somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপূর্ব জাফলং ও একটি ভৌতিক ঘটনা

১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অপূর্ব জাফলং ও একটি ভৌতিক ঘটনা
------------------ ডঃ রমিত আজাদ

ঘটনাটি ১৯৮২/৮৩ সালের দিকে শুনেছিলাম আমার এক সিলেটি বন্ধুর কাছ থেকে। সিলেটের জাফলং বাংলাদেশের একটি দর্শনীয় স্থান। যারা দেখেননি তারাও নাম শুনেছেন। আর যারা দেখেছেন তাদেরতো জাফলং নাম শোনার সাথে সাথেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই অপরূপ দৃশ্য। জাফলং নিয়ে উচ্ছাস শুনেছি বহু মানুষের মুখে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ছুটে যায় এর নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে। সেই ১৯৮৩ সালে কলেজে (সিলেট ক্যাডেট কলেজ) ঘোষণা করা হলো এবারের পিকনিক হবে জাফলং-এ। শোনার সাথে সাথেই কি যে রোমাঞ্চ অনুভব করেছি! এতকালের শোনা অপরূপ জাফলং এবার নিজের চোখে দেখতে পাবো! আমাদের সিলেটি বন্ধুরা তো আগেই দেখেছে জাফলং, সেই অপরূপা জাফলং-এর নানা সৌন্দর্য্য বর্ণনা করে তারা আমাদের কল্প জগৎের জাফলং-এর রূপ-সুষমা আরো বাড়িয়ে দিলো। পিকনিকের আগের রাতে তো এক্সাইটমেন্টে ঘুমটাই ঠিকমতো হলোনা । খুব ভোরে উঠে ভীষণ তোরজোড়। ছয়টি ক্লাসের জন্য ছয়টি বাস, এছাড়া স্যার, স্টাফ ও অন্যান্যদের জন্যও বাস আছে। আমরা তখন নিতান্তই কিশোর তাই আমাদের উৎসাহই সব চাইতে বেশী। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই গিয়ে বাসে বসে পড়লাম। বাসে গিয়ে যে বসলাম আর সহজে নামিনা, ভাবি এই বুঝি আমাকে রেখেই বাস ছেড়ে যায়। আর শুধু সময় গুনতে থাকলাম। স্যাররা সব যোগার-যন্ত্র করে। বাসে উঠে মাথা গুনে নিশ্চিত হয়ে, তাদের পিতৃসুলভ কিছু উপদেশ দিয়ে বাস ছাড়লেন। আমরা গান-বাজনা, হাততালি, আনন্দ-উচ্ছলতা করে এগুতে থাকলাম। সিলেটকে এম্নিতেই শ্যামল সিলেট বলা হয়। তারপরেও একটা জায়গায় এসে হঠাৎ সবুজ যেন আরো বেড়ে গেলো। চারিদিকে কেবল সবুজের সমারোহ, কোথাও কোথাও পানির প্লাবন, সুন্দর জলরং এ আঁকা খাল। রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছে বিশাল উঁচু সবুজ-নীল পাহাড়। এই পাহাড়টির নাম খাসিয়া-জয়ন্তিয়া পাহাড়। আমাদের কলেজ প্রাঙ্গন থেকে দূরে ঐ পাহাড়টি দেখা যেত। দিনের উজ্জ্বল আলোয় আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা ঐ নীল পাহাড়টি আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকতো। আর গোধুলীর ফিকে রঙে সেই পাহাড়টি যখন ছাইবর্ণ ধারণ করতো তখন তাকে ভীষন রহস্যময় মনে হতো। সেই বয়সে একটা গল্প পড়েছিলাম 'পাহাড়ের বন্দি' নামে। আমার মনে বাসনা জাগতো ঐ নীল পাহাড়ে হারিয়ে গিয়ে আমিও পাহাড়ের বন্দি হয়ে যাই। আজ সেই পাহাড়টিই খুব কাছে এসে ধরা দিয়েছে। সেই পাহাড়ের বুক চিরে অসংখ্য কান্না। ইচ্ছে জেগেছে সেই কান্না ছুঁয়ে দেখার।কিন্তু তা হবার নয়, এ কান্না শুধু দেখা যাবে ছোঁয়া যাবেনা। আগে থেকেই জানতাম ঐ পাহাড় আমাদের নয়।

