এরপর আমি চুপ করে না থাকতে পেরে ১৯ বছর বয়সে বুড়ো বাপ আর মা সহ সংসারের হাল ধরার জন্য বিদেশে পারি জমাই। আল্লাহর রহমতে, এক বছরের মধ্যে আমি আমার পারিবারিক অবস্থ্যান সাভাবিক অবস্থ্যায় নিয়ে আসতে সক্ষম হই। এর মাঝে পরীর মত একটা মেয়েকে আমার স্ত্রী হিসেবে পাই। কিছুদিন পরেই আল্লাহর রহমতে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার পাই আমার ছেলে সন্তানকে। আমাকে সব সময় আমার পরিবারকেই সাহায্য করে যেতে হয়েছে। সেজন্য আমি আমার স্ত্রীকে কিছুই দিতে পারিনি। সব সময়ই আমার স্ত্রীও হাসি মুখে আমাকে সাপোর্ট দিয়েছেন। কখনো মুখফুটে দরকারের বাইরে কিছুই চায়নি। হয়তবা এমনো যেজিনিসটি তার ব্যাক্তিগত দরকারী সেটিও সে উৎসর্গ দিয়েছে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে। সব সময় তার পক্ষ থেকে সাপোর্ট পেয়েছিলাম। তাই কেউ বলুক আর না বলুক আমি নিজ মনে আজ সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারি। তার এ সাপোর্ট না পেলে হয়ত পারতাম না।
সময়টা ২০১১ সাল। বেশ সুখী পরিবার ছিলাম আমরা। আমার ছেলের বয়স তখন দুই ছুই ছুই করছে। বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে অফিস কাজে ব্যাস্তো সময় পার হত তখন। চাকুরীর সুবাদে আমিরাতের 'রুয়াইস' নামক ছোট একটি শহরে আমার বসবাস। মানুষ বলতে এখানে যদিও আমি একা তবুও আমার গুনবতী স্ত্রীর ভালোবাসায় কখনো মনে হয়নি যে আমি তাদের সবাইকে ছেড়ে এতটা দুরে আছি। কখনো বুজতেই পারি নাই যে দুরে আছি। সবসময় মোবাইল বা ল্যাপিটে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ পৃথিবীর দুই প্রান্তে বসবাসকারী মানুষদুটোকে যেনো বুজতেই দেইনি দুরত্বটা কি? তাই ভালোই পার হচ্ছিল সময়গুলো। ৬-৭ মাস পর পর একমাসের জন্য বাংলাদেশেও যাওয়া হত। সবাই একসাথে হতাম। বাসায় স্ত্রী ছাড়া থাকতেন বাবা-মা, বড় ভাইয়ের বড় ছেলে, আর বড় মেয়ে।সাথে আমার টাইগার (সন্তান) উনি তো ঐ বাসার নেতা। সবাই ওকে নিয়েই ব্যাস্ত থাকতো।
সময়টা ২০১১ অক্টোবার। হটাৎ আমার প্রান প্রিয় আম্মুর ফুসফুসে কান্সার ধরা পরলো। আমি তো বুজে গেলাম যা হবার তা। তারপরেও চেস্টার কম করিনি। সবাই আমাকে আশাদিলো সব ঠিক হয়ে যাবে। চিকিৎসা করতে লাগলাম সবাই মিলে। আশার আলো দেখা দিলো। ফোনে কথা হত সবার সাথে। আমিও বেশ সাহস সন্চয় করে দেশে যাবার জন্য রওনা হবো বলে তৈরী হচ্ছিলাম। তখন রোজা চলছিলো। ১ অক্টোবর ২০১১ সালে এয়ার টিকিট কন্ফার্ন করি ১৪ অক্টোবরে বাংলাদেশে যাবার জন্য। তারপর থেকে আমি আর আমার এক পাকিস্তানি কলিগ একটা একটা করে দিন গুনি। আমি বলি