somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের সঙ্গীত

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সংস্কৃত একটি জাতির দর্পন স্বরুপ। কোন দেশের সংস্কৃতি বিশ্লেষনের মাধ্যমে দেশটি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়। আর সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য উপাদান সঙ্গীত। পৃথিবীর প্রত্যেকটা জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, আর এসব সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের সঙ্গীত রয়েছে। সংস্কৃতির উপর এসব সঙ্গীতের প্রভাব অত্যন্ত বিস্তর। অন্যান্য জাতির মত বাংলাদেশেও রয়েছে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন সংস্কৃত। বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের সঙ্গীত প্রচলিত রয়েছে। মূলত উনিশ ও বিশ শতকের সঙ্গীত-সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল আঠার শতকে। বাংলাদেশের সঙ্গীত বাণীপ্রধান; এখানে যন্ত্রসঙ্গীতের ভূমিকা প্রাধান্য সামান্য। গ্রাম বাংলার লোকসঙ্গীতের মধ্যে বাউল গান, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, গম্ভীরা, কবিগান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। গ্রামাঞ্চলের এই লোক সঙ্গীতের সাথে বাদ্যযন্ত্র, হিসাবে মূলত একতারা, দোতারা, ঢোল, বাঁশি, ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। আধুনিক সঙ্গীতকাররা অবশ্য বিদেশী বাদ্যযন্ত্র যেমন - কীবোর্ড, ড্রামস, গীটার, ইত্যাদিরও ব্যবহার করে থাকেন। কেউ কেউ আবার লোকজ ও আধুনিকতার মিশ্রনে ফিউশন ধারারও প্রচলন করেছেন।
সংস্কৃতি
কোন স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তাই সংস্কৃতি। ইংরেজি ঈঁষঃঁৎব এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার করা শুরু হয়।১ শব্দটি বাংলা ভাষায় গৃহীত হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত যত বিভ্রান্তি ও তর্ক-বিতর্ক তৈরি হয়েছে, আর কোন শব্দ নিয়ে এত মনে হয় হয়নি। শিক্ষাবঞ্চিত নিরক্ষর জনগন এমনকি বহু শিক্ষিত লোককেও বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এবং উচ্চতর পেশাগত মর্যাদায় অধিষ্টিত অনেক লোকও সংস্কৃতি বলতে মূলত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে বুঝে থাকেন। অর্থাৎ নাচ-গান-নাটক-চলচ্চিত্র-শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদিকেই সংস্কৃতি বলে মনে করেন। কিন্তু এগুলো সংস্কৃতির অংশ, সংস্কৃতির পুরোটা নয়। সংস্কৃতিকে সীমাবদ্ধ গন্ডির মধ্যে বেধে রাখা বা সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়।
অধ্যাপক পবিত্র সরকার এটিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে - মানুষ আসার আগে পৃথিবী যে অবস্থায় ছিল আর মানুষ আসার পর পৃথিবীর যে অবস্থা দাড়ালো এই দুইয়ের তফাত হলো সংস্কৃতির তফাত। পৃথিবীর জীবন প্রতিবেশে মানুষের সৃষ্ট যা কিছু সে সবই সংস্কৃতি বাকিটা প্রকৃতি।
ক্লাইড ব্লাকহোন এবং উইলিয়াম কেলি সংস্কৃতির সংজ্ঞয় বলেন, “ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্টি হওয়া জীবনযাপনের নানা ছক, যা কখনো প্রকাশ্য, কখনো গোপন, কখনো যুক্তিসঙ্গত, কখনো অযৌক্তিক, কখনো যুক্তি নিরপেক্ষ এবং যা যে কোন সময়ে একটি জনগোষ্ঠীর আচরণকে পরিচালনা করে।
সুতরাং বলা যায়, সংস্কৃতির হল একটি জাতির প্রতিটি অনুষঙ্গ যেমন - পোশাক-আশাক, পেশা, খাদ্যাভ্যাস, ঘর-বাড়ি থেকে শুরু করে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কুসংস্কার সবই সংস্কৃতির অঙ্গ।
সঙ্গীত
সংস্কৃতির বিষয়গুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমভাগ নিত্যদিনকার জীবনযাপনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। আর দ্বিতীয়ভাগ জীবন উপভোগের সাথে সম্পর্কিত।৪ দ্বিতীয় ভাগের একটি গুরত্বপূর্ণ উপাদান সঙ্গীত। সঙ্গীত হল এক ধরণের শ্রবণযোগ্য কলা যা সুসংবদ্ধ শব্দ ও নৈশব্দের সমন্বয়ে মানব চিত্তে বিনোদন সৃষ্টি করতে সক্ষম। স্বর ও ধ্বনির সমন্বয়ে সঙ্গীতের সৃষ্টি। এই ধ্বনি হতে পারে কন্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি, হতে পারে যন্ত্রোৎপাদিত শব্দ অথবা উভয়ের সংমিশ্রন। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে সুর ধ্বনির বাহন। সুর ছাড়াও অন্য যে অনুষঙ্গ সঙ্গীতের নিয়ামক তা হল তাল। কার্যত ধ্বনি, সুর ও তালের সমন্বয়ে সঙ্গীত সৃজীত হয়।৫ পৃতিভীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরণের সঙ্গীত প্রচলিত রয়েছে। প্রাচীণকাল থেকেই সঙ্গীত মানুষের হৃদয়ের খোরাক মিটিয়ে আসছে। তাই সংস্কৃতিতে সংগীতের ভূমিকা বা প্রভাব অপরিহার্য।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সঙ্গীত
বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশবাংলাদেশের গণমানুষের সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, ভোজনরীতি, পোষাক, উৎসব ইত্যাদির মিথষ্ক্রিয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই এই সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির থেকে ধার করা কিংবা প্রভাবান্বিত। তবু বাংলাদেশের স্বকীয় কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আলাদা করার প্রয়াস পাওয়া যায়। সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানের মত বাংলাদেশের সঙ্গীতেরও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গীত বলতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশে বাংলাদেশের ভূখন্ডে আবহমান কাল থেকে প্রচলিত সঙ্গীতের ধারকে বোঝানো হয়ে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গীতের ধারা থেকে এই সঙ্গীত সম্পূর্ণ অভিন্ন না হলেও কিছু স্বকীয় উপাদানের কারনে বাংলাদেশের সঙ্গীতকে আলাদা করে সংজ্ঞায়িত করা যায়। বাংলাদেশের সঙ্গীতমূলত রাগমিশ্রিত নয়, বরং অনেক বেশি সরল, কথা ও সুরের অপূর্ব সহজ একরৈখিক মেলবন্ধনের প্রয়াস।৬ আবহমানকাল থেকে প্রচলিত গণমানুষের সঙ্গীত যেমন খুব সরল সাধারণ, তেমনি আধুনিক বিভিন্ন বিদেশী সঙ্গীতের ধারাও এই দেশে সমানভাবে প্রচলন হতে শুরু করেছে। তবু গণমানুষের সঙ্গীত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঢঙে বিভিন্ন পরিবেশনে বারবার সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করেছে, অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক সঙ্গীতের জোয়ার ছাপিয়েও। তাই বংলাদেশের সঙ্গীত বলতে যে সঙ্গীতের যে ধারাকে বোঝানো হয়, তা প্রকৃত অর্তেই দেশীসঙ্গীত। আধুনিক কালের বাংলা গানের চরণগুলো মূলত স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও অভোগ - এই চার কলিতে বিভক্ত।৭ নিচে বাংলাদেশের সঙ্গীতের শ্রেনীবিভাগ দেয়া হল ৬
 গণমানুষের সঙ্গীত
 বাউল
 জারি
 সারি
 ভাটিয়ালী
 ভাওয়াইয়া
 মুর্শীদি
 আধুনিক ধারা
 রবীন্দ্র সঙ্গীত
 নজরুল সঙ্গীত
 আধুনিক সঙ্গীত
 রাগ সঙ্গীত
 অত্যাধুনিক ধারা
 ব্যান্ড সঙ্গীত
ক্স মেটাল
ক্স ফিউশন
ক্স রক
বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাস
বাংলা ভাষার মত সঙ্গীতের প্রাচীন নিদর্শন হল চর্যাপদ, যার গানগুলো খ্রিষ্টীয় নবম বা দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিথ।৮ আধুনিক কালের বাংলা চার প্রকারের কলি’র পরিবর্তে তখনকার সঙ্গীত ছিল উদগ্রাহ, মেলাপালক, ধ্রুব ও অভোগ - এই চার প্রকারের ধাতু সমৃদ্ধ। তন্মধ্যে উদগ্রাহ ও দ্রুব সব গানেই থাকতো, বাকি দুটো বাধ্যতামূলক ছিল না। সাধারণভাবে তখনকার সঙ্গীতকে বলা হত প্রবন্ধগীত। চর্যাগীতগুলো পটমঞ্চরী, মাল্লারী, গুর্জরী, কামোদ, বরাড়ী, ভৈরবী, গবড়া, দেশাখ, রামক্রী, শবরী, অরু, ইন্দ্রতাল, দেবক্রী, ধানশ্রী, মালসী, মালসী-গবড়া ও বঙ্গালরাগে পাওয়া যেত। আর বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো একতার পটহ বা ঢোল। চর্যাসঙ্গীত গুলো মূলত বৌদ্ধ সাধনপদ্ধতিমূলক গান। চর্যাসঙ্গীতের পর বাংলা সঙ্গীতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নাথগীতি, যা প্রায় চর্যাপদের সমসাময়িক। নাথগীতির গায়নপদ্ধতির সাথে চর্যাগীতির গায়নপদ্ধতির পার্থক্য। এতে রাগের ব্যবহার থাকলেও গাওয়া হতো ছড়ার আকারে কিংবা পাঁচালির সুরে। এরপর দ্বাদশ শতকে রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেব কর্তৃক সংস্কৃত ভাষায় মাত্রাবৃত্ত অপভ্রংশে রচিত গীতগোবিন্দম বেশ সমাদৃত হয়। তবে সেখনেও চর্যাগীতির প্রভাব লক্ষণীয়।৭

বাউল সঙ্গীত
