somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

••শায়লা কিংবা কাকের গল্প••

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শায়লার যখন মাত্র চার বছর বয়স তখন থেকেই তার বউ সাজার খুব শখ। সুযোগ পেলেই মায়ের ওড়না হয়ে যায় শায়লার শাড়ি। মায়ের লিপস্টিক, আইলাইনার, কাজল চারিদিকে ছড়িয়ে বসে পড়তো সাজতে। মা দেখতে পেলেই বিপদ। বিকট চিৎকার দিয়ে উঠতো। শায়লা অবশ্য শক্ত মেয়ে সেও পাল্টা জবাব দিত, 'কেন বউ সাজা কি দোষ? তুমি কি বিয়ে করনি?' মেয়ের পাকা কথায় হয়তো সে হয়তো ফিক করে হেসে ফেলতো। কিন্তু পরক্ষণেই কঠিন মুখ করে বলত, 'যাও পড়তে বস। তুমি আর বাচ্চা নেই। তুমি এখন স্কুলে পড়। এসব খেলার বয়স আর তোমার নেই।' শায়লা বুঝতো না সে কি বড় হয়ে গেছে? তবে কি তার আসলেই বউ হবার আর দেরী নেই?

শায়লার এসব কর্মকান্ডে যে সবচেয়ে বেশী মজা পেত সে শায়লার বড়বোন শারমিন। এরকম পরিস্থিতিতে তার ত্রাণকর্তা হত শারমিন। তাকে কোলে নিয়ে বলত, 'চল তোকে পরীর মত করে সাজিয়ে দেই। এখন তো পেত্নীর মত মুখ করে রেখেছিস।' শারমিনের সাথে শায়লার এ জন্যই হয়তো অনেক বেশী ভাব। শারমিন হাসিমুখে শায়লাকে সাজাতে বসে-

'এই আপু, এত হাসবা না' শায়লা গম্ভীর মুখে বলে।

শারমিন অবাক চোখে বলে, 'কেন বল তো?'

শায়লা আগের মতই গম্ভীর মুখে বলে, 'যত বেশী হাসি, তত বেশী কান্না।'

শারমিন এবার শায়লার গাল টিপে বলে, 'তুই তো দেখি বাচ্চা ফিলোসোফার হয়ে যাচ্ছিস। এসব কথা যে তোকে কে বল?'

শায়লার কথা কিন্তু সত্যি হয়ে গেল। হঠাৎ করেই তার বোন বদলে গেছে। কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ঘরের এক কোণে বসে শুধু ফুঁপিয়ে কেঁদে যায় দিনরাত। বাসার হাওয়া যেন হঠাৎ বদলে গেছে। কেমন থমথমে। শায়লার সাথে কেউ ঠিক মত কথা বলে না। শায়লার এ ব্যাপার খুব বিরক্তি লাগে? একদিন বউ সাজতে বসেছিল সে। তার মা দেখে এবার আর কোনো ধমক দেয়নি। ঠাস ঠাস করে গালে দু'টো চড় বসিয়ে দিয়েছে। শায়লা কিন্তু তখন কাঁদে নি। চোখে তার তখনো কাজল।

বিকেল সময়টা শায়লার খুব পছন্দের। এই সময়টা সে ছাদে বেড়াতে যায়। রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক তারে প্রতি বিকালে যেন কাকদের মেলা বসে। শায়লা প্রতিদিন কাকগুলো গুণে ফেলে। কাকের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এখন পর্যন্ত সে চুরাশিটি কাক হিসাব করেছে। সে এখন একশ' কাকের অপেক্ষায় আছে। কাকগুলো কিন্তু শায়লার মতই সাহসী। তাদের ভয় দেখালেও তাদের জায়গা থেকে নড়ে যায় না। ঝিম ধরে বসে থাকে। আজ তিনদিন অবশ্য তার ছাদে যাওয়া হচ্ছে না। আপুকে ছাড়া মা কোনোভাবেই ছাদে যেতে দিবে না। শারমিনের আশপাশে দিয়ে সে ঘোরাঘুরি করলো খানিক। কোনো সাড়া শব্দ নেই। তার শরীরটা খারাপ। বারে বারে বমি হচ্ছে। মায়ের কাছে চড় খাওয়ার পর তো তার কাছে আবদার করার প্রশ্নই আসে না।

শায়লা আজ সাহস করে একাই ছাদে চলে এসেছে। দরজা খোলা ছিল। এক দৌড়ে সে তাই সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সে চলে আসলো। ছাদে এসেই মন খারাপ হয়ে গেলো। কাকের সংখ্যা কমে গেছে আজ। মাত্র পঞ্চাশটা!

'এই তুই একা এসেছিস ছাদে?' পেছন থেকে কে যেন বলল। শায়লা পিছনে ফিরে দেখে জহুরা আন্টি। তাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। সবসময় মুখের ভিতরে পান থাকে তার। সবাইকেই তুই করে বলা তার অভ্যাস। শায়লার এই জন্যই এই মহিলাকে খুব অপছন্দ।

জহুরা আন্টি আবার বলল, 'তোর বোন কই? সে আসে নাই?'

