিত করা হয়। প্রবাসজীবনে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার ইঙ্গমার বার্গম্যান নির্মিত সেভেন্থ সিল একাদিক্রমে কয়েকবার দেখে চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ সৃষ্টি হয়। তিনি লিবারেশন ফাইটার্স নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ ছাড়াও অন্য কয়েকটি তথ্যচিত্রের চিত্রনাট্য, ধারাবর্ণনা রচনা করেন ও কন্ঠ দেন। আলমগীর কবির বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা। এ গুলির মধ্যে ফিল্ম ইন ইস্ট পাকিস্তান, ফিল্ম ইন বাংলাদেশ, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে ও মোহনা উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, 'উত্তরণ' -এর জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার, চলচ্চিত্র সংসদ পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সৈয়দ মোহাম্মাদ পারভেজ পুরস্কার লাভ করেন। বরেন্য এই চিত্র নির্মাতা ১৯৩৮সালের আজকের দিনে রাঙ্গামাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার ৭৫তম জন্ম দিন। চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবিরের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।


আলমগীর কবির, ১৯৩৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার আদি বাড়ি বরিশাল জেলার বানারীপাড়া। আলমগীর কবিরের পিতা আবু সাইয়েদ আহমেদ ও মাতা আমিরুন্নেসা বেগম। আলমগীর কবিরের লেখাপড়া শুরু হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। ১৯৪৮ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল এ ভর্তি হয়ে তিনি ১৯৫২ সালে গণিতে লেটার মার্কস্সহ ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই.এস.সি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। তবে অনার্স পরীক্ষার ফল বেরোনোর আগেই ১৯৫৭ সালের শেষদিকে লন্ডন চলে যান এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিকসে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ার সময় ইঙ্গমার বার্গম্যানের সেভেন্থ সিল চলচ্চিত্রটি দেখে, চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতি তার গভীর অনুরাগ সৃষ্টি হয়।


একই সময় বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৫৯ সালে লন্ডনে থাকাকালীন অবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ডেইলি ওয়ার্কারে রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এ সময় কিউবার গেরিলা যোদ্ধা ও প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন এবং গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি ও কৌশল সম্পর্কে ধারণা নেন। পরে তিনি প্যালেস্টাইন ও আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও ১৯৬২-৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে চলচ্চিত্রের ইতিহাস, নন্দনকলা ও নির্মাণকৌশল বিষয়ে বেশ কয়েকটি কোর্স সম্পন্ন করেন। একই সাথে তিনি লন্ডনে ইস্ট পকিস্তান হাউস, ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট প্রভৃতি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং 'ক্যাম্পেন এগেইনস্ট রেসিয়াল ডিসক্রিমিনেশন' আন্দোলনে সক্রিয় হন, ডেইলি ওয়ার্কার-এ কর্মকালে কিউবার গেরিলা যোদ্ধা ও প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সাক্ষাত্‍কার নেন এবং গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি ও কৌশল সম্পর্কে ধারণা নেন। পরে তিনি প্যালেস্টাইন ও আলজিরিয়ার মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেন। একসময় ফরাসি সরকারের হাতে ধরা পড়ে তিনি আটমাস জেল খাটেন। ১৯৬৬ সালে তিনি দেশে ফিরে বাংলাদেশে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এক পর্যায়ে আইয়ুব সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে রাখে। জেল থেকে বেরিয়েও এক বছর তিনি নজরবন্দি থাকেন।