একসময় বাস থেমে গেলো। শোর উঠলো "জাফলং এসে গেছে, জাফলং এসে গেছে।" ঝপ থেকে বাস থেকে লাফিয়ে পড়লাম। নামার সাথেই মন মাতানো, চোখ জুড়ানো দৃশ্য। পাহাড়ের গায়ে কেবল সবুজ আরো সবুজ। এক জায়গায় হঠাৎ করে পাহাড় চিরে গিয়েছে। আর সেই চির ধরে নেমে এসেছে খরস্রোতা এক পাহাড়ী নদী। এই চির যেন মানুষদের বিচ্ছিন্ন করতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে তার উপর ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে একটি স্তম্ভবিহীন সেতু। খরস্রোতা সেই স্রোতস্বিনী প্রতিবেশি রাষ্ট্র থেকে কুল কুল করে নেমে এসে পা ধুয়ে দিচ্ছে আমার পবিত্র জন্মভূমির। আর তার সাথে করে উপঢৌকন নিয়ে এসেছে সহস্র পাথর।

ডানে বামে যেদিকে তাকাই শুধু পাথর আর পাথর। আমার জীবনে এতোগুলো পাথর একসাথে আর কখনো দেখিনি। ছোট বেলায় পাথরের নেশা ছিলো। ঘর থেকে চুপি চুপি বের হয়ে দূরে রেল রাস্তায় চলে যেতাম পাথর তুলতে। তারপর হাফপ্যান্টের দুই পকেট ভরে নিয়ে আসতাম পাথর। রাতে ঘষে ঘষে আগুন জ্বালাতাম আর ভাবতাম বিজ্ঞানী হয়ে গিয়েছি। মাঝে মাঝে মনে মনে ভাবতাম এরকম করতে করতে যদি একদিন হীরক খন্ড পেয়ে যাই, তবে সেটা বেচে অনেক টাকা পাবো। আজ আমার চোখের সামনে কতো কতো পাথর! পাথরের নেশায় আরো একবার ছুটে গেলাম। ওমা! একি? এযে হীরার চাইতেও সুন্দর! রেল রাস্তার উপর থেকে যে পাথর তুলতাম জাফলং পাথরের তুলনায় ওগুলোতে একবারেই ফিকে! লাল, গোলাপী, বাদামী, নকশা কাটা, ঝলমলে কতো বিচিত্র রকমের পাথর জাফলং-এ! ঝটপট তুলে নিলাম কিছু, পরক্ষণেই ফেলে দিলাম কয়েকটি, কারণ তাদের চাইতেই সুন্দর কিছু পাথর পেয়েছি, আবার ওখান থেকেও কিছু ফেলে দিলাম, কারণ আরও সুন্দর কিছু পাথর পেয়েছি। অল্প সময়েই পকেট ভরে ফেললাম। এরকম করতে করতে এগিয়ে গেলাম এই এতো এতো পাথর বয়ে আনা সেই পাহাড়ী নদীর দিকে। ওমা! এযে আরেক সৌন্দর্য্য! এতো টলটলে পানি হয়? কাঁচের মতো স্বচ্ছ! নদীর উপর থেকে শুরু করে নীচ পর্যন্ত সবই দেখা যাচ্ছে। নদীর পাদদেশেও কোন মাটি চোখে পড়েনা। সেখানেও রংবেরঙের পাথর। হাত দিয়ে দেখলাম বরফের মত ঠান্ডা পানি। ছোট বেলায় একটা উপন্যাস পড়েছিলাম, 'বরফ গলা নদী'। এই কি সেই বরফ গলা নদী? এতো ঠান্ডায় নামলে তো কষ্ট হবে। তারপরেও কি প্রলোভন ঐ নদীর। নেমে গেলাম দল বেধে। সাঁতরে সাঁতরে ক্লান্ত হয়ে উঠে এলাম। দাঁড়িয়ে গেলাম ঝকঝকে রোদে। যেন কোন পবিত্র প্রবাহিণীতে গা ধুয়ে সোনা রোদ মেখে নিচ্ছি সর্বাঙ্গে।