শায়লা বলল, 'আপু আসেনি। তার শরীর খারাপ।'

জহুরা আন্টি নিচু স্বরে এবার বলল, 'তোর বোন নাকি পেট বাঁধায় ফেলছে।'

'পেট বাঁধাবে কেন? পেট কি বাঁধানোর জিনিস? আপনি এত বড় হয়েছেন এই সহজ ব্যপার বোঝেন না!' শায়লা গটগট করে বলল।

'তুই তো দেখি মহা বিচ্ছু। তোর বোনের যে পেটে বাচ্চা এইটা জানিস না?' জহুরা আন্টি একথা বলেই হেলতে-দুলতে চলে গেল। শায়লা বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।

ছাদ থেকে সে তখনি ছুটে আসলো তার বোনের কাছে। সে শারমিনের কাছে জিজ্ঞাসা করল, 'জহুরা আন্টি বলল তোমার নাকি বাবু হবে? তোমার তো বিয়েই হয়নি! এই মহিলা এত মিথ্যা কথা বলে কেন?' শারমিন তাকে জড়িয়ে হঠাৎ করেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। শায়লা বুঝতে পারছে না কন্নার রহস্য কি। তার পরদিন থেকেই বাসায় লোকজনের আনাগোণা বেড়ে গেল। গম্ভীর মুখে তাদের সাথে তার বাবা-মা কিসব আলোচনা করে। শায়লাকে এসব থেকে দূরে রাখা হয়। তবে শায়লা বুঝতে পারে বড় কিছু হতে যাচ্ছে। তার মা অবশেষে তাকে বলল। তার আপুর বিয়ে হতে যাচ্ছে। মায়ের মুখ মলিন দেখালেও শায়লা তীব্র উত্তেজনা বোধ করতে শুরু করল। সে বিকালেই ছাদে গিয়ে সবগুলো কাককে বিয়ের দাওয়াত দিয়ে আসলো। ককদের অবশ্য ভাবের কোনো পরিবর্তন হল না। তারা আগের মতই ঝিম ধরে থাকলো।

বিয়ের দিন অবশ্য শায়লার মন খারাপ হয়ে গেল। সবার বিয়েতে কত মজা হয়। মানুষজনে বাসা ভর্তি সাথে উচ্চস্বরে গান বাজতে থাকে। এখানে কিছু হচ্ছে না। সামান্য কিছু তাদের আত্মীয় এসেছে। তারাও কেমন যেন মন মরা। তবে তার মন ভালো গেলো কিছুক্ষণ পরেই। পার্লার থেকে দু'জন মেয়ে সাজাতে এসেছে তার আপুকে। শায়লাকে সাজিয়ে দিল তারা। এত সুন্দর করে আগে কেউ তাকে সাজিয়ে দেয়নি। তবে তার আপুকে আজ সত্যি পরীর মত লাগছে। সে হা হয়ে তাকিয়ে দেখে তার পরী আপুকে!

'কি রে পাগলী, ওমন করে কি দেখিস?' শারমিন হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করে। অনেকদিন পর আজ শারমিন হাসছে।

'তোমাকে আজ পরীদের চেয়ে বেশী সুন্দর লাগছে, আপু। আমার বিয়েতেও কিন্তু আমি তোমার মত করে সাজব!' শায়লার কথায় আশেপাশের সবাই একটু হাসে।

বরপক্ষের আসার কথা দুপুরে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। কেউ আসে না। বাবাকে চিৎকার করে মোবাইলে কথা বলতে শোনে শায়লা। এমন ভাবে তাকে কথা বলতে কখনো দেখেনি শায়লা। তার ভয় হয় খারাপ কিছুই হয়তো হচ্ছে। যারা এসেছিল তারা আসতে আসতে যেতে থাকে। আপুকে জড়িয়ে হু হু করে কাঁদতে দেখে শায়লা। আজ কিন্তু আপু কাদছে না। পাথরের মত শক্ত হয়ে বসে আছে শায়লাও মনে মনে চাচ্ছে আপু যেন আজ না কাঁদে। তাহলে এত্ত সুন্দর সাজ একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে যে! সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আপু এবার শীতল কন্ঠে মাকে বলল, 'মা সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তোমরা অ্যাবরশনের ব্যবস্থা কর।' মা কান্না থামিয়ে অবাক চোখে তার দিকে তাকালো। তারপর আবার কান্না শুরু করল। শায়লা এই শব্দের মানে জানে না। কিন্তু কঠিন কিছু নিশ্চই। শারমিন এবার শায়লার দিকে তাকিয়ে বলে, 'এই ছাদে যাবি?'

ছাদে এসেই শায়লার মন আবার ভালো হয়ে গেল। আজ অসংখ্য কাক। সে হয়তো গুণে সব শেষ করতে পারবে না। শারমিন ছাদের কিনারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শারমিন ছাদ থেকে ঝাপ দিল। সাথে সাথেই সব কাক একসাথে উড়ে গেল। শারমিনের রক্তাক্ত লাশের চাইতে এই কাকগুলোই শায়লাকে অনেক বেশী অবাক করল। সে অবাক চোখে রক্তিম আকাশে কাকদের উড়ে যাওয়া দেখতে থাকলো!
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কথাটা খুব দরকারী

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ৩১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৩৪

কথাটা খুব দরকারী
কিনতে গিয়ে তরকারি
লোকটা ছিল সরকারি
বলল থাক দর ভারী।

টাকায় কিনে ডলার
ধরলে চেপে কলার
থাকে কিছু বলার?
স্বর থাকেনা গলার।

ধলা কালা দু'ভাই
ছিল তারা দুবাই
বলল চল ঘানা যাই
চাইলে মন, মানা নাই।

যে কথাটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×