somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইচ্ছে ডানা

২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিদায় পর্ব সেরে সবাই যখন নিজ গন্তব্যের পথে আমি চোখ রাখছিলাম শিউলি আপার দিকে, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন অনেক্ষণ, চোখের কোনে পানি ছলছল, রুমালের ছোঁয়ায় চোখ মুছা হলেও আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আপার মনে আজ আনন্দের বন্যা, কোন কোন বিদায় আনন্দের ও বটে, আজ বিদায় নিল একজন, খাঁচার পাখিটা মুক্ত হয়ে আবার যখন মুক্ত আকাশে পাখিদের দলে ভীড়ে যায়, কেমন লাগে দৃশ্যটা....

আপা গিয়ে বসলেন অফিস রুমে, চুপচাপ বসে ছিলেন, আমি আসলাম একটু পর, চেয়ার টেবিলগুলো একটু গুছগাছ করে দিচ্ছিলাম, রুমে ঢুকতেই দেখলাম আপা আবার চোখ মুছছিলেন, আমি গিয়ে বসলাম সামনের চেয়ারটাতে, জিজ্ঞাসা করলাম আপু কি এখন যাবেন? যাবার সময় আমাকে প্রধান সড়কে নামিয়ে দিলে হবে, আর না’হয় আমি রিকশা নিয়েই যেতে পারব

" হুম বস ফিরোজ, যাব, একসাথেই যাব, একটু বস। খুব খারাপ লাগছে রহিমার জন্য, অনেকদিন ছিলেনতো তায় মায়া লাগছে খুব, তবে আজকের দিনটা আমার জন্য একটা বিশাল ব্যাপার, এই দিনটারই স্বপ্ন দেখতাম আমি, রহিমাকে বিদায় দিয়ে সেই স্বপ্নের পূর্ণতা হল, আমি চাই সবাইকে এভাবে বিদায় দেব এক এক করে, আমার এই হাসপাতালটা শূন্য পড়ে থাকবে

আপাকে স্বাভাবিক করার জন্য ঠাট্টা করলাম একটু, বললাম "তাহলে আমার কি হবে আপু, একেবারে বেকার হয়ে যাব যে, আমার দিকটাও একটু দেখতে হবে আপনাকে, হাসি মাখা মুখে কথাটা বললাম, আপাও হাসলেন

" তোমার ভাইয়া আজ কি সুন্দর বক্তৃতা দিয়েছে শুনেছ? আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ! সবাইকে আমার কাছ থেকে শিক্ষা নেবার, প্রেরণা নেবার পরামর্শও দিয়েছে, মিথ্যুক কোথাকার।" এইবার হাসিটা আর চেপে রাখা গেলনা, শব্দ করেই হাসলাম, আপাও মৃদু হাসি দিলেন, চোখের কোনে তখনো বিন্দু পানি ছলছল। আপা আমার সাথে কেন জানিনা সবকিছু শেয়ার করেন, ঘরোয়া ব্যাপারগুলো আমার সাথে এমনভাবে বলে ফেলেন যে আমি নিজেও মাঝের মধ্যে বিব্রত হয়ে পড়ি, আসলে আপার মনটা শিশুর মতো, মুখের হাসিটা যেমন সুন্দর, মনের ভেতরটাও ঠিক তায়

মিনহাজ ভাই এর কথা বলছিলাম, আপার হাজব্যান্ড, পেশায় ইজ্ঞিনিয়ার, আপার সাথে সবসময় খুনসুটি, আপা যখন প্রথম এই পক্ষঘাতগ্রস্থ দাতব্য হাসপাতালের কাজে হাত দিয়েছিলেন তখন মিনহাজ ভাই কল্পনাও করতে পারেননি কি হতে যাচ্ছে, আপাকে ঠাট্টা ডাকতেন মাদার তেরিজা বলে, আর আপারও একটু এক রোখা ভাব আছে, যে কাজে হাত দেবেন শেষ দেখেই ছাড়বেন, এই কাজে হাত দেবার প্রথম দিকে মিনহাজ ভাই এর সাথে একটু মনোমালিন্য হয়েছিল, ওনি বিষয়টাকে পাগলামি হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন, তায় আপাও রাগ করে ভাইয়াকে আর এ কাজে সম্পৃক্ত করেননি, আপা চাইলে বাবার কিংবা মা এর কাছে সাহায্য চাইতে পারতেন, দুই দিকেই অগাধ সম্পদের পাহাড়, তবুও হাত পাতলেননা, নিজের চেষ্টাতেই করবেন বলে