বাংলার গ্রামীণ-লোকজ জীবন ও সংস্কৃতির সাথে যারা কম বেশি পরিচিত, ‘বাউল’ শব্দটি শুনলেই তাদের মানসচোখে ভেসে ওঠে সাদা অথবা গেরুয়া কাপড়ে একতারা হাতে গান গেয়ে চলা কোন ব্যক্তির ছবি। বাউল বললেই মনে হয় নির্লিপ্ত আত্মমগ্ন কোন সাধকের কথা যে কিনা বসে আছে কোন এক পরমাত্মার সাথে মিলনের অপেক্ষায়। যে জানে না ‘মিলন হবে কতদিনে’ তার মনের মানুষের সনে: যার সমগ্রজীবনের একমাত্র প্রার্থনা ‘পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে’। এই বাউলদের রূপ বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
“দেখেছি একতারা-হাতে চলেছে গানের ধানা বেয়ে
মনের মানুষের সন্ধান করবার
গভীর নির্জন পথে।”৯
“বাউলরা হলো সাধনাভিত্তিক এক সম্প্রদায়। বাউলরা অজ্ঞাত মর্মের অনুসন্ধান ও উপলব্ধি করিতে গিয়া, হৃদ-বিহারী অচিন পাখিকে ধরিতে চেষ্টা করিয়া অন্তরতম মনের মানুষকে মর্ম দিয়া বুঝিতে চেষ্টা করিয়া, দরদী সাঁই-এর প্রেমময় পরশ লাভ করিতে ইচ্ছ করিয়া যে পথ অবলম্বন করিয়ছে, তাহা বঙ্গীয় চিন্তা জগতের সম্পূর্ণই স্বাধীন পথ। এ পথ বাঙালির নিজস্ব পথ; এপথে চলিতে চলিতে বাংলা মায়ের ভিজা মাটির গন্ধ পাওয়া যায়।”১০ বাউলদের মধ্যে দুটো শ্রণী দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমটি হচ্ছে গৃহত্যাগী বাউল এবং অন্যটি হচ্ছে গৃহী বা সংসারী বাউল। গৃহত্যাগী বাউলেরা গুরুর নিকট ভেক বা খিলাফত-এর দীক্ষা নেয়। এদেরকে ভেকধারী বাউলও বলা হয়। তবে বাউলদের মধ্যে এদেরকে বলা হয় ‘জ্যান্তে মরা’। আর গৃহী বা সংসারী বাউলেরা সাধারণ মানুষের মতই স্ত্রী-পুত্র পরিজনসহ সাধারণ জীবন যাপন করে।এরা নানাবিধ পেশায় নিয়োজিত থাকে। গৃহী বাউলরা ভেকধারী বাউলের কাছ থেকে দীক্ষা নেয়। এদের সম্পর্ক অনেকটা পীর-মুরিদের মতো। বাউলমত গুরুমুখী মতবাদ। বাউলদের ‘ঘর’ বা গুরুধারা একেকজন বাউলগুরুর নামানুসারে নির্দিষ্ট হয়। যেমন: লালনশাহ্ী, পাঞ্জু শাহী, পাঁচু শাহী, দেলবর শাহ্ী ইত্যাদি। বাউল ধর্মে কোন লিখিত শাসন নেই। এটা হলো গুরুমুখী বিশ্বাস ও ধর্মাচার। যেখানে গুরুর মৌখিক নির্দেশ এবং গানই একমাত্র অবলম্বন। উল্লেখ্য যে বাউল মত ও দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়নের একটি বড় ভিত্তি হিসাবে বাউল দর্শনের শ্রেষ্ঠ রূপকার বাউল সঙ্গীতকে মূল্যায়ন করা হয়। এ প্রেক্ষিতে বাউল গানকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়:১১ দৈন্যপদ এবং করণ পদ।
দৈন্য পদ যেমন:
“আর আমারে মারিস নে মা
বলি মা তোর চরণ ধ’রে
ননী চুরি আর করবো না”।২১
দৈন্যপদ সাধারণ গীতিকথা। এখানে কোন গূঢ়তত্ত্ব নেই। বাউল গানের মূল দর্শন বা তত্ত্ব লুকায়িত আছে করণ পদে। করণ পদের উদাহরণ:

“আপন ঘরের খবর নে-মা
অনাশে দেখতে পাবি
কোনখানে সাঁইর বারামখানা।২১
তাই বাউলদর্শন বিশ্লেষনের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে করণ পদের বিশ্লেষণ।
বাউল মত : উদ্ভব, প্রকৃতি ও বাস্তবতা
বাউল ধর্মমতের প্রকৃতি নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। উদ্ভবকাল নিয়ে কিছুটা সংশয়ের পরও নিঃসংকোচেই বলা যায় যে, প্রায় অর্ধ-সহ¯্রাব্দ সময় জুড়ে বাউলরা বাংলার সমাজ-সংস্কৃতিতে অস্তিত্বশীল। ষোড়শ শতকের বাংলা সাহিত্যে বহুস্থানে সচেতন ভাবে ‘বাউল’ শব্দের ব্যবহার হতে দেখা যায়।১২ কিন্তু একটি সম্প্রদায় হিসাবে সমাজ কাঠামোয় বাউলদের বিকাশ ঠিক কবে থেকে তা নিয়ে অস্পষ্টতা যেমন আছে গবেষকদের মধ্যে মতভেদও রয়েছে। তবে বর্তমান সমাজকাঠামোয় বাউলদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বহুদিন থেতেই স্বীকৃত। প্রসিদ্ধ একজন গবেষকের ভাষায়, “বাংলার বাউল, বাউল সাধক, বাউল তত্ত্ব ও ধর্মমত, বাউণ গান, বাউল দর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে নানা আলোচনা-গবেষণা এ শতাব্দীর শুরু থেকে হয়ে আসছে।.......বাউল চর্চার এ গুরুত্ব থেকে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাসে বাউলদের সামাজিক অস্তিত্ব ও গোষ্ঠীগত স্বাতন্ত্র্য অবিসংবাদিত রূপে স্বীকৃতি পায়।”১৩ অনেকে মনে করেন যে বাউল মত একটি পূর্ণধর্ম। আবার অনেকে মনে করেন যে, বাউল মত একটি লৌকিক মতবাদ এবং ধর্মের বিশিষ্ট এক রূপ- পূর্ণাঙ্গ কোন ধর্মমত নয়। ঊপেন্দ্র্রনাথ ভট্টাচার্য মনে করেন যে, “আনুমানিক ১৬২৫ খৃষ্টাব্দ হইতে আরম্ভ করিয়া ১৬৭৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে বাংলার বাউল ধর্ম এক পূর্ণরূপ লইয়া আবির্ভূত হয়।"১৪ আবুল আহসান চৌধুরীও বাউল ধর্মের স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু এর বিকাশ সম্পর্কে অন্য একটি কাছাকাছি অনুমানকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন। তিনি মনে করেন, “বিভিন্ন পরিবর্তনশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে এসে চৈতন্যদেবের (১৪৮৪-১৫৩৩) মৃত্যুর পর বাউলধর্ম তার নিজস্ব রূপ পরিগ্রহ করে।”১৫ অন্যদিকে প্রকৃতি আলোচনা প্রসঙ্গে বাউল মতকে ভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করে ওয়াকিল আহমেদ বলেন, “বাউল ধর্মমতে ও দর্শনে হিন্দুতান্ত্রিক, নাথযোগী, সুফী, বৈষ্ণব প্রভৃতি শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রভাব রয়েছে। এতদাসত্ত্বেও বাউল মূলত লৌকিক ধর্মমত।”৯ ঊপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও প্রায় একই মত প্রকাশ করে বলেন,“এই ধর্ম (বাউল ধর্ম) নিতান্ত লোকের ধর্ম-গণধর্ম এবং ইহার পশ্চাতে যে একটি বিশিষ্ট রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক পটভূমিকা ছিল, তাহারও যথেষ্ট ইঙ্গিত দিয়াছি।”৯ তবে বাউলমতের প্রকৃতি নিয়ে এই মূল্যায়নগুলোর কোনটিই সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে গৃহীত হয় নি।
স্পষ্টত বাউলমতের উদ্ভব ও বিকাশ সামাজিক বাস্তবতায়। বিগত প্রায় অর্ধসহ¯্রাব্দের নানাবিধ ধর্মমতের - বৌদ্ধধর্ম, হিন্দু তান্ত্রিকতা, নাথযোগ, সুফিবাদ ইত্যদির এক সমন্বিত প্রকাশ বাউল মত। বাউল মতের এই উদ্ভব ও বিকাশ বিবেচনায় সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কেউ কেউ বাউল মতকে ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। কেননা সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্ম সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং এখানে ধর্মকে প্রত্যাদেশের ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয় না।
এই সকল কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাউল মতবাদকে একটি স্বতন্ত্র মতবাদ বলে বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে। কেননা বাউলদের যেমন নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস রয়েছে একইভাবে স্বতন্ত্র আচার-রীতি ও অভিজ্ঞতাও রয়েছে এবং সর্বোপরি একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসাবে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বহুদিন থেকে স্বীকৃত। তবে এই সকল বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব দিয়ে বাউলমতের প্রকৃতি নির্ধারণ যৌক্তিক নয়। এর জন্য বাউলমতের বিশ্বাস ও আচারকে আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করতে হবে। সমাজবিজ্ঞানে ধর্মের একটি সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস ও আচারের এমন প্রক্রিয়া যা পবিত্রতার সাথে যুক্ত। ধর্মের ধারণার সাথে এখানে অতীন্দ্রিয় শক্তির যোগাযোগ কল্পনা করা হয়।
কিন্তু বাউল ধর্মে ঐশ্বরিক বিশ্বাসের অস্তিত্ব থাকলেও সেখানে পবিত্রতা-অপবিত্রতা বেং মৌলিক বিশ্বাস ও আচারের কোন সুনির্দিষ্টতা নেই। স্বতন্ত্র বিশ্বাস ও আচারের পরিবর্তে বাউল ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস এবং আচার নিয়ে। যে কারণে বাউল গানে আছে,
“আমার নাহি মন্দির কি মসজিদ
পূজা কি বকরিদ
ওরে তিলে তিলে মোর মক্কা কাশী
পলে পলে সুদিনা।”২১
বাউল মতবাদ বিকশিত হয়েছে দেহকেন্দ্রিক সাধন-দর্শনকে কেন্দ্র করে। বাউলদের এই দেহভিত্তিক সাধন দর্শন বৈষ্ণব সহজিয়া মতেরই এক গীতিরূপ বিশেষ। বৈষ্ণব সহজিয়াদের “বৃহৎ দেহ নির্ণয় ”-এর মধ্যে এই সাদৃশ্য দেখা যায়।
“নরদেহে নৈলে কোন তত্ত্ব নাহি জানে
সাধনার মূল এই নরদেহে গনে।”১৭
বৈষ্ণব সহজিয়াদের মত বাউলদেরও দেহের বাইরে কোন সাধনা নেই। বলা যায় যে ‘যাহা নাই ভান্ডে, তাহা নাই ব্রহ্মান্ডে’। দেহভান্ড তাদের কাছে একমাত্র বর্তমান। এর বাইরে সকল কিছুই তাদের কাছে কল্পনা এবং মূল্যহীন।১৪ লালনের গানে দেখা যায়,
“বেদে কি তার মর্ম জানে?
