somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইংরেজী সাহিত্যের অন্যতম কবি, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক ও সম্পাদক টি.এস.এলিয়টের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৫:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের একটি অবিস্মরনীয় নাম টি.এস.এলিয়ট, পুরো নাম টমাস র্স্টানস এলিয়ট। এলিয়ট ছিলেন আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান লেখকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, নাট্যকার এবং শক্তিমান সমালোচক। এলিয়ট ছিলেন মূলতঃ নগরজীবনের কবি। নগরজীবনের নেতিবাচক বিষয়কেই তিনি অপূর্ব শিল্পকুশলতায় তুলে ধরেছেন তাঁর কাব্যে । জীবনের যন্ত্রনা, নগরজীবনের হতাশা,দূনীতির কর্দযময়তা তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। ইংরেজী সাহিত্যের এই মহান কবি ১৯৬৫ সালের আজকের দিনে মৃত্যুবরণ করেন। আজ কবির ৪৮তম মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরন করছি গভীর শ্রদ্ধায় ।


বহুমুখী প্রতিভাধর কবি এলিয়ট ১৮৮৮ সালের ২৬ আগস্ট যুক্তরাস্ট্রের শিল্পনগরী মিসৌরীর সেন্ট লুইসে জন্মগ্রহণ করেন। তবে ১৯১৪ সালে ২৫ বছর বয়সে ইংল্যান্ডে চলে যান এবং ১৯২৭ সালে ৩৯ বছর বয়সে বৃটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে, সেটা হলো তাঁর ক্যাথলিসিজমে ধর্মান্তর। এরও একটা বিশেষ প্রভাব পড়েছে তাঁর কবিতায়। ‘দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড’ কবিতায় এলিয়টকে দেখা যায় তিনি মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু ওই এলিয়টই তাঁর আরেকটি দীর্ঘ কবিতা ‘ফোর কোয়ারটেটস্’-এ এসে সেই পথটাই যেন খুঁজে পেলেন ধর্মে ও আধ্যাত্মিকতায়। কিন্তু সে পথ কতটা মুক্তির আর কতটা পিছিয়ে যাওয়ার, সে প্রশ্নটা অবশ্য থেকেই যায়। এলিয়টের লেখালেখির হাতেখড়ি হয়েছিল মায়ের কাছে।হার্ভাড গ্রাজুয়েট এলিয়টের পড়াশুণোর বিষয় ছিলো ভাষা ও সাহিত্য ।তবে তিনি উৎসাহী ছিলেন তুলনামুলক ভাষা সাহিত্যের প্রতি । ১৯১৫ সালের দিকে তার কবিতা দি লাভ সং অফ জে আলফ্রেড প্রুফ্রক এর মাধ্যমে সবার নজর কাড়েন। এই কবিতার পরে তার ঝুলি থেকে একে একে বের হয় বিশ্ববিখ্যাত সব কবিতা। এদের মধ্যে দি ওয়েস্ট ল্যান্ড (১৯২২) , দি হলো মেন (১৯২৫) , অ্যাশ ওয়েন্সডে (১৯৩০) এবং ফোর কোয়ার্টার্স (১৯৪৫) অন্যতম। তার নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল মার্ডার ইন দ্যা ক্যাথেড্রাল (১৯৩৫)। তাঁর সবচেয়ে সাড়া জাগানো কাব্যগ্রন্থ হলো‘ ট্রাডিশন এন্ড দি ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’।