প্রথমে আপা চলে গেলেন সোজা ভারতে, কোর্স করে আসলেন রূপ চর্চার উপর, এসে শুরু করলেন কাজ, বিউটি পার্লার খোলা হল, ওখানেও কাজ জুটলো অনাথদের, আমার সাথে পরিচয় সূত্র যখন আপা হাসপাতাল দেবার জন্য জায়গা খুঁজতে লাগলেন তখন, আপা শুনেছেন আমি টুকটাক সোস্যাল ওয়ার্ক করি তায় আমাকেই উনি খুঁজে বের করলেন, পরিচয় হলাম, দু'জন মিলে খুঁজতে লাগলাম হাসপাতালের জায়গা, এভাবেই শুরু

জায়গা কিনতে গিয়ে যখন দেখল টাকাপয়সায় কোন ভাবেই কুলানো যাচ্ছেনা তখন আপা ভাইয়াকে না জানিয়ে বিয়ের সব গয়না বিক্রি করে বসলেন, ভাইয়া ও রাগ করেছেন খুব, ওনাকে বললেইতো হতো, বিয়ের স্মৃতি কেন ধ্বংস করা হল! আপার মাথায় তখন শুধু হাসপাতাল, তাই কে কি বলল না বলল ওসবে কান পাতার আর সময় নেই

আপাকে জিজ্ঞেস করেছিলেম এত কিছু থাকতে আপনি কেন পক্ষঘাতগ্রস্থ হাসপাতাল করতে গেলেন, জানা গেল, আপার একমাত্র ছেলে রোড এক্সিডেন্ট হল, দেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে দেখলেন এখানে পর্যাপ্ত ব্যাবস্থা নেই ভাল চিকিৎসার, তায় বিদেশ পাঠাতে হলো, ছেলে সুস্থ হল বটে তবে আপার মাথায় ঢুকে গেল একটা হাসপাতাল বানাতে হবে পক্ষঘাতগ্রস্থদের জন্য, এমনিতে আপার মাথায় কাজ করতো কিছু একটা করবে, পরে ফাইনাল ডিসিশান নিয়েই নিলেন, হাসপাতালই করবেন

আপার দ্বিতিয় ছেলেটার কথাও একটু বলা যাক, যদিও গোপন বিষয় তবুও বলেই ফেলি, আপা যাচ্ছিলেন কোন এক কাজে, গাড়িটা পার্ক করতেই একটা ছোট্ট শিশুর কান্না শুনতে পেলেন, চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখা গেলনা, ড্রাইভার বলল ডাস্টবিনের ওদিক থেকেই কান্নার শব্দ আসছে, আপা গিয়ে দেখলেন সদ্য নবজাত শিশু, নিয়ে আসলেন বাসায়, আপার বড় ছেলে তখনো মাতৃদুগ্ধের অধীনেই ছিল

আমাদের আজকের প্রোগ্রামটা ছিল রহিমা খালাকে বিদায় সংবর্ধনা হিসেবে হাসপাতালেই একটা ছোট্ট আয়োজনের, প্রধান অতিথি ছিলেন মিনহাজ ভাই, আপা ইচ্ছে করেই ওনাকে প্রধান অতিথি করেছেন, লজ্বা দেবার জন্য, আমি নিশ্চিত বাসায় গিয়ে দুজন মিলে ঝগড়া করবে, আমার সামনেও ওরা ঝগড়া করে তায় আমি আন্তাজ করতে পারি কখন কি হবে, ঝগড়াটা শুরু হবে এমনভাবে, আপা ভাইয়াকে বলবে, “তোমার লজ্বা করেনি প্রধান অতিথি হতে? আমার এই কাজে প্রথম যে বাঁধার সৃষ্টি করেছিল সেটাতো তুমিই!” ভাইয়া ও বলবেন, “কাউকে দাওয়াত দিয়ে এভাবে অপমান করাটা কি সভ্য!” এভাবেই সুত্রপাতটা হবে, আপাও বলে উঠবেন কি আমি অসভ্য! খুব হাসি পায় আমার ঝগড়াগুলো দেখলে