যে রূপ সাঁইর লীলা আছে এই দেহ ভুবনে।”২১
‘বাউলেরা রাগপন্থী’ - কামাচার বা মিথুনাত্মক যোগসাধনই বাউল পদ্ধতি।১৮ যদিও লালনের একটি গানে আছে-“আগে কপাট মারো কামের ঘরে।” কিন্তু তার এবং বাউল গানের অধিকাংশই সূক্ষ্মভাবে যৌনতাকে সাধনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন লালনের গান থেকে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়:
“সবাই কি তার মর্ম জানতে পায়
জানে ভজন সাধন করে
যে সাধকে অটল হয়।
অমৃত মেঘেরি বরিষণ,
চাতক ভেবে জানরে আমার মন,
ও তার একবিন্দু পরাশিলে শমন জ্বালা ঘুচে যায়।
যোগেশ্বরীর সঙ্গে যোগযোগ করে
মহাযোগাযোগ সেই জানতে পারে,
ওসে তিন দিনের তিন মর্ম্ম জেনে একদিনেতে সেধে লয়।”২১
বাউলদের অটল সাধনা হচ্ছে যৌন মিলনে বীর্য নিরুদ্ধ করা। মুহাম্মদ সিরাজউদ্দিন উল্লেখ করেন যে, “যোগেশ্বরী হচ্ছে সাধিকা অর্থাৎ অটল যৌন সাধনার চধংংরাব ঈড়ঁহঃবৎঢ়ধৎঃ."১১ আবু জাফর তার গবেষণা অভিজ্ঞতায় মন্তব্য করেন-বাউলরা নিজেরা যে এক রাকাত নামাজ পড়ে বলে উল্লেখ করে সে এক রাকাতের মর্মার্থ হলো, নারীদেহকে জায়নামাজ জ্ঞানে সম্ভোগ’ এবং এই প্রেক্ষিতেই লালন বলেছেন, ‘আছে আদি মক্কাদেহ এই মানবদেহে’১৯। যদিও ওয়াকিল আহমেদ তার আলোচনায় বাউল তথা লালনের কয়েকটি গানের এক-দুই চরণ উল্লেখ করে বাউলদের নিষ্কাম প্রেমের সাধনার কথা বলেছেন। কিন্তু আবুল আহসান চৌধুরী, আহমেদ শরীফ, মুহাম্মদ সিরজউদ্দিন, সুধীর চক্রবর্তী প্রমুখের আলোচনা থেকে ওয়াকিল আহমেদের সিদ্ধান্তকে খুব একটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। অবশ্য ওয়াকিল আহমেদ নিজেও তাঁর গ্রন্থে স্বীকার করেন যে, বাউলরা আধ্যাত্ম প্রেমাস্বাদনের জন্য দেহজ প্রেমকে গ্রহণ করে যৌনচারিতা স্বাধীনতা নিয়ে আসে।৯
এই বাস্তবতায় বাউল মত একটি নিতান্তই লোকদর্শন, আদিম জনসাধারণের অনুরূপ এক জীবন দর্শন। তবে বাউল মতবাদ নিয়ে এই মূল্যায়নকে পূর্ণাঙ্গ বিবেচনা না করে এর প্রকৃতি ও বাস্তবতার সামগ্রিক সমাজতাত্ত্বিক মূল্যায়নের জন্য আমাদের এর উদ্ভব ও বিকাশের সামাজিক বাস্তবতা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রচলিত জীবন ও ধর্ম দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে বাউল মতবাদের উদ্ভব এবং বিকাশ। তবে এই যে জীবনবিমুখতা তা কিন্তু সমাজেরই সৃষ্টি। অরবিন্দ পোদ্দার এ সম্পর্কে বলেছেন, “সমাজের দাবী তারা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছেন।......এই প্রত্যাখ্যানের পশ্চাতে গভীর দুঃখবোধ সামাজিক ভেদ বিচারের নির্মম উৎপীড়ন বর্তমান ছিল, তা বলাই বাহুল্য। যারা উত্তর সাধন রূপে এই ভাবাদার্শ গ্রহন করেছেন এবং সামাজিক কর্ম-সম্পর্কের বাইরে আপনার ঠাঁই খুজে নিয়েছেন। তাদের ক্ষেত্রে না হলেও যারা প্রথম প্রবক্তা তার প্রত্যক্ষ কারন ছাড়া এ পথের পথিক হয়েছেন, এটা ভাবা কঠিন।”২০
এই বাস্তবতায় বাউলদের বিকাশের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো যেতে পারে। প্রাচীন ভারতবর্ষের হিন্দু জাতিভেদ বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ হয় তার একটি অংশ পরবর্তী সহজিয়া বৌদ্ধ ধর্মে রূপ নেয়। এবং এই সহজিয়া বৌদ্ধগন ক্রমান্বয়ে সহজিয়া বৈষ্ণবে পরিণত হন।
একটি বিষয় স্পষ্ট যে বাউল মতের উদ্ভব ও বিকাশের পেছনে যারা প্রথম প্রবক্তা, তারা ছিলেন সমাজকাঠামোর অবহেলিত নিচের দিকের মানুষ। সামাজিক শোষনের বিপরীতে প্রতিবাদ স্বরূপই বাউল মতের প্রবর্তন।
সুতরাং বলা যায়, জাতি-বর্ণ প্রথার যে সংকীর্ণতা এবং তৎসংলগ্ন যে আর্থ-সামাজিক শোষন সেখান থেকেই বাউল দর্শনের মূল চেতনা এসেছে, যাকে প্রচলিত সমাজরীতি ও দর্শন থেকে এক বিচ্যুতি হিসেবে বিবেচনা ব্যাখ্যা করা যায়। সমাজবিজ্ঞানী জ. ক. গবৎঃড়হ এর ধারনার প্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে দেখা যায়, তৎকালীন সমাজ কাঠামোর মূল ভিত্তি ছিল ধর্ম। আর এই ধর্মভিত্তিক সমাজকাঠামোয় নীচের দিকের মানুষের জন্য প্রচলিত সমাজ কাঠামো বা প্রাতিষ্ঠানিক উপায় খুবই সংকীর্ণ ছিল। ফলে তাদের পক্ষে সাংস্কৃতিক লক্ষ্য তথা সামাজিক সাফল্য ও মর্যাদা লাভের তেমন কোন সুযোগ ছিল না। এই দুয়ের অসামঞ্জস্যের বাস্তবতায় জবঃৎবধঃরংস ধারণার প্রেক্ষিতে নি¤œ বর্ণের মানুষেরা প্রচলিত ধর্ম এবং জীবনবোধকে ও জীবনাচারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বাউলরা এই প্রত্যাখ্যানের ধারাবাহিকতায় নতুন মূল্যবোধ প্রসারে সচেষ্ট হন। তাদের এই নব্য মূল্যবোধে প্রচলিত ঈশ্বরের ধারনাকে মানুষের স্বীয় সৃষ্টি বিবেচনা করে সর্বোচ্চ প্রধান্য দেয়া হয় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও সমতাকে। তাইতো তারা বলেন:
“আল্লাহ হরি ভজন পূজন
সকলি মানুষের সৃজন।”৯
গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস এর “কহড়ি ঞযুংবষভ” এর মতো বাউল দর্শন ও ধর্মের শুরুটাও নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে।
“আপনার খবর আপনার হয় না।
একবার আপনারে চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা।”২১
যে ‘পরমাত্মা’ বা ‘মনের মানুষ’ বাউলদের আরাধ্য তার পূর্ণ প্রাপ্তির প্রস্তুতি হিসাবেই তারা নিজেদেরকে আবিষ্কার করতে চান। একারনেই বাউল গেিন বলা হয়: “না জেনে ঘরের খবর তাকাও কেন আসমানে।’
তবে নিজেকে জানার প্রচেষ্টা যতটা না আত্মিক তার চেয়ে বেশি দৈহিক। লালন শাহের গানে পাওয়া যায়:
“উপাসনা নাইগো তার
দেহের সাধন সর্ব-সার
তীব্র-ব্রত যার জন্যে
এ দেহে তার সকল মিলে।”২১
তবে বাউলদের এই মতবাদ মারাত্মক সামাজিক প্রতিক্রয়ার জন্ম দেয়। মীর মোশাররফ হোসেন লিখেছিলেন:
“ঠেটা গুরু ঝুটা পীর
বালা হাতে নেড়ার ফকির
এরা আসলে শয়তান, কাফের বেইমান
তা কি তোমরা জান না।”১৫
আবার কবি জেনাব আলি বলেছিলেন: “লাঠি মার মাথে দাগাবাদ ফকিরের”। এ অংশগুলো থেকে বোঝা যায় যে, সমাজকাঠামোয় বাউল সমাপ্রদায়কে কখনোই সহজ ভাবে মেনে নেয়া হয় নে।
ভাটিয়ালী গান
ভাটিয়ালী বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় গান। বিশেষ করে নদ-নদী পূর্ণ ময়মনসিংহ অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোতেই ভাটিয়ালি গানের মূল সৃষ্টি, চর্চাস্থল এবং সেখানে এ গানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বাউলদের মতে ভাটিয়ালি গান হলো তাদের প্রকৃতিতত্ত্ব ভাগের গান। ভাটিয়ালি গানের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এ গানগুলো রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকা, দাড়, গুন ইত্যাদি বিষয়ে। সাথে থাকে গ্রামীন জীবন, গ্রামীন নারীর প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা, বিরহ, আকুলতা ইত্যাদির সম্মিলন। যেমন :
“আষাঢ় মাসে ভাষা পানি
পূবালি বাতসে,
বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি
আমার নি কেউ আসে।”
কিংবা
“নাই বাইয়া যাও ভাটিয়ালী নাইয়া
ভাটিয়ালী নদী দিয়া
আমার বন্ধুর খবর কইয়ো
আমি যাইতেছি মরিয়া।”৫

প্রেক্ষাপট
নদীমাতৃক দেশ এই বাংলাদেশ। নদীর সাথে এ দেশের মানুষের যোগসূত্র অত্যন্ত নিবিড়। তাই ভাটিয়ালী গানও এ দেশের প্রাণের গভীর চেতনা থেকে উৎসারিত একটি বিশিষ্ট সম্পদ। নদীর মাঝি বা নদী পাড়ের জনজীবনে এই গানের প্রচলন অত্যধিক। ভাটিয়ালী অর্থাৎ নদীর ¯স্রোতের টানে ভাটিয়ে যাওয়ার সুর এই গানে বিদ্যমান। নদীর ¯্রােতের সাথে আছে জীবনের চলার এক অপূর্ব সাদৃশ্য - স্রোতে সমুদ্রের দিকে চলেছে, উজানগামী সে কখনই নয়। জীবনও পরিণতির পথে এমনি প্রবাহমান যে, যে মুহূর্ত সে অতিক্রম করে সেটি আর ফিরে আসে না। বাংলার ভাটিয়ালী গানের কবি তাই বলেন,
“তরী ভাট্যায় পথ আর উজান না
মন মাঝি তোর বৈঠা নে’রে
আমি আর বাইতে পারলাম না।”৫
এ গান কবে কে রচনা করেছিলেন তা আর হাজার মাথা কুটেও জানবার উপায় নেই। কিন্তু এ গানে বাংলার মানুষের, নদীমাতৃক দেশের মানুেষর প্রাণের বাণীই ধরা পড়েছে। বাংলাদেশের লোক কবির কন্ঠে আমরা তাই শুনি,
“কূলে কূরে ঘুরিয়া বেড়াই আমি
পাইনা ঘাটের ঠিকানা
ডুব দিলাম না।”৫
বর্তমান ভাবনা
