বই এর নেশা-১
আমাদের বাসাটাই ছিল যেন একটা গল্পের বইয়ের আখড়া। প্রতিবেশীরা আমাদের বাসা থেকে গল্পের বই ধার করতে আসতো। আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমার বড়বোন যখন ড্রয়িংরুমের সোফায় শুয়ে বই পড়তো আমি হিংসায় মারা যেতাম, কবে বই পড়তে শিখবো। আম্মু পড়াতে শুরু করলো আমার বই আর চয়নিকা, আমি আধো-আধো বানানে তখনই সেই কাঠের আলমারি থেকে নিয়ে পড়া শুরু করলাম গল্পের বই। যেন এমনটাই হওয়ার কথা, এমনই যেন হয়ে আসছে আমার বড়বোনদের বেলাতেও।
ভাইয়া পড়তে চাইতো না, ওর জন্য বাসায় আসতে লাগলো কমিক্স। যখন ও নন্টে-ফন্টে, ইন্দ্রজাল কমিক্স কিংবা বাঁটুল দি গ্রেট পড়ছে আমি ততদিনে চলে গিয়েছি তিন গোয়েন্দা আর কিশোর ক্লাসিকে। আর বড়বোনরা তখন পড়তো রহস্য পত্রিকা আর আনন্দমেলা। সেবা প্রকাশনী যেন যুগান্তরী একটা প্রতিষ্ঠান, কী ছিলোনা ওদের ছাপায়? আমার বড়বোন ঘরের কাছের লাইব্রেরী থেকে রীতিমত সিরিয়াল ধরে একেকটা সিরিজের বুকিং দিয়ে আসতো। জুলভার্ন থেকে শুরু করে কতরহস্য গল্প!! তিনগোয়েন্দা পড়েনি সেসময়ে আমার বয়সী একটা ছেলেমেয়েও পাওয়া যাবেনা!! ঝরঝরে অনুবাদের ডক্টর জেকিল এন্ড মিস্টার হাইড, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, অশুভ সংকেত কিংবা গডফাদার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে কেবল এদের কল্যাণেই। বড়বোনদের মাসুদ রানা পড়তে দেখেছি, কেন জানি আমার বেশ বোরিং লাগতো সেটা। তবে ওয়েস্টার্ণ গুলো মারাত্মক ছিলো!! রকিব হাসান আর আনোয়ার হোসেন এই দুই ভদ্রলোককে যেন খুব ভালো চিনে গিয়েছিলাম!! জিম করবেটের শিকার কাহিনীগুলো এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলতাম। কিশোর ক্ল্যাসিকের হাত ধরে যেসব গল্প পড়েছি, তার যেকয়টা পারি, বলতে গেলে সব কয়টাই বড় হয়ে মুভি খুঁজে বের করে ডাউনলোড করে দেখেছি। তবে, সেবা রোমান্টিকের বইগুলা মোটামুটি ফ্লপ ছিলো আমাদের বাসায়। হয়তো ততদিনে মিল্স এন্ড বুন পড়া শুরু করেছি বলে। একটা দুইটা পড়ে টের পেলাম মিল্স এর বইগুলাকে বাংলায় অনুবাদ করেই বানানো হয় সেবা রোমান্টিক। তখন হাস্যকর লাগতো কিভাবে বিদেশের পটভূমিতে লেখা গল্পগুলো বাংলাদেশের পটভূমিতে চাপানো হয়েছে!
অবসর প্রকাশনীর বেশ কিছু বই এসেছিলো বড়বোনদের হাত ধরে, সেগুলাও বেশ অভিনব ছিলো। সীমান্তে সংঘাত থেকে পরিচয় শাহরিয়ার কবিরের সাথে। এরপরে নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড় ঘুরে এসে নিজেই হারিয়ে গেলাম আবির, বাবু আর ললি, টুনির মাঝে। আমার পড়া হুমায়ুন আহমেদের প্রথম বই দেবী পড়েছিলাম খুব সম্ভবত এই প্রকাশনীর ছাপা থেকেই। গা ছম ছম করা অন্যরকম এই বই পড়ে মিসির আলীর ভক্ত হয়ে গেলাম আর কৌতুহলী হয়ে হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে পড়ে ফেলেছিলাম। তারপর তো মনে হয় হুমায়ুনের কিছুই বাদ দেইনি আর!!
এদিকে আনন্দমেলার কল্যাণে ততদিনে সত্যজিতের শঙ্কু-ফেলুদাকে চেনা হয়ে গিয়েছে। কাঠের আলমারিতে অবধারিতভাবে খুঁজে পেলাম গাদা-গাদা ফেলুদার বই। বোনেরা কিনে কিনে ভরাতে লাগলো প্রোফেসার শঙ্কুর বই। এর বাইরে ফটিকচাঁদ তো ছিলই। সুনীলের সন্তু-কাকাবাবু, সমরেশের অর্জুন-অমল সোম, মতি নন্দীর কলাবতী, শীর্ষেন্দুর হাস্যকর ভুতের কিংবা রহস্যগল্প, আশাপূর্ণা আর সঞ্জীবের রম্যগল্প পড়ার জন্যে আনন্দমেলা হয়ে গিয়েছিলো নেশার মত। ছোটদের গল্প গুলোও বেশ লাগতো। আনন্দমেলার কমিক্স, বৈজ্ঞানিক ফিচার, বুদ্ধির খেলা কোনটাই বাদ দিতামনা। এমন ইন্টারেস্টিং কিশোর পত্রিকা আমার আর একটাও চোখে পড়েনি আজ অবধি। ভারতের লেখকদের ফ্যান হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে জন্মদিনের উপহার পেতে থাকলাম এঁদের বইগুলো।
এমন একটা সময়ে স্কুলে শুরু করলাম বিশ্বসাহিত্য-কেন্দ্রের বইপড়া কার্যক্রমের পড়াশুনা। গোগ্রাসে গিলতাম প্রতি অল্টার্নেট মঙ্গলবারে নেওয়া বইগুলো। প্লাস্টিক কাভার আর সবুজ মলাটের সেই বইগুলোর মধ্যে “আবার যখের ধন”, “লা মিজারেবল” আর “মহাভারত” মনে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছিলো। ভাবতেই পারিনি মাইকেল মধুসূদন কিংবা বিদ্যাসাগরের জীবনী এতটা রোমাঞ্চকর হতে পারে!!
স্কুলের লাইব্রেরী আমাদের জন্য একটা আলোকিত দুয়ার হয়ে ছিলো সেসময়ে, বাংলা বইয়ের বেলায়। সঞ্জীবের সমগ্র নিয়ে কাড়াকাড়ি যেমন চলতো তেমন হাই ডিম্যান্ড ছিলো মোটা মোটা সংকলন-গুলো, রবীন্দ্রনাথ কিংবা বঙ্কিমের। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখার সাথে পরিচিতি সেই স্কুলের লাইব্রেরী থেকেই। পথের পাঁচালীর মূল বইটা হাতের নাগালে এসেছিলো অনেক প্রতীক্ষার পরে, কারণ লাইব্রেরীতে আমার আগেই বুকিং দিয়ে দিতো অন্য কেউ।