দুপুরের লাঞ্চ সেরে বিকেলের মিষ্টি আলোয় আরেকবার গেলাম ডাউকি নদীর পাথর ভরা তীরে হাটতে। আর সে সময়েই আমাদের ভ্রমণসঙ্গী এক সিলেটি বন্ধু বললো ঐ অপরূপা বরফ শীতল রহস্যময় নদীর এক ভৌতিক গল্প।

কয়েক বছর আগে, আমাদেরই মতো স্কুল ছাত্রদের একটা দল এসেছিলো এই জাফলং-এ পিকনিক করতে। তারাও সারাদিন থাকার পর সন্ধ্যার দিকে যখন ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন হঠাৎ আবিস্কার করলো যে তাদের মধ্য থেকে একজন নেই। খোঁজ পড়ে গেলো চারদিকে, না কোথাও পাওয়া গেলনা। সে কি নদীতে নেমেছিলো? বন্ধুরা বললো হ্যাঁ নেমেছিলো। তারপর? তারপর আর জানিনা। শহরে ফিরে গেলো দলটি, বাবা-মাকে খবর দেয়া হলো। আরেক দফা খোঁজ, নদীতে জাল ফেলা সবই হলো। কিন্তু না পাওয়া গেল না ওকে। নদীতে ডুবে গেছে, বা নদী ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, এমন ধারণাই হলো সবার। শোকার্ত বাবা-মা কি তা মানে? তারা এক হুজুরের শরণাপন্ন হলেন। তিনি সব শুনলেন তারপর গম্ভীর মুখে বললেন, "আজ আমি জাফলং যাবো, রাতে ডাউকি নদীর তীরে থাকবো। তবে আমার সাথে একটি সাহসী ছেলে দিতে হবে।" ভুট্টো নামে ওদের বাড়ীতে পনের-ষোল বছরের একটি কাজের ছেলে ছিলো। তাকে দেয়া হলো সাথে।

রাতে ডাউকি নদীর তীরে হুজুর তাবু গাড়লেন। শুরুতেই ভুট্টোকে বললেন, "চুপচাপ থাকবি, কোন কথা বলবি না।" তারপর হুজুর সারা রাত দোয়া পড়েন আর একটা করে চিঠি ফেলেন নদীতে। ভুট্টো নীরবে বসে বসে দেখে হুজুরের কাজ। রাত যত বাড়ে অন্ধকার তত গাঢ় হয় আর প্রকৃতির নীরবতাও বাড়তে থাকে এক সময় কাক-পক্ষীও নিঝুম হয়ে পড়ে। থিক সেসময় অন্ধকারের বুক চিরে বরফ শীতল নদী থেকে উঠে আসে একজন পুরুষ আর একজন মহিলা। দুজনই খোঁড়া। তারপর হুজুরের সাথে তাদের কথপোকথন শুরু হয়। এই ভয়াবহ দৃশ্য ভুট্টো আর স্থীর থাকতে পারেনা। ভয়ে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে ওঠে। ভয় কাটানোর জন্য হঠাৎ সে হুজুরকে প্রশ্ন করে বসে, "হুজুর কয়টা বাজে?" হঠাৎ যেন শান্তি আলোচনা ভঙ্গ হলো। হুজুর রাগত দৃষ্টিতে তাকালেন ভুট্টোর দিকে (উনার দৃষ্টিতে লেখা,"তোকে না কথা বলতে নিষেধ করেছি!")। নদী থেকে উঠে আসা পুরুষটি রাগত দৃষ্টিতে তাকালো হুজুরের দিকে, ভয়ংকর স্বরে বললো, "কাল পাবি।"

তারপরের ঘটনা দুঃখজনক। পরদিন নদীর বুকে হারিয়ে যাওয়া ছেলেটির মৃতদেহ ভেসে উঠেছিলো।

(ঘটনাটি আমি কেবলই শুনেছি। এর সত্যতা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই।)
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×