(কন্যা মঞ্জুরা কবির, দৌহিত্রী ইলোরা ও অজন্তা কবিরের সাথে আলমগীর কবির)
কর্মজীবনে আলমগীর কবির বাংলাদেশের স্বনামধন্য ইংরেজি পত্রিকা দ্য অবজারভার-এ তাঁর সাংবাদিকতা পেশা শুরু করেন পরে যুক্ত হন সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায়। এ সময় অত্যন্ত কঠোর ও বিশ্লেষণধর্মী চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে সুপরিচিত হন তিনি। পরবর্তীতে হলিডে ছেড়ে এক্সপ্রেস নামে একটি সাপ্তাহিকের সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের যোগ দিয়ে ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পাশাপাশি সংবাদ পাঠক ও প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।'আহমেদ চৌধুরী' ছদ্মনামে তিনি ইংরেজি খবর ও কথিকা পাঠ করতেন। প্রবাসী সরকারের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবেও তিনি কাজ করেন, পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জহির রায়হান নির্মিত অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র স্টপ জেনোসাইড-এর চিত্রনাট্য রচনা ও ধারাভাষ্যকারের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। তিনি নিজেও Liberation Fighters নামে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এছাড়াও তিনি অরো কয়েকটি তথ্যচিত্রের চিত্রনাট্য, ধারাবর্ণনা রচনা করেন ও কন্ঠ দেন।


মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে তিনি বেশ কটি শিল্পমানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘ধীরে বহে মেঘনা’। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত ছবিটি ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির পুরস্কার লাভ করে। এরপর তিনি একে একে নির্মাণ করেন সূর্যকন্যা (১৯৭৬), সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), রূপালী সৈকতে (১৯৭৯), মোহনা (১৯৮২), পরিণীতা (১৯৮৪) ও মহানায়ক (১৯৮৫)। এ ছাড়া বেশ কিছু ভ্রামাণ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন তিনি। তার নির্মিত কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হলো লিবারেশন ফাইটার, পাগ্রম ইন বাংলাদেশ, কালচার ইন বাংলাদেশ, সুফিয়া, অমূল্যধন, ভোর হলো দোর খোল, আমরা দুজন, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, মণিকাঞ্চন ও চোরাস্রোত ইত্যাদি। এ ছাড়াও আলমগীর কবির বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা। এ গুলির মধ্যে ফিল্ম ইন ইস্ট পাকিস্তান, ফিল্ম ইন বাংলাদেশ, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে ও মোহনা উল্লেখযোগ্য। ধীরে বহে মেঘনা ও দিস ওয়াজ রেডিও বাংলাদেশ ১৯৭১ নামে তাঁর দুটি চিত্রনাট্যও আছে। চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন আলমগীর কবির।


(সীমানা পেরিয়ে ছবিতে বুলবুল আহমেদ ও জয়শ্রী কবির। পরিচালকঃ আলমগীর কবির)
১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন এই বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা। ১৯৮৯ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ায় একটি চলচ্চিত্র সংসদের উদ্বোধন ও আবু সাইয়ীদ নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আবর্তন’-এর একটি বিশেষ প্রদর্শনীতে আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে গেলেন আলমগীর কবির। বগুড়ায় থেকে ২০ জানুয়ারি দুপুরের পর ঢাকার পথে রওনা হন। নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। সন্ধ্যায় নগরবাড়ী ঘাটে ফেরিতে ওঠার জন্য পন্টুনের একপাশে অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ একটি ট্রাক ব্রেক ফেল করে সজোরে গাড়িটাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিলে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন আলমগীর কবির। আলমগীর কবির এবং তার কাজ নিয়ে সাক্ষাত্কার, চলচ্চিত্রের ফুটেজ, তার লাইভ ফুটেজ নিয়ে পরিচালক কাওসার চৌধুরী ২০০৮ সালে নির্মাণ করেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রতিকূলের যাত্রী।


বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাচার্য, প্রতিকুলের যাত্রী আলমগীর কবিরের আজ ৭৫তম জন্ম দিন। চলচ্চিত্রের মুশকিল আসান আলমগীর কবিরের ৭৫তম জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কৃষ্ণচূড়া আড্ডার কথা

লিখেছেন নীলসাধু, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০২



গতকাল পূর্ব নির্ধারিত কৃষ্ণচূড়ায় আড্ডায় মিলিত হয়েছিলাম আমরা।
বছরের একটি দিন আমরা গ্রীষ্মের এই ফুলটির প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে প্রকৃতির সাথে থাকি। শিশুদের নিয়ে গাছগাছালি দেখা, ফুল লতা পাতা চেনাসহ-... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×