কিন্তু আধুনিক ভাটিয়ালী লোকসংগীতে এই মরমিয়া চেতনা এমনভাবে ধরা পড়তে দেখা যায় না। আধুনিক ভাটিয়ালি গান অনেকটা বস্তুমুখী চেতনায় সমৃদ্ধ - জীবনের সব সমস্যার ঊর্ধ্বে খাওয়া-পরার সমস্যা তাই প্রাধান্য লাভ করেছে। এখন নদীর মাঝি উজানে কোন বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে ভাটির দেশে যাবার সময় চিন্তা করে তার ক্রীত পণ্য নিয়ে ভাটির বন্দরে বিক্রি করে সে কত লাভ করবে। এমনকি নদীর মাঝি অথবা নৌকায় নৌকায় বসবাসরত সওদাগরের মনেও আজ এমনি লাভ-লোকসানের হিসাব প্রাধান্য লাভ করেছে। এই হিসাব ভাটিয়ালী গানেও প্রতিবিম্বত ও নতুন সুরে ঝংকৃত।২৩
সংগীত ব্যাক্তিত্ব
বাংলাদেশের ভাটিয়ালী গানের শিল্পী, রচয়িতা, সংগ্রাহক ও গীতিকারদের মধ্যে অন্যতম হলেন - মিরাজ আলী, উকিল মুন্সী, রশিদ উদ্দিন, জালাল খাঁ, জং বাহাদুর, শাহ আবদুল করিম, উমেদ আলী প্রমুখ।
ভাওয়াইয়া গান
ভাওয়াইয়া বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত এক প্রকার পল্লীগীতি। মূলত রংপুর এলাকার প্রত্যন্ত জনপদে এ গানের সৃষ্টি ও চর্চা রয়েছে। এ সকল গানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ গানগুলোতে স্থানীয় সংস্কৃতি, জনপদের জীবনযাত্রা, তাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ঘটনাবলী ইত্যাদির সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে। যেমন গরুর গাড়ি চালক বা গাড়িয়ালকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে -
“ওকি গাড়িয়াল ভাই, আস্তে বোলাও গাড়ি,
আরেক নজর দেখিবার নাও মুই বাপের বাড়িরে গাড়িয়াল।”৫
আবার রংপুরের ঐতিহ্যবাহী চিড়িয়াখানা নিয়ে -
“নিয়া ভাই একনা কতা কবার চাও,
অংপুর মুই যাবার চাও,
চিড়িয়াখানা দেখিয়া আনু হয়।”৫
উৎপত্তি
ভাওয়াইয়া গানের আকরভূমি রংপুর।২৪ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে নদী-নালা কম থাকায় গরুর গাড়িতে চলাচলের প্রচলন ছিল। আর গরুর গাড়ির গাড়োয়ান চলাবস্থায় বিরহ ভাবাবেগে কাতর হয়ে আপন মনে গান ধরে। উঁচু-নিঁচু রাস্তায় গাড়ির চাকা পড়লে তার গানের সুরে আধো-ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়ে। এই রকম সুরে ভাঁজ পড়া গীতরীতিই ‘ভাওয়াইয়া’ গানে লক্ষনীয়। প্রেম-বিয়োগে উদ্বেলিত গলার স্বর জড়িয়ে যেরকম হয়, সেরকম একটা সুরের ভাঁজ উঁচু স্বর হতে ক্রমশ নিচের দিকে নেমে আসে। সুরে ভাঁজ পড়া ভাওয়াইয়া গানের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। মাটির গান হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে ভাওয়াইয়া গানের। পিঠা পুলির উৎসবেও এ গানের প্রভাব পড়েছে। তেমনি একটা হলো -
“মনটাই মোর পিঠা খাবার চাই”২৫
জারি গান
জারি গান বাংলাদেশের এক প্রকারের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতরীতি। ফারসি জারি শব্দের অর্থ শোক। মুহাররম মাসে কারবালার বিযোগান্তক কাহিনীর স্মরনে মূলত এই গানের উদ্ভব। ১৭শ শতক থেকে বাংলায় এই গানের ধারা শুরু হয়।২৬
ইসলামের ইতিহাস ভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারার সর্বাধিক জনপ্রিয় পরিবেশনা রীতি হচ্ছে জারিগান। কারবালার যুদ্ধে শহীদ ইমাম হাসান, ইমাম হোসেন ও অন্যান্য চরিত্রের অন্তর্গত বেদনা নিয়ে এক ধরনেে আহাজারিমূলক সুরে সাধারণত নৃত্য সহযোগে জারিগান পরিবেশিত হয়ে থাকে। এক সময় সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন আঙ্গিকে জারিগানের প্রচলন ছিল। বর্তমানে এ ধরনের নাট্য পরিবেশনার প্রচলন পূর্বের ধারাবাহিকতার চেয়ে কিছুটা কমে গেলেও তা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। ‘জারিগান’ কথাটির ব্যাখ্যা - জারি শব্দটির অর্থ বিলাপ বা ক্রন্দন। এ শব্দটির উৎস-মূল ফারসি ভাষা।৬ তবে বাংলায় এসে শব্দটি ব্যপকতা লাভ করেছে। বাংলাদেশে মহররমের বিশেষ দিনে কারবালার শোকাবহ ঘটনা অবলম্বনে নৃত্যগীত সহকারে যে কাহিনী পরিবেশিত হয় তা সাধারণভাবে জারিগান বলে পরিচিত। এছাড়া যেকোন ধর্মীয়, অতিলৌকিক বা সামাজিক বিষয় নিয়ে রচিত গানকেও কখনও কখনও জারিগান নামে ডাকা হয়।
উদ্ভব ও বিকাশ
বাংলায় জারিগান পরিবেশনার উদ্ভবসূত্র আবিষ্কার করা হয় আনুমানিক পঞ্চদশ শতকের বৈঠক-রীতির ‘জঙ্গনামা’ পরিবেশনায়। গবেষকদের ধারণা, ‘জঙ্গনামা’ বৈঠকী-রীতির পরিবেশনা থেকে বিবর্তনের পথ ধরে অবশেষে ‘জারিগান’(শোকসঙ্গীত) নামে বাংলাদেশের স্থানীয় জনসমাজে প্রভূত খ্যাতি লাভ করে।২৬
অনুষ্ঠানের সময়
জারিগানের অনুষ্ঠানের প্রধান সময় হচ্ছে মহররম মাস। এই মাসে সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে জারিগানের আসর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সাধারণত মহররমের ৫ তারিখ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে প্রায় নিয়মিতভাবে জারিগানের আসর হয়।৫ জারিগান পরিবেশনার জন্য দিন-রাতের কোন বিধি নিষেধ নেই। তাই রাত ও দিন উভয় সময়েই জারিগানের আসর চলে। মহররম ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের মেলা, উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও কর্তমানে জারিগানের অনুষ্ঠান হয়।
জারিগানের কুশীলব
জারিগানের দলে যে সকল কুশীলব অভিনয় করেন তাদের একটা নাম আছে। এর শিল্পী-কুশীলবদের মধ্যে প্রধানত নৃত্যকারদেরকে কোথাও খেলোয়াড়, আবার কোথাও জারিয়াল এবং প্রধান গায়ককে প্রায় সব অঞ্চলে বয়াতী বলা হয়। এছাড়া জারিগানের নাচের দলের পরিচালককে বলা হয় রেফারি।৫ জরিগানের আসরে বৈচিত্র্য আনতে যখন নাচের গতি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় তখন এই রেফারিই বাঁশি ফুকে নাচের গতি পরিবর্তনে অগ্রনী ভুমিক পালন করেন।
পরিবেশনারীতি
সাধারণত সমতল ভূমিতে বৃত্তকার মঞ্চে সাদা ধূতি বা পাজামার সাথে সাদা গেঞ্জি পরে একজন গায়েন, সহযোগী গায়েন ও একদল নৃত্যকার-দোহার নৃত্যগীতের মাধ্যমে জারিগান পরিবেশন করেন। এই ধরণের নৃত্যগীতে অধিকাংশ সময় মূলগায়েন ও তার সহযোগী গায়েনের অবস্থান থাকে বৃত্তাকারে নৃত্যরত কুশীলবদের বাইরে। তবে সহযোগী গায়েনকে কখনও কখনও বৃত্তের কেন্দ্রে অবস্থান করতে দেখা যায়। জারিগান পরিবেশনকালে দোহার-নৃত্যকারগণ হাতে লাল রুমাল বা গামছা ব্যবহার করেন। শুধুমাত্র হাততালি, অঙ্গভঙ্গি ও রুমাল সঞ্চালনের মাধ্যমে জারিগান পরিবেশিত হয়। এর পরিবেশনাতে প্রায় সকল সময় অসাধারণ নৃত্য কৌশল প্রযুক্ত হয়ে থাকে। আসলে জারিতে গানের প্রতি চরনের সঙ্গে নৃত্যের তাল প্রত্যক্ষ করা যায়। কিশোর ও যুবক নৃত্যকারগণ কখনও পরস্পর সংঘবদ্ধ, কোমরে হাত দিয়ে বৃত্ত, রেখা ও সর্পিল গতিভঙ্গ সৃজন করে। এ শ্রেণীর জারিগান শূন্যে লম্ফদানের কৌশলদীপ্ত পৌরুষের পরিচয়বাহী। গবেষকগণ জারিগানের এ নৃত্যের সঙ্গে মণিপুরী লম্ফনৃত্য বা চৈনিক ব্যালের তুলনা করেছেন। জারিগানে সকল নৃত্যকারী সচরাচর পায়ে নূপুর পরে থাকেন।
সারি গান
সারি গান বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতগুলোর অন্যতম। সারি গান মূলত মাঝিদের গান হলেও বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষের মুখে এই গান শোনা যায়। এ গানকে গ্রাম্য ভাষায় নাওবাইচের গানও বলা হয়। নৌকাবাইচের সময় বৈঠাধারী সারিবদ্ধভাবে বসা মাঝিরা একে অপরকে উৎসাহ জোগানোর জন্য এ গান গেয়ে থাকেন। উৎসবের যাত্রাপথে অথবা ফিরতিপথে কিংবা বাইচের মহড়ায় চলে এ গানের চর্চা।
নৌকা বাইচের সময় প্রতিটি নৌকায় একজন করে সাইবদার অথবা পরিচালক থাকেন।৫ মূলত তিনিই গানের একেকটি পদ গেয়ে যান, নৌকার বৈঠাধারী মাঝিরা সেই সুর টেনে নেন দলবদ্ধভাবে। মূল গায়কের কাছে থাকে করতাল বা একতারা সাথে সংগত করেন একজন ঢুলী। এদের সাথে বৈঠাধারী সহগায়কেরা গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান গেয়ে যান।
বৈশিষ্ট্য
সুপ্রাচীনকাল থেকেই এদেশে কর্মের সাথে কিছু কিছু উৎসবের রেওয়াজ সম্পৃক্ত বা প্রচলিত হয়ে আসছে। যেমন : শ্রাবণ সংক্রান্তির দিন নৌকা বাইচের তালে বাইচালী গান অনুষ্ঠিত হয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্ষাকালের শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে নির্ধারিত তারিখে নির্দিষ্ট স্থানে নৌকা বাইচের আড়ঙ্গ-এ বাইচালি সারি গান শুনতে পাওয়া যায়। সারি গানকে এ অঞ্চলের হাইর গানও বলা হয়।এ গান সমবেত কন্ঠে গাওয়া হয় বলে এটি দলীয় গান। সারি গানের বৈশিষ্ট্য হলো - এর বিষয়বস্তু সবই হিন্দুস্তানি, কিন্তু এর গায়ক গোষ্ঠীর সকলেই মুসলমান।
চল বন্ধুয়ার দেশে যাইরে মাঝি ভাই