আসিফ ভাই ওর কিতনা বাকি হ্যায়। আসিফ উত্তর দেন - ১০ দিন বাকি। এভাবে প্রতিদিন সকালে বিকালে আমার আর আসিফের একি বাক্য কথন হলরুমের সবার দৃস্টিগোচর হওয়ায় যখনি আমি আসিফ কে জিগেস করতাম তখন সবাই একি সাথে উত্তর দিতো লাইক ইকোসিস্টেমের মত। এভাবেই সেই দিন গুলো কেটে যাচ্ছিলো। আমার যাবার দু একদিন পরেই ঈদ তাই মেজাজটাও ফুরফুরে। ৭ অক্টোবার ২০১১, আমার ছেলের জন্মদিন। কিন্তু আমার মনে ছিলো না। ঐ দিন সে দুবছর বয়সে পা দিবে। যেকোনো কারনে সে তখণ তার নানী বাড়ি অবস্থ্যান করছিলো। ৭ তারিখ সকালে মা হাসপাতাল থেকে শুয়েই আমাকে ফোন দেন। আমাকে মনে করিয়ে দেন আমার ছেলের জন্মদিনের কথা। আর বলেন তাকে যেনো ঢাকাতে পাঠাই। মার খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।আমি মাকে সান্তনা দিই । বলি হুম আম্মু পাঠিয়ে দিবো। ঐদিন মা আমার কাছে তার জীবনে প্রথমবারের মত কিছু চান। তিনি বলেন বাবা, আমার খুব ইচ্ছা আমার জন্য তুই একটা গান শুনানো মোবাইল নিয়ে আসবি। ঐ যে এমপিথ্রি গান শোনা যায় সেই মোবাইল। মা আমার কাছে কোন কিছু মুখ ফুটে চাননি। এই প্রথম চাইলেন। এছাড়া আমার বড় ভাই আছেন। তাদের কাছে না চেয়ে তিনি আমার কাছে চেয়েছেন। এটাই আমার বড় পাওয়া। সেদিন বিকেলে আমি কাছের মার্কেট থেকে নকিয়া ৫৩১০সি কিনে আনি মার জণ্য। কি যে আনন্দ লাগছিলো তখণ। আমি আমার সারা জীবন দিয়ে দিলেও তা সেই আনন্দ পেতাম না। সেদিন রাতেই মাকে স্কাইপে দেখিয়ে ছিলাম। মা এই লাল টুকটুকে আর কালোর মিশ্রনে এই মোবাইলটা তোমার জন্য। মা এই মোবাইল টার ক্যামেরাও আছে। এমপি থ্রীও আছে। মা কিযে খুশী হয়েছিলেন বলে বোঝাতে পারবো না।
স্কাইপির দিয়েই মোবাইল টা ভালো মত দেখে নিয়েছেন। বলছিলেন এপাশে করতো দেখি, ওপাশে করতো দেখি। এভাবে দেখেছিলেন। পরদিন হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হল তাকে। কেমো থেরাপি দেওয়া হয়েছে। শুনেছি বিছনায় পেসাব পায়খানা করছেন। কস্ট হলেও তাদের দেখার জণ্য মনটা বেশ খুশী খুশী ছিলো। কিন্তূ ঐ ৭ তারিখের পর থেকে আমি আর তার সাথে কথা বলতে পারি নাই।
কেমোথেরাপির পর থেকে উনি কথা বলতে পারতেন না। ঘুমিয়ে কাটতো সবসময়। এছাড়া বিদেশে থাকার কারনে সবাই খুলে কিছু বলতো না। আমিও খুশি মনে ছিলাম আর দুদিন পরে তার কাছেই যাবো বলে। প্রতিদিনি তার মোবাইলটা দেখতাম। আমার মা আমার কাছে প্রথম কিছু চেয়েছেন। তা দিতে পেরে নিজেও যেনো এমন কিছু একটা করতে পেরেছি যে জীবনের শ্রেস্ঠ স্বাদ নিতে পারার মত লাগছিলো।
১১-অক্টোবর-২০১১।
সময় বিকাল ৬.৩০ মিনিট।
