"বৃষ্টির অশ্রু"
- শাফায়াত হোসেন শাওন
বৃষ্টি শেষে সেদিন সন্ধ্যায় বেল্কনিতে বসেছিলাম। বেল্কনিতে বেড়ে উঠা মাধবীলতার পাতা ছুঁয়ে এক ফোঁটা, দু- ফোঁটা করে জল ঝরছিল। সেই বিন্দু জলকণার দিকেই আমার যতো মনোযোগ ছিল। ঠিক তখনই রাব্বি আচমকা প্রশ্নটা করে বসলো,
“একটা কথা বলবি বন্ধু? যখন তোর বাবা মারা গিয়েছিলেন...সেই সময়টার কথা একটু বলবি?
সম্পূর্ণ মনোযোগ মুহূর্তেই কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। ঠিক বৃষ্টি শেষে আকাশের কালো মেঘগুলো যেমন মিলিয়ে যায়...অথবা শহরের পিচডালা রাস্তার ধারের সোডিয়াম আলোর মতো, যে আলোয় মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলের টিউশন শেষে, ঘোর লাগা চোখে দেখা ধূসর স্বপ্নের মতো, যা শেষ মুহূর্তের দীঘশ্বাসই শুধু। কিংবা ধরতে না পারা ঘাসফড়িঙটার মতো,মাঝে মাঝে শুধু আফসোসই করতে হয়।
মুহূর্তেই চলে গেলাম নয়বছর আগে কতো সহজেই। সে দিন বরাবরের মতোই বাবা সুস্থ শরীরে ঘুমাতে গেলেন। দুঃস্বপ্নের শুরুটা ঠিক আধা ঘণ্টা পরেই। আজবধি বুঝে উঠতে পারিনি। মায়ের কান্না জড়ানো কণ্ঠ শুনে সবাই ছুটে গেলাম। বাবার বুক জুড়ে হটাত ব্যথা। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কি করতে হবে, কি করা উচিত।পাগলের মতো ছুটছিলাম। খুব একটা ভাবার সময় পেলাম না। তাঁর আগেই সব রাতের আঁধারের মতো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। সবাই কাঁদছে, সবার চোখেই জল। শুধু আমিই বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে। নোনা জলের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম খানিক পরেই। কি আশ্চর্য, এই চোখের পানিই আমার ছেলেমানুষি অভিমান নয়তো নতুন বায়নার কারণেই ঝরেছে। এছাড়াও যে চোখে পানি আসতে পারে কোনদিন ভাবিইনি আমি। বাবার নিথর দেহ পড়ে রইলো। আমি বসে রইলাম বাবার পাশেই। আগরবাতির কড়া গন্ধ ছড়ানো শুরু করলো। কুরআন তিলায়াত চলছে উচ্চ স্বরে। কেউ একজন এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আমার। আমি তাকিয়ে দেখেনি কে সেই মানুষ। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। আহারে, বাবার মতো কেউ তো আমাকে এসে আর কোনদিন মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে না। এত যে অভিমান আমার, কে আদর করে ভাঙ্গাবে শুনি? রাতে ভয় পেলে কাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরবো? কতো প্রশ্ন, একটারও কোন উত্তর নেই। উত্তর দিবেই বা কে। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজনে পুরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। কতো রকমের কতো ধরণের সান্ত্বনা। কিন্তু কিছুতেই অশ্রুর বাঁধ থামানো যাচ্ছে না। সকাল গড়িয়ে দুপর গড়িয়ে বিকাল হলও। কাছের দুরের সব মানুষ উপস্থিত হলেন। বাবার দাফন করার সময় ঘনিয়ে এলো। আমার কাছে তখন একটা কথাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো , আমি আর আমার বাবার মুখ দেখতে পাবো না। খাটিয়ার উপরে কি নিশ্চিন্তে নির্ভার নিথর হয়ে বাবা শুয়ে আছেন। গোসল করিয়ে আনার পর স্পষ্টভাবেই মনে হলও বাবা ঘুমুচ্ছেন। যেন কিছুক্ষণ পরেই ঘুম থেকে জেগে উঠে বলবেন,
“কিরে বেটা, তোর চোখে পানি কেন? কান্নাকাটি থামিয়ে বল কি লাগবে তোর”
বাবার পবিত্র চেহারার দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ থেকেই বলে উঠলাম,
“বাবা, একটা বার ঘুম থেকে উঠো। বিশ্বাস করো এই পৃথিবীতে আমি যদি আর কিছু চাই কোনদিন...!!”
