somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জার্মানির ডায়রি-১২: প্রফেসর!

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

- আসতে পারি স্যার?
- কি ব্যাপার?
- স্লামালেকুম স্যার! ইয়ে মানে স্যার, একটা রিকম্যান্ডেশন লেটার...
- একটু ব্যস্ত আছি, তুমি সামনের সপ্তাহে এসো।

এক সপ্তাহ পর। স্যারের রুমে কেউ নেই। অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, স্যার এই সপ্তাহে ছুটিতে আছেন, পরের সপ্তাহে ফিরবেন।

আরও এক সপ্তাহ পর। এইবার স্যারকে পাওয়া গেল।
- আসতে পারি স্যার?
- কি ব্যাপার?
- স্লামালেকুম স্যার! মানে স্যার, একটা রিকম্যান্ডেশন লেটার...
- একটু ব্যস্ত আছি, তুমি সামনের সপ্তাহে এসো।
- মানে স্যার, আমি দুই সপ্তাহ আগেও একবার নক করেছিলাম। আপনি বললেন পরের সপ্তাহে আসতে...
- ও আচ্ছা, এসো ভেতরে। লিখে এনেছ রিকম্যান্ডেশন লেটার?
- স্যার, জার্মানিতে মাস্টার্সের জন্য এপ্লাই করছি। ওখানকার ইউনিভার্সিটি থেকে বলল যেসব প্রফেসরের আন্ডারে ব্যাচেলর থিসিস করেছি, তিনি আমার একাডেমিক পারফর্মেন্স নিয়ে কিছু যেন লিখে দেন।
- সেটা বুঝছি, কিন্তু তুমি কি কোন ড্রাফট লিখে এনেছ? সবার জন্য আলাদা করে রিকম্যান্ডেশন লেটার লেখা কি সম্ভব আমার একার পক্ষে? তুমি একটা কিছু লিখে নিয়ে পরের সপ্তাহে এসো। আমি দেখে সাইন করে দেব।

একটু বিব্রত বোধ করি। মানে স্যার বলছেন আমার নিজের রিকম্যান্ডেশন লেটার নিজেই লিখব!

এই সময় স্যারের সেলফোন বেজে উঠল।
-প্রফেসর “...” বলছি।
- হ্যাঁ, স্যার, কেমন আছেন?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, সময় আছে স্যার। কোন সমস্যা নেই। কবে থেকে ক্লাস নিতে হবে?

আমাকে স্যার হাতের ইশারায় যেতে বললেন। অন্য পাশের কথা শুনতে না পারলেও যেতে যেতে স্যারের কথা বেশ শুনছিলাম,

- ওসব নিয়ে আপনি কিচ্ছু ভাববেন না স্যার। এনএসইউ কাভার দেবার ভার আমার।

স্যার কাকে এতো স্যার স্যার করছিলেন! এনএসইউ, ক্লাস নিতে সমস্যা নেই...! পরে বন্ধু বান্ধবের কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম, উনি বুয়েট ছাড়াও আরও দুই-তিনটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে খ্যাপ দিয়ে বেড়ান।

অবশেষে মাস খানেকের মধ্যেই নিজের রিকম্যান্ডেশন লেটার নিজে লিখে স্যারের ব্যস্ত সময়ের মাঝে একটা সইও ম্যানেজ করে ফেললাম। আরেকটা লেটারের দরকার ছিল। সব স্যাররা অবশ্য এতো বেশী ব্যস্ত থাকেন না, আরেকটা সই যোগাড় করে আবেদন পত্র পাঠিয়ে দিলাম জার্মানিতে।
------------------------------------------------------------------
ছয়-সাত মাস পরের কথা। ২০০২ সালের এপ্রিল মাস। এডমিশন নিয়ে শেষ মেশ জার্মানিতে চলে এসেছি কয়েক সপ্তাহ হল। নিজের লেখা রিকম্যান্ডেশন লেটারেই কাজ হয়েছে, যতটা ভয় পাচ্ছিলাম সেরকম কিছু হয় নি। আমাদের ড্রেসডেন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসছেন এক পূর্ব পরিচিত বড় ভাই, স্কলারশিপ নিয়ে। তার জন্য অপেক্ষা করছি রেলওয়ে স্টেশনে।

কামাল ভাইকে বার বার করে ইমেইল করেছি, ড্রেসডেন আসার পর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পিক করব। সাথে নিশ্চয়ই ভারি মালপত্র থাকবে, এখানে মাল টানার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না। আমি থাকতে তার কোন চিন্তা নেই।

কামাল ভাই অবশ্য খুব চটপটে আর স্মার্ট ছেলে। উনি ইউনিভার্সিটির কোর্স কোঅরডিনেটরকে বিশাল মেইল করে লিখলেন, তিনি একজন স্কলারশিপ হোল্ডার। রেকর্ড রেজাল্ট নিয়ে মেধাবী ছাত্রের পরিচয় দিয়ে এই প্রথম বিদেশে আসছেন। এখানে আসার পর তাকে ইউনিভার্সিটির তরফ থেকে রিসিভ করবে কেউ –এটা তিনি প্রত্যাশা করেন। বাংলাদেশে কোন ছেলে যদি জার্মানি থেকে আসত স্কলারশিপ নিয়ে, তাহলে তার জন্য আরও অনেক বন্দোবস্ত থাকত, ইত্যাদি ইত্যাদি।