এলিয়টকে বলা হয় কবিদের কবি। তার আগে বোদলেয়ার, মিল্টন এবং দান্তেকেও এই রকম বলা হতো। ইংরেজ সাহিত্যের সমালোচকগণ স্বীকার করেন যে,জন মিল্টন এবং ইয়েটস ছাড়া এলিয়টের মতো এমন শিক্ষিত কবির আগমন আর ঘটেনি। শুধু ইংরেজি সাহিত্য নয়- গোটা বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনেও তিনি ছিলেন স্বকীয় বৈশিষ্ঠ্যে উজ্জল। বাংলা কবিতা এলিয়টের সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। বাংলা কবিতার পাঠকেরা জানেন, তিরিশের আধুনিক কবিরা কতখানি অভিভূত হয়েছিলেন এলিয়টের কবিতা পড়ে। রবীন্দ্রনাথও এলিয়টের কবিতা অনুবাদ করেছেন। এলিয়টের এই যে বৈশ্বিক প্রভাব, সেটি আসলে নিহিত তাঁর লেখনীর ভেতরেই। এলিয়ট বিংশ শতাব্দীর কবিতায় যে ধারাটির সংযোজন করেন তাতে বুদ্ধিবৃত্তির প্রাধান্যটি ব্যাপক হয়ে পড়ে, যুক্তি আকর্ষণ প্রয়োজনীয়তা পায়। এলিয়টের আরো একটি বিশেষ অবদান এই যে, তিনি ইংরেজি কাব্যের ভাষাকে সংষ্কার করেছেন। এলিয়ট কবিতার ভাষাকে নিয়ে এসেছিলেন মুখের ভাষার কাছাকাছি। সাহিত্যে বিপ্লবের মানেটা আর কিছুই নয়, তা হচ্ছে মানুষের মুখের ভাষার কাছে ফিরে আসা- এই উপলব্ধিটুকু এলিয়টই বারবার আমাদেরকে দিয়েছেন।


এলিয়টের কাব্যে, বিশেষ করে ‘দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড’কবিতায় আমরা দেখি আধুনিক মানুষের কোন পূর্ণাঙ্গ ভূখণ্ড নেই। যে জমিতে মানুষ পড়ে আছে সেখানে ফসল নেই, রস নেই, জল নেই, গাছপালা নেই, নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো নির্মল বাতাস নেই, কথা বলার মানুষ নেই। কেননা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুই পুড়ে গেছে। দগ্ধ জমিতে মানুষও অনুপস্থিত। যে সব চরিত্রকে এখানে দেখা যায় তাদের চেহারাটা অনেকটা ভুতের মতো। আর ভুতের মতো বলেই তাদের কোন নির্দিষ্ট আবাস নেই, বিনাশও নেই। এলিয়ট কবিতায় এ ইঙ্গিতটা দেন যে, মৃত্যুবরণ করার ক্ষমতাও মানুষ হারিয়ে ফেলেছে এবং এ কারণে বোতলের ভেতরের ভুত কেবল পুড়তে থাকবে। এর কোন পরিত্রাণ নেই, পথও নেই বেরিয়ে পড়বার।


(TS Eliot and his second wife Valerie)
‘দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড’ কবিতার দ্বিতীয় পর্বের শুরুতেই এলিয়ট একটি রমণীয় চেয়ারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বর্ণনাতে মনে হয় যেন ওটি চেয়ার নয়, সিংহাসন। আর যিনি চেয়ারে বসে আছেন সেই মানুষটি মুখ্য নয়, এমনকি মুখ্য নয় তার বসে-থাকাটাও; বড়ো বিষয় হচ্ছে চেয়ারটি নিজেই। পণ্য বিকশিত হবে, পুঁজি ফুলেফেঁপে উঠবে; কিন্তু মানুষ সম্ভাবনাহীন থাকবে, আটকে থাকবে বোতলের ভেতরে অথবা কারাগারে অথবা বিস্তীর্ণ পতিত জমিতে – এই পুঁজিবাদী ধারণার উর্দ্ধে উঠতে পারেননি বলেই এলিয়ট চিহিৃত করতে পারেননি মানুষের মুক্তির পথটা। সংকটের চিত্র তিনি এঁকেছেন, কিন্তু সংকটের কারণগুলো তিনি গভীরভাবে নির্দেশ করতে পারেননি। আর কারণগুলো ধরতে পারেননি বলেই, তাঁর হাজারো ইতিবাচক ও মৌলিক অবদান স্বত্বেও, যখন মুক্তি খোঁজার তাগিদ এলো, তখন মুক্তির নামে তাঁকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে, যেতে পারেননি সামনে।