তাও বাবার ঘুম ভাঙ্গাতে পারিনি। আমার সব অভিমান বুঝি আজ বাবা একাই করলেন!শেষ বারের মতো বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। বাবার খাটিয়া উঠানো হলও। আমাকে কেউ খাটিয়া কাঁধে নিতে দিচ্ছিল না, ছোটো ছিলাম বলেই হয়তো। আমি জোর করেই কাঁধে নিলাম।আমার সেই বাবাকে, যিনি আমাকে কোলে করে বয়ে গেছেন আজীবন। সেদিন বুঝলাম, সন্তানের কাঁধে পিতার লাশ কতটুকু পাথরের মতো ভারী। পাঁজর ভাঙ্গা কষ্ট কাকে বলে, সেদিন খুব ভালো করেই উপলব্ধি করেছিলাম। দুচোখ পানিতে জাপ্সা হয়ে যাওয়াতে সামনে কিছুই দেখছিলাম না।এই চাপা কষ্টটা আমি কোনদিনই কাউকে বুঝাতে পারিনি। বুঝাতে চাইও না। জানাজা শেষে বাবাকে কবর দেয়া হলও। সবাই চলে গেলেও আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। কেউ একজন আমার পাশে এসে বলল,
“খাইতে চলেন। কাইল রাইত থেইকা তো না খাওয়া।“
আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। কি অদ্ভুত! সে দিন থেকে বুঝে উঠলাম, এই পৃথিবী কতটা নির্দয়ের মতো চলতেই থাকে। কেউ আসবে কেউ যাবে, তাতে পৃথিবীর কিছুই যায় আসে না। সবচেয়ে বড় নিষ্ঠুরতা হল, আমাকেও সেই রকমই চলতে হবে।
বাবা মা যে পৃথিবীর মাঝে মানুষের সবচাইতে আপনজন, সেটা যার চলে যায়, তার উপলব্ধিটাই বেশী।
আত্মীয়স্বজনদের সান্ত্বনা তখনও চলছিলো,
“বাবা, তুমি কিছু চিন্তা কইরো না।দেখবা সব ঠিক হইয়া জাবে।আরে আমরা আছি না। তোমার যখন যা লাগবে, খালি আমারে বলবা।আমি আইনা দেবো।“
কিশোর মন ভোলানোর জন্য এর চাইতে বেশী আর কি লাগে? অবাক হওয়ার বিষয় হলও, ঐ বলা পর্যন্তই আমি অনেক খুশি এখন। এরপর খুঁয়ে খুঁয়ে চলার পথে যে সেইসব মানুষকে আর পাইনি!!! আজকাল বলেই বা কজন ? করুণার দৃষ্টিতে আজকাল শুধু এটাই তো শুনি,
“বাবা, তোমাদের সংসার চলে কিভাবে? ইনকাম করার মানুষ তো দেখি না?”
প্রথম প্রথম প্রচণ্ড রাগ হতো। যেন আমাদের সংসার চলার সব চিন্তা উনাদেরই। এখন সবার দোষও দেই না। কৌতূহল আজীবনই থাকে। কিন্তু অস্বাভাবিক কৌতূহল না থাকলেই ভালো।
আর আমি??? এখন আমার পৃথিবী কেমন জানি না। বাঁচতে হবে বলেই হয়তো বাঁচি। সৃষ্টিকর্তার অশেষ করুণায় পথ চলার শুরু নতুন করে। কল্পনাবিলাসী ছেলের এই এক সমস্যা, মাঝে মাঝেই কল্পনাকে শত নিয়ন্ত্রণের পরেও বাস্তবতার সাথে গুলিয়ে ফেলা। খানিকবাধেই মনে পড়ে, এটা তোমার জন্য না। তোমাকে তো সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এগিয়ে যাও, যতটুকু যাওয়া যায়।
রাব্বি আমার কাঁধে হাত রাখল,
“মন খারাপ করিয়ে দিলাম মনে হয়। হটাত জানতে ইচ্ছা হচ্ছিলো।“
আমি চমকে উঠে ফিরলাম। আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে।আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম,
“ব্যাপার না। তুই বস একটু। চা বানিয়ে আনছি।সবই বলব তোকে। কষ্ট তো একটু হবেই। পুরোটাই বলব তোকে।“
বৃষ্টির তোড়জোড় বাড়ছে, সেই সঙ্গে তোলপাড় করা কষ্টটাও। চোখে কখন পানি এলো টের পেলাম না। এই অশ্রু কেউ এখন আর দেখে না, আজও দেখল না।
(সমাপ্ত)
E-mail-- [email protected]