৩য় অংশের পরঃ
“আর কতদূর? হাঁটতে হাঁটতে পা তো শেষ।”, বাবলু জিজ্ঞেস করে নিশিকে। “এই তো চলে আসছি।”, নিশি জানায়, “সপ্তাহে শুধু বুধবার এখানে হাট বসে। তাই তো আজকে আসতে হল।” মালিহা বলে, “এতদূর বুঝলে আমিও আসতাম না।” শুধু রাহিই নিশির পাশে দাঁড়ায়। বলে, “একটা দিন না হয় নিশির জন্য একটু কষ্ট করলাম। তাছাড়া বিয়ে উপলক্ষ্যে ওদের টুকটাক কেনাকাটাও তো বাকি আছে।” “দেখলেন রাহি ভাইয়া ঠিকই বুঝেছেন। আর মালু আসার ব্যাপারে তোর আগ্রহও তো কম ছিল না।”, বলে আরো জোরে পা চালায় নিশি।
একগাদা কেনাকাটা শেষে মধ্যাহ্নবেলায় বাড়ি ফেরে চারজন। এসে চার মৎসশিকারীর বিমর্ষ চেহারা দেখতে পায়। মালিহাই প্রথম জিজ্ঞাসা করে, “কই ভাইয়া, আপনাদের মাছ কই?” রাহিও বলে, “হুম, দেখা কি কি মাছ শিকার করলি?” আবির ল্যাপটপ থেকে চোখ সরায় না। রিশাদ বলে, “যা, পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখে আয়।” নাহিয়ানও হতাশায় মাথা নাড়ে, “এখনও জীবন্ত।” কিনে আনা জিনিসগুলো ভেতরে রেখে আসে মালিহা আর নিশি। রাহি আর বাবলু পুকুরপাড়ের দিকে এগোতে থাকে। মালিহা আর নিশিও ওদের পথেই পা বাড়ায়। হতাশ আর ক্লান্ত নাহিয়ান লুঙ্গি দিয়ে ঘাম মুছে রিশাদের দিকে তাকায়। চার পাঁচটা ব্যাঙ সন্তানের লাফালাফি দেখে ফিরে আসে চার দর্শনার্থী। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশি। রিশাদের উদ্দেশ্যে বলে, “ভাইয়া, এইগুলা শিকার করছিস?” মালিহা বলে, “নিশি, আজকে ভাইয়ারা তাদের ধরা মাছ দিয়ে খানাপিনা সারলে কেমন হয়?” রাহি লাফিয়ে ওঠে, “মচৎকার I mean চমৎকার হবে।” বাবলু কি যেন একটা বলতে নেয় এমন সময় ওর ফোন বেজে ওঠে। মুঠোফোনে ব্যস্ত হয়ে যায় সে। রাহি শিকারীদের উদ্দেশ্যে জানতে চায়, “আরেক শিকারীকে তো দেখছি না। সে বেচারা আগেই চম্পট দিল নাকি?” নাহিয়ানই জবাবটা দেয়, “ফারজানার হঠাৎ জ্বর এসেছে।” নিশি ব্যস্ত হয়ে বলে, “সে কি! কখন আসল? আমরা তো সুস্থই দেখে গিয়েছিলাম।” আবির জানায়, “তেমন গুরুতর কিছু না।” রিশাদ বলে, “ভাইয়াকে বলেছি। এতক্ষণে তো ডাক্তার নিয়ে চলে আসার কথা।” “ওই তো রাহাত ভাইয়া এসে গেছেন।”, মালিহা আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে। ডাক্তারকে নিয়ে সবাই ফারজানার ঘরে প্রবেশ করে। তানিমকেও সেখানে পাওয়া যায়। ডাক্তার সব দেখে শুনে কিছু ওষুধ দেন। জানান চিন্তার কোন কারণ নেই। সামান্য জ্বর এসেছে। দু’দিন বিশ্রাম নিলেই সেরে যাবে।
বিকালবেলার সূর্যটাও টুপ করে ডুবে যাবার অপেক্ষায় আছে। মালিহা ওর ব্যাগ থেকে খাতাটা বের করে। বেশ পুরনো একটা খাতা। দেখে মনে হচ্ছে কোন পাণ্ডুলিপি। ধূলো ঝেড়ে পাণ্ডুলিপিটার নাম পড়ার চেষ্টা করে। শুধু ‘মন্ত্র’ শব্দটা বুঝতে পারে সে। পুরো নামটা পড়া যায় না। বইটা ধীরে ধীরে খোলে মালিহা। কার যেন পদশব্দ পাওয়া যায়। জলদি করে বইটা ব্যাগে ভরে ফেলে সে। রাহি ঘরে প্রবেশ করে। “এই মালু, তোমাকে নিশি খুঁজছে।” মালিহা ছেলেমানুষি ঢঙে বলে, “ভাইয়া আপনিও। আমার নাম মালিহা।”
“এই আদর করে মালু ডাকলাম। নিশিই তো বলল, রাহি ভাই মালুকে দেখেছেন?”