এ রকমই আরেকটি মর্মন্তুদ কাহিনী আমরা দেখি এলিয়টের ‘প্রুফকের প্রেমসঙ্গীত’ নামের কবিতাটিতে। সেখানে ‘প্রুফক’ নামের একজন মানুষ এক অসহায় বৃত্তে আটকা পড়ে আছে। ও কথা বলতে চায়, কিন্তু তার পৃথিবীতে সংলাপ নেই। সেখানে গতি থাকলেও থাকতে পারে, তবে গন্তব্য অনুপস্থিত। এই বদ্ধ, অসহায়, সিদ্ধান্তহীন মানুষটার মর্মবেদনা এলিয়ট বুঝতে পারছেন, কিন্তু যেন মুক্ত করতে পারছেন না তাকে। প্রুফক আটকে গেছেন, সঙ্গে সঙ্গে এলিয়টও। আর এই সীমাবদ্ধতার কারণে বিচ্ছিন্নতাও বেড়েছে। বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করার জন্য সামনের দিকেই যে যেতে হবে, পেছনে নয়- এই সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাটা পুঁজিবাদী সমাজ থেকে আসেনি বলেই শুধু এলিয়ট নন, তাঁর সমসাময়িক আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিকেরাও মানুষের মুক্তির পথটা নির্দেশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।


এলিয়ট তাঁর বিভিন্ন কবিতায় একজন আধুনিক মানুষের যে সামগ্রিক সংকটের চিত্র তুলে ধরেছেন ওটি আসলে পুজিঁবাদেরই সংকটের চিত্র। তাঁর একটি ইতিবাচক অবদান এইখানেই যে, তিনি পুজিঁবাদের সংকটকে কাব্যিক অভিজ্ঞতায় ধারণ করেছেন। পণ্য ও পুঁজিকে মুখ্য করতে গিয়ে মানুষকে গুরুত্বহীন, পতিত করার পুজিঁবাদের যে স্বভাবজাত মানসিকতা, ওই প্রপঞ্চটিই ঘুরে ফিরে আসে তাঁর কবিতায়। সমস্ত ‘ওয়েইষ্ট ল্যান্ড’জুড়েই মানুষ বিরাজ করে পতিত প্রাণী হিসেবে। যন্ত্র সেখানে উঠে আসছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু মানুষ শুধুই পড়ে যাচ্ছে ও পিছিয়ে পড়ছে। এলিয়টের পৃথিবীতে পণ্যের চোখ-ঝলসানো চাকচিক্য আছে, যেটিকে আবরণ হিসেবে মেলে ধরে পুজিঁবাদ আড়াল করে রাখে তার অন্তর্গত সংকট ও প্রতারক চেহারাটি।


আধুনিক সাহিত্যে অভূতপূর্ব অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৪৮ সালে এলিয়ট সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার এবং একই বছর অর্ডার অফ মেরিট পুরষ্কারে ভূষিত হন। ১৯৬৫ সালের ৫ জানুয়ারী এই মহান কবি মৃত্যুবরণ করেন। আজ কবির ৪৮তম মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরন করছি গভীর শ্রদ্ধায় ।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্যামুয়েল ব্যাকেট এর ‘এন্ডগেম’ | Endgame By Samuel Beckett নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা

লিখেছেন জাহিদ অনিক, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৮



এন্ডগেম/ইন্ডগেইম/এন্ডগেইম- যে নামেই ডাকা হোক না কেনও, মূলত একটাই নাটক স্যামুয়েল ব্যাকেটের Endgame. একদম আক্ষরিক অনুবাদ করলে বাংলা অর্থ হয়- শেষ খেলা। এটি একটা এক অঙ্কের নাটক; অর্থাৎ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামে ভুল থাকলে মেজাজ ঠিক থাকে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৫


বেইলি রোডে এক রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে একজন একটা পোস্ট দিয়েছিলেন; পোস্টের শিরোনামঃ চুরান্ত অব্যবস্থাপনার কারনে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডকে দূর্ঘটনা বলা যায় না। ভালোভাবে দেখুন চারটা বানান ভুল। যিনি পোস্ট দিয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×