চল বন্ধুয়ার দেশে যাই
হেইয়াহো হেইয়াহো হেইয়াহো-
ময়ূরপঙ্খী নৌকা আমার চলছে বাতাস বইয়ারে ভাই
চলছে বাতাস বাইয়া
চল বন্ধুয়ার দেশে যাই
কলসী কাঁখে কুলবধুয়া চলছে ঘোমটা দিয়ারে মাঝি ভাই
চল বন্ধুয়ার দেশে যাই
হেইয়াহো হেইয়াহো হেইয়াহো-
হেইয়াহো ডাক শুনিয়া বধূ দেখে চাইয়া
কাঙ্খের কলসি ফেইলা দিয়ে ঘোমটা দেয় খুলিয়ারে মাঝি ভাই
চল বন্ধুয়ার দেশে যাই
হেইয়াহো হেইয়াহো হেইয়াহো-
নতুন বর চলছে আজি নৌকাতে চড়িয়া
পুলাপুরি দৌড়াতে চিনি কাইবার লাইগারে মাঝি ভাই
চল বন্ধুয়ার দেশে যাই
হেইয়াহো হেইয়াহো হেইয়াহো-
সাইডুলিতে বাইতে মাঝি সারিগান ধরে
সুরিয়া নদীতে চইলা গেলে মদনপুরের পাছেরে মাঝি ভাই
চল বন্ধুয়ার দেশে যাই।
হেইয়াহো হেইয়াহো হেইয়াহো।”
রবীন্দ্রসংগীত
রবীন্দ্র সংগীত হল বিশিষ্ট বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ও সুরারোপিত গান। বাংলা সংগীতের জগতে এই গানগুলি এক বিশেষ স্থানের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের ‘জনগনমন-অধিনায়ক জয় হে’ ও ‘আমার সোনার বাংলা’ গানদুটি যথাক্রমে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। ভারতে জাতীয় স্ত্রোত বন্দে মাতরম রবীন্দ্রনাথের-ই সুরারোপিত।
রবীন্দ্রনাথের রচিত মোট গানের সংখ্যা ১৯১৫।২৭ রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীতে উপনিষদ, হিন্দু পুরান ও সংস্কৃত কাব্য নাটক, বৈষ্ণব ও বাউল দর্শনের প্রভাব সুস্পষ্ট। সুরের দিক থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত(হিন্দস্তানী ও কর্ণাটকী উভয় প্রকারই), বাংলা লোকসংগীত, কীর্তন ও রামপ্রসাদী এবং পাশ্চাত্য ধ্রুপদী ও লোকসংগীতের “ত্রিবেণীসংগম” ঘটেছে রবীন্দ্র সংগীতে।২৮ রবীন্দ্রনাথের সমুদয় গান তার গীতবিতান গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। উক্ত গ্রন্থের প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ডে কবি গানগুলিকে “পূজা”, “স্বদেশ”, “প্রেম”, “প্রকৃতি”, “বিচিত্র”, “আনুষ্ঠানিক”- এই ছয়টি “পর্যায়ে” বিন্যস্ত করেছিলেন।২৭ কবির প্রয়াণের পর প্রথম দুটি খন্ডে গানগুলি নিয়ে গীতবিতান সংকলনের তৃতীয় খন্ড প্রকাশিত হয়। এই খন্ডে গানগুলি “গীতিনাট্য”, “নৃত্যনাট্য”, “ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী”, “নাট্যনীতি”, “জাতীয় সংগীত”, “পূজা ও প্রার্থনা”, “আনুষ্ঠানিক”, “প্রেম ও প্রকৃতি” ইত্যাদি পর্বে বিন্যস্ত হয়।২৭ ৬৪ খন্ডে প্রকাশিত স্বরবিতান গ্রন্থে তার সমুদয় গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের পরিবারে সংগীতের চর্চা ছিল মজ্জাগত। পিতা দেবেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের দাদারা নিয়মিত সংগীত চর্চা করতেন। তবে কিশোর রবীন্দ্রনাথের সংগীত শিক্ষায় সর্বাধিক প্রভাব ছিল তার “নতুনদাদা” জ্যোতিন্দ্রনাথের”।২৯ তের বছর বয়সে লেখা “গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে” গানটি সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের প্রথম রচিত গান। এরপর প্রায় সত্তর বছর ধরে তিনি অবিশ্রাম গীতিরচনা করেন স্বরচিত গান ছাড়াও সুরারোপ করেন বৈদিক স্তোত্র, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস ও অন্যান্যদের রচনায়। তার শেষ গান “হে নূতন দেখা দিক আর-বার” ১৯৪২ সালে কবি তার জীবনের শেষ জন্মদিন উপলক্ষ্যে রচনা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজেও ছিলেন সুগায়ক। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তিনি স্বরচিত গান গেয়ে শোনাতেন। কয়েকটি গান গ্রামাফোন ডিস্কে রেকর্ডও করেছিলেন। সংগীত প্রসঙ্গে একাধিক প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন কবি। সংগীতকে তিনি বিদ্যালয়-শিক্ষার পরিপূরক এক বিদ্যা মনে করতেন।৩০ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তার গানগুলি বাঙালি সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
বৈশিষ্ট্য
তিনি কেবল গীতিকার বা সুরকার নন, তিনি সংগীত¯্রষ্টা। রবীন্দ্র সংগীত কাব্য ও সুরের মধুর মিলনের অনন্য দৃষ্টান্ত। স্বরচিত অধিকাংশ গানে সুরারোপ করেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। “স্থায়ী”, “অন্তরা”, “সঞ্চারী”, এবং “আভোগ”- এই চারটি রূপবন্ধের ক্রমিক সমন্বয়ে যে একটি গান সম্পূর্ণ হয়ে তা তিনি সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন। তার এই উপলব্ধি সর্বভারতীয় সংগীত ঐতিহ্যেরই প্রতিফলন। তবে তিনি গানে “তান-বিস্তারের” অপরিহার্যতা অস্বীকার করে সংগীত রচনা করেছেন। তার গানে বিস্তার ব্যতিরেকেই সুর শব্দকে ছড়িয়ে বিশেষ ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। সুরের বৈশিষ্টেই তার গান রবীন্দ্র সংগীত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে প্রচলিত তালে সুর বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে অপ্রচলিত নানা তাল তিনি ব্যবহার করেছেন। তার কাছ থেকে পেয়েছি ১৫ মাত্রা, ১৭ মাত্রা, ১৮ মাত্রা, ১৯ মাত্রা ইত্যাদির বাংলা গান।৫ “সংদীতের মুক্তি ” নামের প্রবন্ধটি তার সংগীত চিন্তার দলিল।
রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী
রবীন্দ্র সংগীত বাংলার সংস্কৃতির এক প্রধান স্তম্ভ। আক্ষরিক অর্থে শত শত বাঙালি গায়ক গায়িকা এই গান গেয়ে বিখ্যাত হয়েছেন। কয়েকজন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হলেন - ইন্দুলেখা ঘোষ, পঙ্কজ মল্লিক, নলিনীকান্ত সরকার, রাজেশ্বনী দত্ত, মায়া সেন, নীলিমা সেন, অমিতা সেন, আরতি মুখোপাধ্যায়, চিত্রলেখা চেীধুরী, বন্দনা সিংহ শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কনক দাস, কণিকা মুখোপাধ্যায়, অশোকতরু বন্দোপাধ্যায়, অগ্নিভ বন্দোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, পাপিয়া সরোয়ার, মণৗষা মুরলী নায়ার, মনোজ মুরালী নায়ার, মালতি ঘোষাল, কে এল সায়গল, সুবিনয় রায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, সাগর সেন, সুমিত্রা সেন, ইন্দ্রানী সেন, শ্রাবনী সেন, অর্ঘ্য সেন, রুমা গুহঠাকুরতা, রাজেস্বর ভট্টাচার্য, কলিম শরাফী, কাদেরী কিবরিয়া, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, মিতা হক, লোপামুদ্রা মিত্র, স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত, শিবাজী চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত আচার্য, ম্রীরাধা বন্দোপাধ্যায়, সুপ্রতঅক দাশ, ঋতু গুহ, গীতা ঘটক, রেণুকা দাসগুপ্তা প্রমুখ।৬

নজরুল গীতি
নজরুলগীতি বা নজরুল সংগীত বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ কাজী নজরুল ইসলাম লিখিত গান। তার সীমিত কর্মজীবনে তিনি ৩০০০ এরও বেশি গান রচনা করেছেন।৫ পৃথিবীর কোন ভাষায় একক হাতে এত বেশি সংখ্যক গান রচনার উদাহরণ নেই। এ সকল গানের বড় একটি অংশ তার সুরারোপিত। তার রচিত ‘চল চল চল, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল’ বাংলাদেশের রণসংগীত। তার কিছু কিছু গান জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে গানের মালা, গুল বাগিচা, গীতি শতদল, বুলবুল ইত্যাদি। পরবর্তীকালে আরও গান সংগ্রন্থিত হয়েছে। তবে তিনি প্রায়শ তাৎক্ষনিকভাবে লিখতেন; এ কারনে অনুমান করা হয় প্রয়োজনীয় সংরক্ষনের অভাবে বহু গান হরিয়ে গেছে।
বৈশিষ্ট্য
নজরুলের আবির্ভাব ও কর্মকাল রবীন্দ্রযুগের অন্তর্ভুক্ত। তবু নজরুল রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয়ের সম্পূর্ণ বাইরে থেকে গীত রচনা করেছেন ও সুরারোপ করেছেন। তিনি বাংলা গানে বিচিত্র সুরের উৎস। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও একই সঙ্গে গীতিকার, সুরকার ও সুগায়ক। গানের সংখ্যায় তিনি রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে গেছেন।
শ্রেণীবিন্যাস
সকল নজরুল গীতি ১০ টি ভাগে বিভাজ্য। এগুলো হল Ñ ভক্তিমূলক গান, প্রণয়গীতি, প্রকৃতি বন্দনা, দেশাত্ববোধক গান, রাগপ্রধান গান, হাসির গান, ব্যাঙ্গাত্মক গান, সমবেত গান, রণ সংগীত এবং বিদেশীসুরশ্রিত গান।৫