দুইদিন আগে কামাল ভাইয়ের শেষ ইমেইল পেয়েছি। “আদনান, কঠিন অবস্থা। ড্রেসডেন ইউনিভার্সিটি আমার ইমেইলের ঝাড়ি খাইয়া মাথা খারাপ। কাকে নাকি ঠিক করে পাঠাবে আমাকে রিসিভ করার জন্য। তুমি না আসলেও চলবে, তবে আমাকে রিসিভ করতে লোক আসছে - এমন একটা ছবি তোলার জন্য আসতে পার।“
আপাতত কঠিন অবস্থা দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।

কামাল ভাই ট্রেন থেকে নামার একটু পরেই দেখা গেল তিনি ফাঁকা বকেন নি। একজন মধ্য বয়সী জার্মান ভদ্রলোক তার জন্য অপেক্ষা করছে স্টেশনে। তাঁর ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক, চমৎকার উচ্চারণের ইংরেজিতে তিনি কামাল ভাইকে সম্ভাদন জানালেন। কামাল ভাইয়ের মুখে বিশ্বজয়ীর হাসি, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বুঝলে আদনান, স্কলারশিপ পাবার ভাবটাই আলাদা।

সাথে বিশাল সাইজের দুইটা সুটকেস দেখিয়ে বললেন, খবরদার, তুমি কিছু টানা টানি করবা না। ওঁরা লোক পাঠিয়েছে খরচ করে, এই বেটাই সব টানবে।

আমি কামাল ভাইয়ের ভাব সাব দেখে মুগ্ধ। জার্মান ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে এসেছেন, মালপত্র সহ আমাদেরকে পৌঁছে দিলেন কামাল ভাইয়ের হোস্টেল পর্যন্ত। সেখানে লিফট নেই, চার তলা পর্যন্ত ভারী লাগেজ টেনে তুললেন। কামাল ভাই আর আমি ল্যাপটপ আর ক্যামেরা টাইপ হালকা জিনিস পত্র নিয়ে হেলে দুলে উঠলাম।

পরের দিন কামাল ভাইয়ের সাথে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে দেখা। উনার মুখ বেজায় গম্ভীর।

- কি খবর ভাই, মুখ চোখ কালো কেন, রাতে ঘুম হয়নি ভাল মতো?
- না, ঘুম ঠিক হইসে।
- তাহলে, ব্যাপার কি ভাই?
- একটা ঝামেলা হইসে আদনান।
- কি ঝামেলা ভাই?
- কালকে যে জার্মান আমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসল, মাল টাল উপরে উঠিয়ে দিল, মনে আছে না?
- হু, আছে।
- আজকে ক্লাসে গিয়া দেখি সেই আমাদের প্রফেসর!

-------------------------------------------------
পুনশ্চঃ কামাল ভাই (ছদ্মনাম) ভালো গ্রেড নিয়েই শেষ করেছিলেন তার এমএস। সেই প্রফেসর তাকে এই ঘটনার জন্য গ্রেড কম দেন নাই। এই দেশের প্রফেসররা সামান্য কায়িক পরিশ্রমকে গায়ে মাখেন না, নইলে যে দেশটা বিশ্বযুদ্ধ শেষে মাত্র ষাট বছর আগেও একটা ধ্বংসস্তূপ ছিল মাত্র, আজকে তারা এখানে থাকতো না।

জার্মানির সব প্রফেসর মহা মানব নন। জার্মানের ডায়েরি লেখার শুরু হয়েছিল প্রফেসর ফিঙ্গারকে দিয়ে (http://bsaagweb.de/diary_germany_1), যিনি মূলত রেসিস্ট টাইপ একজন মানুষ ছিলেন। প্রথম সেমিস্টারে তাঁর ক্লাসে আমি ব্যাপক অপমানিত হই। সেই অপমানের জোর ধরে চেপে যাওয়া জেদ থেকেই আমার জার্মানিতে টিকে থাকার লড়াই শুরু। মূল কথা হল, ভালকে ভাল বলা মন্দকে মন্দ বলার চেষ্টা করেছি। একজন দুইজন মানুষ দিয়ে জাতি বিচার করা আমার ধাতে নেই।

আমাদের দেশের অনেক কিছুই ভাল আছে। তবে সবকিছু ভাল না। আমরা যদি বিদেশে এসে একটা ভাল জিনিস দেখি, সেটা উদাহরণ হিসেবে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিজ জাতিকে ছোট করা নয়। এর উদ্দেশ্য এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে তার বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে দেশকে এবং দেশের মানুষকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা। আশা করি, পাঠক সেটাকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখবেন।

৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×