রহিমা খালার কথা বলছিলাম, গার্মেন্টস এ কাজ করতেন, একদিন হঠাৎ পায়ে ব্যাথা অনুভব হলো, বসে পড়লেন, আর দাঁড়াতে পারছেননা, ওনার স্বামীও একই গার্মেন্টস এ কাজ করতেন, নিয়ে আসলেন সরকারী হাসপাতালে, হাসাপাতল এর খরচ চালানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তায় ডাক্তার রেফার করলেন আপার এই হাসপাতালে, রহিমা খালার স্বামী এই যে দিয়ে গেলেন আর দেখতে আসলেননা, রহিমা খালা খুব কাঁদতেন, যার সাথে এতদিনের সংসার সে কি করে এভাবে ফেলে চলে যেতে পারে! পরে জানা গেল সে আর একটা বিয়ে করে সংসার করছে, এদিকে আপা দিনের পর দিন সেবা করে রহিমা খালাকে অনেকটা সুস্থ করে তোলেন, রহিমা খালা এখন লাঠির উপর ভর করে হাটতে পারে, আজকে বিদায় নিলেন সেই রহিমা খালা, এখানে রহিমা খালার কেউ নেই একমাত্র সন্তান, কতইবা আর বযেস হবে, বাবা চলে যাবার পর স্কুল ছেড়ে সেও গার্মেন্টস এ কাজ ধরল, ক্লাশ সিক্স থেকে আর উপরে উঠা গেলনা

আপার আজ সুখের দিন, হাসপাতালের প্রথম একজন রোগীকে বিদায় দিতে পেরেছেন তায়, হয়তো আজ সারা রাত কাঁদবেন, তারপর কাল থেকে আবার নতুন করে শুর করবেন, নব উদ্যমে, এই হাসাপাতালে এখনো আরো চল্লিশজন পক্ষঘাতগ্রস্থ রোগী আছেন, তাদের কারো কাছে আপা হলেন মা, কারো কাছে বোন, কারো কাছে বিধাতার প্রতিনিধি, আপার এখনো অনেক কাজ, রহিমা খালার ছেলে পড়তে পারেনি তায় আপার মন খারাপ, আপা নতুন করে চিন্তা করছেন স্কুল দিতে হবে একটা এই হাসপাতালেই, বস্তির শিশুরা এসে পড়বে, আর টিচার হবে হাসাপাতালের পেশেন্টরাই, মেয়েদের শেলাই আর বুটিক এর কাজটা আরো আগেই শুর করেছিলেন, রহিমা খালার উপার্জনের পথ ওটাই

আপা আমাকে নামিয়ে দিলেন মেইন রোডে যাবার পথে, আমি হেটে চললাম, জানিনা গন্তব্য কোথায়............

(বি.দ্র. অন্য ব্লগে অন্য চোখে)
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামীলীগে শুধুমাত্র একটি পদ আছে, উহা সভাপতি পদ!

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৪ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪১


বাঙ্গালীদের সবচেয়ে বড়, পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই দলটির প্রতি মানুষের ভালোবাসা আছে। মানুষ এই দলের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছে। ৭০ এর নির্বাচনে এই দলটিকে নিরঙ্কুশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমপি আনারের মৃত্যু এবং মানুষের উষ্মা

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:২৯


সম্প্রতি ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পর আনোয়ারুল আজীম আনার নামে একজন বাংলাদেশি এমপি নিখোঁজ এবং পরবর্তীতে তাকে শ্বাসরোধে হত্যার পর তার মরদেহের হাড়-মাংস আলাদা করে হাপিত্যেশ করে দেওয়া হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

দোয়া ও ক্রিকেট

লিখেছেন শাহাবুিদ্দন শুভ, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৪


দোয়া যদি আমরাই করি
তোমরা তাইলে করবা কি?
বোর্ডের চেয়ারম্যান, নির্বাচকের
দুইপায়েতে মাখাও ঘি।

খেলা হচ্ছে খেলার জায়গা
দোয়ায় যদি হইত কাম।
সৌদিআরব সব খেলাতে
জিতে দেখাইত তাদের নাম।

শাহাবুদ্দিন শুভ ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে “বাঘ” বলা বন্ধ করুন!!

লিখেছেন অন্তর্জাল পরিব্রাজক, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:২১



দয়া করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে “বাঘ” বলা বন্ধ করুন!! X( এরা ছাগলের দলই ছিল, তাই আছে, তাই থাকবে :-B !! এরা যেমন ধারার খেলা খেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তোমার বকুল ফুল

লিখেছেন নীল মনি, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৪

বকুল ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে থাকে আমার এই ঘর। আমি মাটির ঘরে থাকি। এই ঘরের পেছন দিকটায় মা'য়ের হাতে লাগানো বকুল ফুলের গাছ৷ কী অদ্ভুত স্নিগ্ধতা এই ফুলকে ঘিরে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×