নজরুলগীতির বিষয় ও সুরগত বৈচিত্র্য বর্ণনা করতে গিয়ে নজরুল-বিশেষজ্ঞ আবদুল আজিজ আল্ আমান লিখেছেন,“....গানগুলি এক গোত্রের নয়, বিভিন্ন শ্রেণীর। তিনি একাধারে রচনা করেছেন গজল গান, কাব্য সংগীত বা প্রেমগীতি, ঋতু সংগীত, খেয়াল, রাগপ্রধান, হাসির গান, কোরাস গান, দেশাত্মবোধক গান, গণসংগীত-শ্রমিক-কৃষকের গান, ধীবরের গান, ছাদপেটার গান, তরুণ বা ছাত্রদলের গান, মার্চ-সংগীত বা কুচকাওয়াজের গান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান, নারী জাগরণের গান, মুসলিম জাতির জাগরণের গান, শ্যামাসংগীত, কীর্তন, বৈষ্ণবপদাবলী, অন্যান্য ভক্তিগীতি, ইসলামী সংগীত, শিশু সংগীত, নৃত্য সংগীত, লোকগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, সাম্পানের গান, ঝুমুর, সাওতালী, লাউনী, কাজরী, বাউল, মুর্শেদী এবং আরও নান বর্ণের গান। বিভিন্ন বিদেশী সুরের আদলে রচিত গানের সংখ্যাও কম নয়। এ ছাড়া লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিনীকে অবলম্বন করে ‘হারামণি’ পর্যায়ের গান এবং নতুন সৃষ্ট রগ-রাগিনীর উপর ভিত্তি করে লেখা ‘নবরাগ’ পর্যায়ের গানগুলি নজরুলের সাংগীতিক প্রতিভার অসামান্য কৃতিত্বির পরিচয় বহন করে।৩১

নজরুলগীতি সংকলন
গানের মালা, গীতি শতদল, বুলবুল, বুলবুল (২য় খন্ড), গুল বাগিচা, চন্দ্রবিন্দু, চোখের চাতক, মহুয়ার গান, রাঙা জবা, সুরমুকুর, সুরসাকী।৬
ব্যান্ড মিউজিক
জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বাংলা সঙ্গীত নিয়ন্ত্রণ করছে ব্যান্ড মিউজিক। একসময় এটাকে অপসংস্কৃতি হিসেবে বলা হলেও ব্যান্ড সংগীত পরিণত হয়েছে অদম্য তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে।
এদেশে ব্যান্ড মিউজিকের শুরু ষাটের দশক থেকে। বিশ্ব তখন বিটলস জ্বরে ভুগছে। তার কতটুকু প্রভাব এদেশে পড়েছে তা জানা না গেলেও এখন পর্যন্ত ব্যান্ড গড়ার প্রথম যে কাহিনীটি জানা যায় তা সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে। গ্রেগরিয়ানরাই ১৯৬৩ সালে প্রথম ব্যান্ড তৈরি করে যার প্রথম উদ্যোক্তা ছিল ক্লাস এইটের ফজলে রব।৩২ তিনি তার এক এংলো ইন্ডিয়ান সহপাঠীর গিটার বাজানো দেখে মুগ্ধ হয়ে গিটারটা কিনে নেন। তার সেই সহপাঠীর নাম ছিল টেলফার জনসন।
ফজলে রবের সাথে এসে যোগ দেন রফিক, সাব্বির এবং আলমগীর। তারা মিলে যে ব্যান্ডটি গড়ে তুলেন সেটি বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৬৪ সালে ব্যান্ডের নাম করা হয় “আইওলাইটস”।৩২ ব্যান্ডটি শাহবাগ হোটেল (বর্তমান পিজি হসপিটাল) ও ঢাকা ক্লাবে নিয়মিত শো করত। আইওলাইটসের আলমগীর পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের জনপ্রিয় শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পান। আইওলেটসের ১৯৬৫ সালে প্রথম ঠেলিভিশন পারফর্ম করেন। ১৯৬৭ সালে প্রথম টিকিটের বিনিময়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টটিউটে কনসার্ট আয়োজন করে।৩২
সেন্ট গ্রেগরির আরেক ছাত্র ফরিদ রশীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে লাইটনিংস। চট্টগ্রামের হোটেল আগ্রবাদে এরা শো করত।
এর মাঝে নারায়ণগঞ্জে গড়ে ওঠে বাংলা নামের প্রথম ব্যান্ড ব-বাংলা।৩২ এই ব্যান্ডের জালাল আবেদীন পরবর্তীতে জিংগা শিল্পী গোষ্ঠীর সাথে জড়িয়ে পড়েন।
বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের পৃষ্ঠপোষকতায় সবচেয়ে সাহায্য করেছে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল যা বর্তমানে হোটেল শেরাটন নামে পরিচিত।
পূর্ব পাকিস্তানে কোন ফাইভ স্টার হোটেল না থাকার জন্য ঢাকায় ফাইভ স্টার হোটেল তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। এসব হোটেলের নিজস্ব ব্যান্ড থাকতো। এসময় এসময় একটি জার্মান ব্যান্ড পরিচিতি পায় যারা পরে ঢাকা রেডিওতে পারফর্ম করে। এর পাশাপাশি ব্লু শার্কস নামে একটি অস্ট্রেলিয়ান ব্যান্ড ব্যাপক পরিচিতি পায়।
ষাটের দশকের শেষের দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে ফলে বিদেশী ব্যান্ডগুলো পারফর্ম করতে চাইতো না। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটি রেস্তোরার ছোট ডায়াসে গানবাজনা হতে। এটি তখন চাম্বেলি রুম নামে পরিচিত এবং এই চাম্বেলি রুম ব্যান্ড মিউজিকির বিস্তারে স্মরণীয় কারন একে ঘিরেই এদেশি তরুনদের ব্যান্ড মিউজিকের নিয়মিত চর্চা হত।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পপ মিউজিকের ভিন্ন চেহারা পায়। সদ্য যুদ্ধ ফেরত এক তরুণ এসময় তার একেবারেই ভিন্নধর্মী কন্ঠের সাহায্যে মাত করে দেন। তার নাম আজম খান। ব্যান্ড মিউজিকের গুরু হিসেবে যিনি সবার কাছে পরিচিত। আজম খান এসময় গড়ে তোলেন তার ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’। আজম খানের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে কারন তিনি ব্যান্ড মিউজিককে হোটেল বা নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে এনে জনসাধারনের নিকট তুলে ধরেন।
ব্যান্ড বা সলো আর্টিস্ট হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখে ফিরোজ সাই, পিলু মমতাজ এবং ফকির আলমগীর। কিন্তু গুরু আজম খান যে ধারাটি নেতৃত্ব দেন তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। এসময় এদেশের প্রচুর তরুণ প্রতিভাবান মিউজিশিয়ানের জন্ম নেয় এবং স্বাধীনতার পর গড়ে উঠে আগলি ফেসেজ, আন্ডারগ্রাউন্ড পিস লাভার, স্পন্দন প্রভৃতি।
৭৫ এর মাঝামাঝি সময়ে কিছু বিদেশি ছেলের চেষ্টায় গড়ে ওঠে চিলড্রেন অফ গড, দেশি ছেলেরাও যোগ দেয় তাদের সাথে।৩২
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এলোমেলো হওয়ায় তার প্রভাব পড়ে ব্যান্ড মিউজিকে। ব্যান্ড মিউজিকের এ খরার সময় জন্ম নেয় ‘টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি’। এর পরের বছর তৈরি হয় ‘বারাক’।
এসময় তরুণ মিউজিশিয়ানদের মধ্যে খালেদ ওমর রুমী, হ্যাপী আখন্দ, ফেয়িাদ নাসের বাবু অন্যতম।৫
৭৬ এ একটি ব্যান্ড প্রতিযোগিতা হয় তাতে তিনটি বিষয়ে বিজয়ী হয় চট্টগ্রাম থেকে আসা ব্যান্ড ‘সোলস‘। এটি গড়ে ওঠে ১৯৭২ সালে এবং তখন এর নাম ছিল সুরেলা। নিয়মিত পারফর্ম করা ব্যান্ডের মাঝে সোলস এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পুরোনো।৩২
৭৯ তে বিখ্যাত সঙ্গিতশিল্পী ফিরোজা বেগম এবং কমল দাশ গুপ্ত পুত্রদ্বয় মিলে গড়ে তোলে ‘মাইলস’। মাইলসের জনপ্রিয়তা খুব অল্প সময়ে বৃদ্ধি পায়।৬
আইয়ূব বাচ্চুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে তার ব্যান্ড ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ সংক্ষেপে ‘এলআরবি’। কিন্তু এই নামে অস্ট্রেলিয়ান একটি ব্যান্ড থাকার কারনে পরবর্তীতে এর নাম বদলে রাখা হয় ‘লাভ রানস ব্লইন্ড’।
৮০ দশতে ব্যান্ড মিউজিক নতুন মাত্রা পায়। দূর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ভূমিকা ব্যান্ড মিউজিকের অনুকূলে ছিল না। কিন্তু অডিও ইন্ডাস্ট্রি ‘সাউন্ডটেক’ এবং ‘সারগাম’ এ বিষয়ে ব্যাপক সাহসী হওয়ায় গ্রামে গ্রামে বিস্তার লাভ করে।
বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকে মেয়েদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। এর মূল কারন যোগযোগ, ক্ষমতার অভাব এবং সামাজিক বাধা মোকাবেলা করে টিকে থাকা দুষ্কর। এরপরেও ঢাকার ‘সিলেসটিয়াল’, ভিকারুন্নেসা নূন কলেজের ছাত্রীদের ‘এনএসবিই’ এবং চট্টগ্রামের ব্যান্ড ‘ব্লুকাডর্’ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। এনএসবিই হোটেল শেরাটনে পারফর্ম করে, ব্লু বার্ড ওপেন এয়াল কনসার্টে অংশগ্রহন করে এবং সিলেসটিয়াল টিভি শো করে। তবে এদের অস্তিত্ব এখন আর নেই।
৮০ এর দশকে অজ¯্র জনপ্রিয় কয়েকটি ব্যান্ডের নাম হলো - ফিলিংস (বর্তমানে নগরবাউল), এরআরবি, মাইলস, সোলস, রেনেসাঁ, আর্ক, নোভা, উইনিং, পেপার রাইম, ডিফরেন্ট টাচ, ইন ঢাকা, ফেইথ, সাডেন, ফিডব্যাক, প্রমিথিউস, চাইম, ওয়ারফেজ, ওয়েভস ইত্যাদি।৫ এর অনেকগুলোই বর্তমানে ভেঙে গেছে।
ব্যান্ড মিউজিক মানে এখন শুধু প্রেমের গান নয় সমাজের প্রতিটি বিষয় এখানে জায়গা পাচ্ছে। ব্যান্ডগুলোর কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য গড়ে উঠেছে ‘বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড এসোসিয়েশন’ বা বামবা। বামবার সদস্য হওয়া যেকোন ব্যান্ডের জন্য সম্মানজনক ব্যাপার।
গম্ভীরা