-“ওর ব্যবস্থা করতে হবে মনে হয়।”
“তো একলা ঘরে কি করছিলে? বয়ফ্রেণ্ডের কথা ভাবছিলে বুঝি?”, রাহি ভ্রু কুঁচকে মুচকি হাসে।
“ভাইয়া যে কি বলেন? আমি খুব ভালো মেয়ে। বই পড়ছিলাম।”
বইয়ের কথা শুনে রাহি আগ্রহ প্রকাশ করে, “কি ধরণের বই পড় তুমি?”
“সবচেয়ে ভালো লাগে কবিতার বই।”
রাহি মনে মনে ভাবে একজন মনের মতো পাঠিকা পাওয়া গেল। মুখে বলে, “হুম এখন জলদি যাও। নিশি অপেক্ষা করতেছে।” মালিহা বেরিয়ে গেলে রাহির চোখে পড়ে একটা বিষয়। মালিহার ব্যাগের কোণা থেকে বেরিয়ে আসা একটা বইয়ের কোণা। রাহি ভাবল হয়তো এই বইটাই মালিহা পড়ছিল। বইটা টেনে বের করে সে। বেশ পুরনো একটা বই। বই বলা ভুল হবে কেননা এটা হাতে লেখা বাঁধাই করা এক বাণ্ডিল কাগজ এবং বেশ পুরনো। ‘পুরনো পাণ্ডুলিপি’ বলা চলে। রাহি বইটা খুলে পড়া শুরু করে। নিজের অজান্তেই সে এগিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। সূর্যটাও সময় মতোই ডুবে যায় নীরবে।
সন্ধ্যার মধ্যেই পুরো বাড়িতে বিয়ের আমেজ চলে এল। রিশাদদের সব আত্মীয়রা এসে পৌঁছেছেন আগামীকাল বরযাত্রা করবেন বলে। হাসি আর আনন্দে চাঁদের হাট বসে চৌধুরী বাড়িতে। কিন্তু সবার এই আনন্দের মাঝে তানিম এক গভীর দুঃসংবাদ ঢেলে দিল। রাহিকে পাওয়া যাচ্ছে না। আবির আর বাবলু চট করে উঠে দাঁড়াল। নাহিয়ান বলল, “রিশাদকে বলেছিস?” তানিম মাথাটা ওপর-নিচে নেড়ে জানায়, “কারো কাছে বলতে নিষেধ করেছে। বললে সবাই চিন্তায় পড়ে যাবে।” আবির জিজ্ঞেস করল, “কেউ কি খুঁজতে গেছে?” তানিম বলল, “বাড়িভরা মেহমান। রিশাদ অনেক কাজে ব্যস্ত। ও বলল আশেপাশে খুঁজে দেখতে।” বাবলু মুখ খোলে, “প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। হয়তো নদীর পাড়ে বসে আছে। নাহিয়ান, চল নদীর পাড়ে দেখে আসি।” নাহিয়ান জানায়, “সেই ভালো। আবির, তুই আর তানিম জমিদারবাড়িটা দেখে আয়।” দুটো ক্ষুদ্রতম দলে ভাগ হয়ে যায় ছেলেরা। মালিহা ঘরে ঢুকে ‘পুরনো পাণ্ডুলিপি’ টা খোলা অবস্থায় দেখতে পায়। কিছুক্ষণ ভাবার পর তার মনে পড়ে শেষবার ঘর থেকে যখন ও বেরিয়ে যায় রাহি ভাইয়াও ছিল এ ঘরে। তবে কি রাহি ভাইয়া বইটা পড়েছে? পড়তেও পারে। শুনেছি কবি মানুষ। মনে মনে এসব কথা ভাবতে ভাবতে মালিহা বইটা বন্ধ করে। ভাবে রাহি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করবে বইটা কেমন লাগলো। রাহির খোঁজ করতে গিয়ে তার অনুপস্থিতি টের পায় মালিহা। কোন ঘরেই নেই রাহি। এমনকি রিশাদ ভাইয়ের বন্ধুরাও নেই। মালিহার মুখ থেকে নিশিও জানতে পারে ব্যাপারটা। বুদ্ধিমতী নিশি রিশাদকে এ বিষয়ে জানায়। রিশাদও জানতে পারে মালিহার খুঁজে পাওয়া ‘পুরনো পাণ্ডুলিপি’র কথা। রিশাদ উদগ্রীব হয় জানতে চায়, “তুমি নিশ্চিত যে রাহি ওই বইটা পড়ার পরই নিরুদ্দেশ হয়েছে?” মালিহা বলে, “সেরকমই তো মনে হচ্ছে।” রিশাদ জানতে চায় ‘পুরনো পাণ্ডুলিপি’ টা এখন কোথায়। মালিহা উত্তর দেয় ওর ব্যাগের মধ্যে রেখে এসেছে। হন্তদন্ত হয়ে রিশাদ ছুটতে থাকে মালিহার ঘরের দিকে। একমাত্র ‘পুরনো পাণ্ডুলিপি’ই এখন বাঁচাতে পারে রাহিকে।
(চলবে)
৩য় অংশঃ Click This Link
২য় অংশঃ Click This Link
১ম অংশঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:২২