কোম্পানি বুফে-তে ডিনার করছি। সেদিন ছিলো মঈলবার। ও দিনে বুফে তে মুরগীর ফ্রাই থাকে। আমি আবার সেটা খুব পছন্দ করি। এছাড়া ১৪ তারিখে চলে যাবো। তাই ১-২ মাস এটা খেতেও পারবো না। তাই ফুরফুরে মেজাজে ট্রেতে সবকিছু নিয়ে এসে আমি, মামা আর পাকিস্তানি আসিফ খেতে বসেছইলাম।একটা মুরগীর রোস্ট মুখে নিয়ে চাবাবো ঐ সময়ই ফোনটা বেজে উঠলো। দেখলাম আমার গুনবতী স্ত্রী। চাবানো বাদ দিয়ে বিরক্তির সাথে ফোন ব্যাক করলাম। ওপাশ থেকে মায়াবী কন্ঠ ভেষে আসলো- বললো কেমন আছো।
আমি একটু ভাবাচেকা খেয়ে বললাম এ কি কথা বললে যে মনে হয় তুমি অনেক দিন পরে ফোন দিলে । একটু আগেই তো তোমার সাথে আমার ফ্রিং এ চাটিং হল। সে হুম বললো। আর জিগেস করলো কবে আসতিসো। খুবি মৃদু সরে।
হটাৎ করেই সে গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে বলে উৎলো তুমি তারা তারি আসো এখনি আসো না হলে ওরা তোমাকে দেখতেও দিবে না। আমি কিছুই বুজলাম না, মানে কি ? ও বললো- ওগো.. !! মা আর নাই। ---- মা --- আর---নাই।
আমি তাকে ধমক দিয়ে বল্লাম চুপ কর পাগোল হয়ে গেছো তুমি। মা নাই ভালো কথা, যার যাবার সে গেছে। আমি এখন মুরগীর রান খাচ্ছি তা আমাকে শান্তি মত খেতে দাও।বলেই ফোন রেখে দিলাম। এই বলেই মুরগী হাতে নিয়ে মুখে কামর দিয়ে চাবাচ্ছি। কিন্তু সেই মুরগী আর ভেতরে নিতে পারিনি।
শেষ মেষ সেই রাতের এ্য়ারটিকিট না পাওয়ায় ১২ তারিখে দেশে যাই। কিন্তু আমি যাবার আগেই 'মা' লাশ দাফন হয়ে যায়। শেষ দেখা দেখতে পাইনি।
হুম। সেই মোবাইলটা আমার বুক পকেটে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সারাক্ষন আমার কাছেই রেখেছিলাম। বার বার দেখছিলাম। শত চেস্টা করেও মায়ের শেষ ইচ্ছাটা পুরন করতে পারলাম না।
এর থেকেও বেশি কস্টলাগে সেই দিন 'গুনা'(কাউন্ট ডাউন) গুলো। ১ অক্টবর থেকে ১১ অক্টোবর প্রতিটা দিনি গুনতাম দেশে যাবার দিন হিসেব করে। কিন্তু আসলে সেই কাউন্টডাউনটা ছিলো মায়ের মৃত্যু ঘন্টার। এর চেয়ে বড় কস্টের আর কি হতে পারে।এ আল্লাহ তুমি আমাকে এ কোন পাপের শাস্তী দিলে যে আজও আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়।
মাগো আজ তোমাকে কেন যেনো ভিষন মনে পরছে মা। আজ ২০১৪ সালে এসে কেন জানো তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছা করছে মা। আমি সেদিন হতে আজ পর্যন্ত শান্তি করে ঘুমাতে পারিনি মা। মা তুমি একটু জায়গা দাও তোমার আচল দিয়ে। আমি যে বড় পাপী মা। কত না বুজে তোমাকে কস্ট দিয়েছি মা। আমাকে তুমি ক্ষমা করো মা। ক্ষমা করো। একটু শান্তি এনে দেও। আল্লাহকে বলে আমাকে একটু শান্তি এনে দাও।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৫:৫৩