গম্ভীরা বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের অন্যতম ধারা। বাংলাদেশের রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ ও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ অঞ্চলে গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। ড. প্রদ্যোৎ ঘোষ গম্ভীরা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত যে অর্থ করেছেন তা হল -শিবের মন্দির, গাজন ঘর, গাজন উৎসব। সনাতন ধর্মালম্বীদের অন্যতম পূজ্যা দেবতা শিব। শিবের এক নাম ‘গম্ভীর’। কাজেই এককালে শিবের বন্দনা করে যে গান গাওয়া হত- সেই গানের নামই কালক্রমে হয়ে যায় -“গম্ভীরা”। শিব > গম্ভীর > গম্ভীরা। গম্ভীরা দলবদ্ধভাবে গাওয়া হয়। এটি বর্ণনামূলক গান। রাজশাহী অঞ্চলের গম্ভীরার মুখ্য চরিত্রে নানা-নাতি খুব জনপ্রিয়।
উৎপত্তি
গম্ভীরা গানের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায়। মধ্যযুগীয় সনাতন বিশ্বাসে শিবকে সুখ-দুঃখের নির্বিকার প্রতীক হিসেবে মনে করা হত। গানের সুরে সুরে দেবদেবীকে সম্বোধন করে বলা হতে থাকে গ্রামীণ দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষের সুখ-দুঃখ। কখনও কখনও সারা বছরের প্রধান প্রধান ঘটনা এ গানের মাধ্যমে আলোচিত হত। পালা-গম্ভীরায় অভিনয়ের মাধ্যমে এক একটা সমস্যা তুলে ধরা হত। চৈত্র-সংক্রান্তিতে বছরের সালতামামি উপলক্ষে পালা-গম্ভীরা পরিবেশন করা হত।৬ পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে গম্ভীরা টিকে রইল। তারপর থেকে গম্ভীরা গানের পৃষ্ঠপোষক হয় মুসলিম সমাজ। ফলত গানের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর পরিবর্তন হয়ে ওঠে অনিবার্য। যেমন - আগে গম্ভীরা গানের আসরে শিবের অস্তিত্ব কল্পনা করা হত, কিন্তু বর্তমানে শিবের পরিবর্তে ‘নানা-নাতির’ ভূমিকায় দুজন অভিনয় করে। কাজেই, গানটা সম্পূর্ণ মর্ত্তের মানুষের হয়ে গেল। দেবতারা সব তফাতে গেলেন। নানার মুখে পাকা দাড়ি , মাথায় মাথাল, পরনে লুঙ্গি, হাতে লাঠি। আর নাতির পোশাক ছেঁড়া গেঞ্জি,কোমরে গামছা ইত্যাদি। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের ছবি। ‘নানা-নাতি’র সংলাপ ও গানের মধ্য দিয়ে দ্বৈতভাবে গম্ভীরা গান পরিবেশিত হয়।৬
বৈশিষ্ট্য
বাংলার লোকসঙ্গীতের মধ্যে গম্ভীরাই সবচেয়ে বেশি জনমানুষসংশ্লিষ্ট গান। কেননা, এ গানে গ্রামীণজীবনের সমস্যা তুলে ধরা হয় ও সমাধানও বলে দেয়া হয়। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সংলাপ ও গানের মাধ্যমে কোন একটি বিষয় তুলে ধরা হয়। গানের একটি ধুয়া থকে; সংলাপের ফাকে ফাকে গানগুলি ধুয়ার সুরে গীত হয়। গম্ভীরা গানে প্রধানত গ্রামীন সমাজের নানা দোষ-ত্রুটি উঠে আসে। গম্ভীরা গানে প্রথমে বন্দনা করা হয়। আগে শিবের বন্দনা করা হত তবে বর্তমানে বন্দনা যুগোপযোগী বিষয়ভিত্তিক। যেমন -
‘কাদবি কতকাল, মা তোর কি জঞ্জাল
মাগো তোর অর্ডারে যুদ্ধ হলো
কত রক্ত দিয়ে স্বাধীন হল
কত সেনা আইলো গ্যালো
মোরা হইনু শুধু নাজেহাল।
বন্দনার পরে গম্ভীরা গান শুরু হয়। নান-নাতি ছাড়াও গম্ভীরা গানে থাকে ১) দোহার ছয় সাত জন, ২) হারমোনিয়াম বাদক একজন, ৩) তবলা বাদক একজন, ৪) জুড়ি বাদক একজন।


বাংলা সঙ্গীতের পুনর্জাগরণ

এই উপমহাদেশীয় সঙ্গীতের সহ¯্র বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুগে যুগে সঙ্গীতাঙ্গনে চরম দুরাবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে এবং সেই দুরবস্থা দর্শনে শিক্ষিত সংস্কৃতিবান ব্যক্তিবর্গ সুস্থ পরিবেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সুরুচি সম্পন্ন সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বিভিন্নভাবে। শিল্পকলার বিবিধ শাখা-প্রশাখায় পৃষ্ঠপোষকতার মূল্য যে কি অপরিসীম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ কথা সত্য সঙ্গীত সমকালীন চেতনায়, ধ্যান ধারণায় বিকশিত হয়। সঙ্গীত কুয়োর জল নয়, এ এক বহতা নদী। সময়ের বিচারে ভালো-মন্দের প্রকারভেদ বিবেচিত, যা ভালো তা রয়ে যায় এবং মন্দ, অপসংস্কৃতি আবর্জনার স্তুপে প্রক্ষিপ্ত হয়। তবে বর্তমানকালে যারা চলতি হাওয়ার পন্থী তারা গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসমান। ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা আত্মবিস্মৃত। সঙ্গীত তাদের কাছে হয়ত আনন্দের উপকরণ মাত্র এবং সঙ্গীত যাদের কাছে মুনাফার বস্তু সেই শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের কাছে তারা আত্মবিক্রীত। সেই সুযোগে কর্পোরেট পুঁজি বিজ্ঞাপনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছে সঙ্গীতকে। এর ফলে অতি সেহজেই সঙ্গীতের কলা মর্যাদা নষ্ট হয়ে বাজারে পণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক বিকাশে যুগের চাহিদার কাছে সর্বোতভাবে সমর্পিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
বাংলা গানের বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, আমরা কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। কিছুদিন আগেও এক্ষেত্রে কিছুটা নৈশব্দ বিরাজমান ছিল।
ভালো-মন্দ কোন কিছুতেই যেন কারো কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না। তবে আশার কথা সেই নির্বিকার মানসিকতার এখন কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। গুণগ্রাহী বিদগ্ধ সমাজের উৎসাহ-উদ্দীপনা শিল্পীর শিল্পচেতনার উন্মেষ ঘটায়। তেমনি প্রচার মাধ্যমসহ ব্যাক্তি প্রতিষ্ঠান সঙ্গীতের বর্তমান পুনর্জাগরণকে ইতবাচক হিসেবে দেখছে।
সঙ্গীত মানুষকে নিয়ে যেতে পারে তার আত্মার কাছে, তুলে ধরতে পারে একটি জনপদের আবেগ, আকাক্সক্ষা, বিজয়কে। সঙ্গীতের প্রচলন প্রাচীন, মানুষের ভাষা সৃষ্টির আগে সঙ্গীতের উদ্ভব। সুপ্রাচীন সভ্যতার মত সঙ্গীতের ক্রমবিকাশ বিভিন্ন ধারায় উৎকর্ষ লাভ করেছে। অন্যদিকে সংস্কৃতি জাতির দর্পন। সংস্কৃতির দিকনির্দেশনার ওপরই দেশ ও জাতির পরিচয় নিহিত। সুতরাং সংস্কৃতির অঙ্গ সঙ্গীতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও রূপ থাকতে হবে।
আর এটাই সঙ্গীতের অস্তিত্ব। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রাচীন। সংস্কৃতির উৎকর্ষের পাশাপাশি সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও উৎকর্ষ বিকাশ লাভ করেছে। মানুষের সমাজে সঙ্গীতের জন্ম। ধীরে ধীরে কালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গীত জন্ম ও পরিপুষ্ট লাভ করেছে। সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে শিল্প ও সংস্কৃতির মান হয় উন্নত। বাংলাদেশের সঙ্গীতের ক্রমবিকাশের ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়। আর এ কথাও সত্য যে কোন দেশের সঙ্গীতই এক দিনে গড়ে ওঠেনি। এ সব হচ্ছে দীর্ঘ সাধনার ফসল। বাংলাদেশের সঙ্গীতও আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে ক্রমে ক্রমে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে । বাঙালির সঙ্গীত বিশ্বসঙ্গীত ভুবনে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। বাংলা গানের ¯্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ যে আমাদের বাংলা ভাষাকে ধন্য করেছেন সেটা তো আমরা হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। সঙ্গীত সবসময়ই এ দেশের মানুষের জীবনচর্চার তথা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সিংহভাগের দাবিদার। তাই তো আমাদের বাংলা সঙ্গীতের ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করতে পারি। যুগে যুগে কত সুর ¯্রষ্টার জন্ম হয়েছে, বাংলার পথে পথে, তার কোন হিসাব নেই। নানা সময়ে নানা প্রেক্ষাপটে এই জনপদের মানুষ সুরের মাধ্যমে তুলে ধরেছে তাদের জীবননোধ, চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখ, বেদনা-ভালবাসার কথা। পাট-ধানের ভান্ডারের মত সমৃদ্ধশালী আমাদের সঙ্গীতভান্ডার। এ দশের মাটির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে সুর। কাল, যুগ ভেদ করে এসব সুর ছুয়ে যায় মানুষের মন ও মনন। তাই তো আজ বিশ্বায়নের যুগেও হাজারো সঙ্গীতের ভিড়ে আমাদের লোকায়ত বাংলার চিরন্তন সুর মাথা উচু করে দাড়ায়। ইথারে ইথারে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে রূপে, রসে, গন্ধে পরিপূর্ণ হয়ে ফিরে আসে বারবার আমদের সঙ্গীতের ভুবনে। তাই তো পরিবর্তনের পালে লেগেছে হাওয়া। সঙ্গীতের আকাশটাও বদলাতে শুরু করেছে। পুরোনো বাংলা গানের পুনর্জাগরণ ঘটছে। সুস্থ সংস্কৃতির আলোয় আরো উদ্ভাসিত হবে আমাদের বাংলাদেশ। স্বপ্ন দেখা সংস্কৃতিসীমা মানুষগুলো তাই সঙ্গীতসহ সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় কিছু কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভব করেন। প্রযুক্তির বিস্ফোরণ, বাণিজ্যের বিশ্বায়ণ প্রভৃতি সার্বিকভাবে আমাদের মধ্যে যে ভোগবাদী মানসিকতার জন্ম দিয়েছিল, তার প্রভাবে শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও শিল্পের চেয়ে বিনোদনের কদর হয়েছে বেশি। ফলে আমাদের গানের যে নান্দনিক ঐতিহ্য, তা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি আমরা। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যাবধানটা এ জায়গাতেই বেশি। পরিমানে পেয়েছি বেশি, মানে পেয়েছি কম। তবে আশার কথা, সাম্প্রতিককাল পরিবর্তনের কিছুটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চলচ্চিত্রে, মূল ধারা গানে, বিশেষ করে ব্যান্ড সঙ্গীতে। প্রাথমিক অস্থিরতা কাটিয়ে এখন অনেকটাই সুবিন্যাস্ত হয়েছে আমাদের গানের এই শাখাটি। কথা ও সুরারোপের ক্ষেত্রেই পরিমার্জনার ছাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে গায়কি, উচ্চারণ প্রভৃতিতে পশ্চিমা ঢঙের অনুকরণ থেকে মুক্ত হতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি সংস্কৃতি কুয়োর জল নয়। সংস্কৃতি হচ্ছে বহতা নদী। বিশ্বের যা কিছু সুন্দর ও কল্যানকর তা আমার গ্রহণ করবো আবার যা কিছু অনাসৃষ্টি, অপসংস্কৃতি তাকে প্রত্যাখ্যান করবো। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি হচ্ছে আমাদের রক্ষাকবজ। কিছুদি আগেও সঙ্গীত ভুবনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, যে অস্থিরতা ও অরজাকতা বিরাজ করছিল, তা এখন অনেকটা দূর হয়েছে। সঙ্গীতের লালন ও পৃষ্ঠপোষকতা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। সবার মধ্যে দ্রুত তারকা হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। অবশেষে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিরাজমান শূন্যতা দূরীকরণে প্রয়োজনীয় গতিশীল উদ্যোগ নিয়ে অনেকেই এগিয়ে আসেন। এ ক্ষেত্রে মিডিয়া এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসেন অনেক সংস্থা, প্রতিষ্ঠান।
এ ছাড়া বাংলাদেশের সংস্কৃতির ওপর বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন পরিদৃষ্ট হয়েছিল। বিশেষ করে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিদেশি সঙ্গীতের অনুপ্রবেশ ও প্রভাব লক্ষ করা গেছে। বাংলা সঙ্গীতের পুনর্জাগরণে এখন অনেকটাই প্রেক্ষাপট পাল্টিয়েছে। আসলে বিদেশি সঙ্গীতের আগ্রাসন রোধ করার ক্ষেত্রে নিজস্ব সাঙ্গিতিক ঐতিহ্য তুলে ধরার কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্য এ দেশের লোকসঙ্গীত। হাজার বছর ধরে এই ঐতিহ্য লালিত। এ ছাড়া বাংলা গান রূপ পরিবর্তন করে যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার উপাদানে সমৃদ্ধ। তাই তো সঙ্গীত আমাদের অতি বিশ্বস্ত-সুহৃদ এবং সহচর।
যা হোক বাংলা গানের পুনর্জাগরণ একবার ঘটেছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদশে, যুদ্ধ ফেরত কিছু তরুণ ফকির আলমগীর, পাশ্চাত্য সুরের সঙ্গে দেশজ সঙ্গীতের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এই জনপদে পপ সঙ্গীতের এক আধুনিক ধারার সূচনা করে, যার ধারাবাহিকতায় আজকের ব্যান্ডসঙ্গীত। তাই সময়ের সঙ্গে নানামুখী পরিবর্তন ঘটেছে বিশ্বসঙ্গীত তথা আমাদের সঙ্গীতে। যার ছোয়া লেগেছে লোকসঙ্গীতেও।
আধুনিক যন্ত্রানুষঙ্গে নতুন স্বাদে শ্রোতাদের কাছে আসছে লোকসুর। নতুন প্রজন্মও বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করেছে গানগুলো। হিন্দিগানের যুগে লোকসঙ্গীতের জনপ্রিয়তা এর শ্রেষ্ঠত্বই প্রমান করে। নাগরিক মঞ্চের আধুনিকতম তরুণ-তরুণীরা আজ লোকসুরের টানে মাতোয়ারা হচ্ছে। অনেক ব্যান্ডশিল্পীও এদিকে ঝুকছে। বিভিন্ন সময়ে অনেক চলচ্চিত্রেও পুরোনো লোকগান ব্যবহৃত হয়। এতে করে গানগুলোর যেমন পুনর্জাগরণ হয়, তেমনি লাভবান হয় দেশের চলচ্চিত্র ও অডিও শিল্পী। যার সর্বশেষ উদাহরণ ‘মনের মানুষ’।
এ ছাড়া ‘মনপুরা’ ছবিতেও লোকসুরের প্রতি মানুষের ভালবাসার প্রমাণ মেলে। ‘যাও পাখি বল তারে’, ‘সোনার ময়না পাখি’, ‘নিথুয়া পাথারে’, ‘সাম্পানওয়ালা’ ইত্যাদি লোকগানের পাশাপাশি আলোচিত এসব গানের শিল্পী চন্দনা মজুমদার, কৃষ্ণকলি, ফজলুর রহমান বাবু, অর্ণব, সোনিয়া প্রমুখ। হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবিতে বারী সিদ্দিকির কন্ঠে স্থান পায় ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘সোয়াচান পাখি’ গানগুলো। চাষী নজরুল হাছন রাজা ছবিতে হাছন রাজার গানগুলো শ্রোতা দর্শকদের নতুনভাবে আলোড়িত করে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে চলচ্চিত্র এবং অডিওতে পুরোনো লোকগান ব্যাপক সাড়া জাগায়। রহমান বয়াতির এবং ফকির আলমগীরের ‘মন আমার দেহঘড়ি’, চাইমের ‘নাতি খাতি বেলা গেল’, ফিডব্যাকের ‘প্রেম রসিক হবো’, ‘মেলায় যাইরে’ ৯০ এর দশকে তরুণ প্রজন্মের কাছে সাড়া জাগায়। এ ছাড়া সেলিম চৌধুরীর ‘আজ পাশা খেলবোরে শ্যাম’, দিলরুবা খানের ‘পাগলমন’, দলছুটের শাহ আবদুল করিমের লেখা ‘গাড়ি চলে না, চলে না রে’ ইত্যাদি গানগুলো জনমনে সাড়া জাগায়। ২০০৫ সালে তরুণ কম্পোজার ফেরদৌস ওয়াহিদ তনয় হাবিব ওহায়িদ নতুন করে শাহ আবদুল করিমের বেশ কয়েকটি গান ভিন্ন স্বাদে শ্রোতাদের উপহার দেন। লন্ডন প্রবাসী শিল্পী কায়া ও হাবিব পরিচিতি পান। ২০০৭ সালে হাবিবের কম্পোজিশনে নতুন অ্যালবাম ‘পাঞ্জাবীওয়ালা’, বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গীতায়োজনে ‘সোনা বন্ধু তুই আমারে’ অ্যালবাম করেন সন্দীপন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিল্পী ‘দয়ালবাবা’, ‘তুমি কোনবা দ্যাশে’, ‘আমার অন্তরায় আমার কলিজায়’, ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া ’, শোনগো রূপসী কন্যা’ ইত্যাদি গান করে পরিচিতি পান। প্রতিভা অন্বেষনের মধ্য দিয়েও আমরা অনেক শিল্পী ও ভালো ভালো গানের সন্ধান পেয়েছি। মমতাজ, সোনিয়া, হাবিব, অর্ণব, বালাম, জুলি, বাপ্পা, সালমা, নোলক, বিউটি, পলাশ, রিংকু, নির্ঝর ,মেহেদী, অভি, মিলা প্রমুখ সেই সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে।


বাংলা সঙ্গীতের ঐতিহ্য হাজার বছরের। অনন্তকাল ধরে এগুলো মানুষের মনের খোরাক মিটিয়ে আসছে। বিশ্বায়নের যুগে আমাদের সঙ্গীত বাইরের দেশের সঙ্গীতের দ্বারা প্রভাবান্বিত। তাই আমাদের উচিত নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রেখে অপর সংস্কৃতির ভাল দিকগুলো গ্রহণ করা এবং খারাপ দিকগলো অর্থাৎ যা অপসংস্কৃতি সেগুলো বর্জন করা। আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশে সঙ্গীতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলার গান, বাংলাদেশের গান বাঙালি শ্রোতাদের কাছে এক মোহময় ভুবনে স্থান করেছে নিঃন্দেহে। সঙ্গীতের বিকাশের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সম্ভব। তাই আমাদের নিজস্ব ধারার সঙ্গীত রক্ষা ও পরিচর্যার জন্য সকলকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নিছক স্বপ্ন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮



©কাজী ফাতেমা ছবি
তারপর তুমি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব
চোখ খুলে স্মিত হাসি তোমার ঠোঁটে
তুমি ভুলেই যাবে পিছনে ফেলে আসা সব গল্প,
সাদা পথে হেঁটে যাব আমরা কত সভ্যতা পিছনে ফেলে
কত সহজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদম চুপ. দেশে আওয়ামী উন্নয়ন হচ্ছে তো?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৯



টাকার দাম কমবে যতো ততোই এটিএম বুথে গ্রাহকরা বেশি টাকা তোলার লিমিট পাবে।
এরপর দেখা যাবে দু তিন জন গ্রাহক‍কেই চাহিদা মতো টাকা দিতে গেলে এটিএম খালি। সকলেই লাখ টাকা তুলবে।
তখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×