চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম দফায় ৪০ জেলার ৯৭ উপজেলায় ভোট চলছে শান্তিপূর্ণভাবে।
Published : 19 Feb 2014, 07:20 AM
বুধবার সকাল ৮টায় এসব উপজেলার প্রায় সাত হাজার ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে; চলবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। ভোটের কারণে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ পরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান বেলা ১১টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব উপজেলায় নির্ধারিত সময়ে ভোট শুরু হয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবেই সব চলছে। এ পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।”
এ নির্বাচনে সব দলেরই অংশগ্রহণ থাকায় গত পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো গোলযোগেরও আশঙ্কা করছেন না নির্বাচন কমিশনের এই কর্মকর্তা।
সকালের শুরুতে ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বাড়ছে বলে জানান আসাদুজ্জামান।
“কোথাও কোথাও বেশ উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ হার বাড়ছে।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন, উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে সব ব্যবস্থাই তারা নিয়েছেন।
“সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ নির্বিঘ্ন পরিবেশ তৈরিতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোনো ধরনের আইন লঙ্ঘন বরদাশত করা হবে না।”
পাবনার সুজানগর উপজেলায় সকালে ভোট শুরুর দুই ঘণ্টার মধ্যে এজেন্টদের বের দেয়ার অভিযোগ এনে নির্বাচন বয়কট করেছেন বিএনপি সমর্থক চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হাজারী জাকির হোসেন চুন্নু।
এদিকে ভোটে কারচুপির অভিযোগে বৃহস্পতিবার সুজানগরে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে পাবনা জেলা বিএনপি।
মাগুরা সদর উপজেলায় সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ কেন্দ্রের বাইরে বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী নাজিমউদ্দিনের পক্ষে আচরণ বিধি লংঘন করে ছবি ও নির্বাচনী প্রতীক সম্বলিত ভোটার স্লিপ বিতরণ করার অভিযোগ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী পঙ্কজ কুণ্ডু।
আরো দুএকটি স্থানে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। বড় কোনো গোলযোগের খবরও কোথাও পাওয়া যায়নি।
সব উপজেলাতেই শান্তিপূর্ণ ভোট চলছে বলে আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। কোথাও কোথাও ভেটকেএন্দ্র দেখা গেছে উৎসবের আমেজ।
এই পর্বে গাজীপুরে ভোট হচ্ছে কেবল কাপাসিয়া উপজেলায়। রিটার্নিং অফিসার ও গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শাহনওয়াজ দিলরুবা খান জানান, সকাল ৮টায় শান্তিপূর্ণভাবে ভোট শুরু হয়েছে। কোথায় কোনো গোলযোগের খবর তারা পাননি।
প্রথম ধাপের ভোটতথ্য
প্রথম ধাপে তিন পদে (চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান) ৯৮ উপজেলায় মোট ১ হাজার ২৭৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এর মধ্যে চেয়ারম্যান প্রার্থী ৪৩২, ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৫১৩ ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ৩২৯ জন।
মোট ভোটার ১ কোটি ৬৪ লাখ ৭৮ হাজার ১৭২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৮১ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৭ জন, মহিলা ভোটার ৮২ লাখ ৮৬ হাজার ৬৩৫ জন।
ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৬ হাজার ৯৯৫টি, ভোটকক্ষ ৪৩ হাজার ২৯০টি।
প্রতি ভোটকেন্দ্রে একজন করে ৬ হাজার ৯৯৫ জন প্রিজাইডিং কর্মকর্তা থাকছেন। সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা প্রতি ভোটকক্ষের জন্য এক জন করে মোট ৪৩ হাজার ২৯০ জন। পোলিং কর্মকর্তা থাকছেন ৮৬ হাজার ৫৮০ জন।
নির্বাচন কমিশন প্রথম দফায় ১০২টি উপজেলার তফসিল ঘোষণা করলেও সীমানা নির্ধারণ নিয়ে জটিলতার কারণে রংপুরের চারটি (সদর, পীরগাছা, গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া) উপজেলায় ভোট স্থগিত করা হয়।
এ ধাপের ভোটে চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ নির্বাচিত হননি। চেয়ারম্যান পদে সর্বোচ্চ ১৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন নরসিংদীর বেলাবো উপজেলায়।
ভাইস চেয়ারম্যান পদে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে একজন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে শরীয়তপুরের জাজিরা ও বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলায় একক প্রার্থী থাকায় তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
উপনির্বাচনের কারণে পীরগঞ্জ উপজেলার ভোট পিছিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি করা হয়। এ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ৩, ভাইস চেয়ারম্যানে ৮ ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। দুই লাখ ৬২ হাজার ৭৩৫ ভোটারের জন্য কেন্দ্র রয়েছে ১০৬টি।
নির্বাচনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সোমবার থেকে ৫ দিনের জন্য মাঠে থাকছে সেনাবাহিনী। সঙ্গে থাকছে র্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য।
‘নির্দলীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক হাওয়া’
স্থানীয় সরকারের নির্দলীয় নির্বাচনে দলীয় প্রভাব রয়েছে সবখানেই। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের পছন্দমতো প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে। কয়েকটি উপজেলায় একক প্রার্থী করতে ‘বিদ্রোহী প্রার্থীদের’ দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে।
বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলেও স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে প্রার্থীদের সমর্থন দিচ্ছে। ভোটের আগের দিন মঙ্গলবার লিখিত অভিযোগও জানিয়েছে বিএনপি।
তবে নির্বাচন কমিশন বলেছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে তা খতিয়ে দেখবে ইসি।
নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ বলেন, “দলীয় নির্বাচন না হলেও সমর্থন দিচ্ছে দলগুলো। কোনো অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানাতে হবে। সেক্ষেত্রে ঢালাও কোনো অভিযোগ করলে অসুবিধা হয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করতে হবে।”
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের ৩২ ঘণ্টা আগে প্রার্থীদের সব ধরনের প্রচার বন্ধের বিধান রয়েছে।
ইসি সচিবালয়ের সহকারি সচিব আশফাকুর রহমান জানান, এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে নির্বাচনের পর ৬৪ ঘণ্টা পর্যন্ত।
কেউ আইন ভঙ্গ করলে কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানা করা হবে। সর্বোচ্চ ক্ষমতা ইসির রয়েছে- প্রার্থিতা বাতিল। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ১ বছর কারাদণ্ড ও লাখ টাকা জরিমানর বিধান রয়েছে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সেনাবাহিনী নির্বাচনের আগে ও পরে মিলিয়ে মোট পাঁচদিন নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে থাকবে তারা। প্রতি উপজেলায় ১ প্লাটুন করে সেনা সদস্য টহল দেবে।
পাশাপাশি প্রতি উপজেলায় সেনাবাহিনীর দুই থেকে তিনটি গাড়ি থাকবে। সঙ্গে সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ও একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন।
এছাড়া মোবাইল ফোর্স হিসেবে পর্যাপ্ত র্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকছে।
প্রতি কেন্দ্রে একজন পুলিশ (অস্ত্রসহ), অঙ্গীভূত আনসার একজন (অস্ত্রসহ), অঙ্গীভূত আনসার ১০ জন (নারী ৪, পুরুষ ৬ জন) এবং আনসার একজন (লাঠিসহ) ও গ্রামপুলিশ একজন করে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবে।
পার্বত্য এলাকা, দ্বীপাঞ্চল ও হাওর এলাকায় এ সংখ্যা শুধু পুলিশের ক্ষেত্রে দু’জন হবে।
১৯ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে ৩৮৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ৯৭ জন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় নেয়া হচ্ছে বিশেষ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দাসংস্থা নির্বাচনে সম্ভাব্য গোলযোগ ঠেকাতে চারটি সুপারিশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশনে।
ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগ থেকে পরের দুই দিন গোপন নজরদারি, সম্ভাব্য হামলাকারীদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তাদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি অন্যদের নজরদারিতে রাখা, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় সার্বক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ভোটের আগে-পরে এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করার কথা বলেছে সংস্থাটি।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে ইসির উপসচিব পর্যায়ের এক কর্র্মকর্র্তা জানান, জেলা-উপজেলাওয়ারি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোর নাম, সম্ভাব্য গোলযোগপূর্ণ ভোটকেন্দ্র, গোলযোগের সম্ভাব্য কারণ, সম্ভাব্য গোলযোগকারীদের নাম ও রাজনৈতিক পরিচয়ের তালিকাও দিয়েছে সংস্থাটি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ইতোমধ্যে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতে তাগিদ দিয়েছেন।
তবে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকায় কোনো ধরনের সহিংসতা ও গোলযোগের শঙ্কা করছে না নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি।
সোমবার নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, “গোয়েন্দাসংস্থা ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যে প্রতিবেদন আমরা পেয়েছি তাতে সহিংসতার শঙ্কা নেই। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ নজর দিতে বলেছি।”
“অত্যন্ত স্পর্শকাতর এলাকাগুলোয় আইন শৃঙ্খলাবাহিনী সজাগ থাকবে। ছোটখাটো কিছু হলেও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিজাইডিং অফিসারদের মধ্যে ১৯ জেলার ৩২ উপজেলায় ৫৯০ জন কর্মকর্তাকে নেতিবাচক হিসেবে চিহ্নিত করেও তালিকা দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাটি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও ইসি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল কাজ শুরু করেছে। সোমবার এ মনিটরিং সেল গঠন করা হয়। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা তিন দিন এ সেল কাজ করবে।
দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক
সাংবাদিক, দেশীয় এনজিও এবং বিদেশীরা উপজেলা নির্বাচন পর্যবেক্ষনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চারটি সংস্থার ৭১ জন বিদেশী পর্যবেক্ষক করছেন। এগুলোর মধ্যে এশিয়া ফাউন্ডেশনের ২, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ৫৪, জাপানের ৯ এবং এনডিআইয়ের ৬ জন।
এছাড়া ২৬ দেশীয় এনজিওর ৬ হাজার ৫৮৯ জন পর্যবেক্ষক থাকছেন।
দ্বিতীয় ধাপে ১১৭ উপজেলায় ২৭ ফেব্রুয়ারি, তৃতীয় ধাপে ৮৩ উপজেলায় ১৫ মার্চ, চতুর্থ ধাপে ৯২ উপজেলায় ২৩ মার্চ ভোট হবে।
পঞ্চম ধাপের অর্ধশতাধিক উপজেলার তফসিল বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হবে। বাকি উপজেলায় ষষ্ঠধাপে ভোট হবে মে মাসে।