somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মোদের গরব মোদের আশা, আর লাইন ঠিক করা নাকটা।

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



একুশে ফেব্রুয়ারিতে নানান অভিজ্ঞতা হয়, তবে এবারেরটা দ্বন্দ্বময় এবং আঁচড় কাটা। মানে আক্ষরিক অর্থেই ডান গাল এ আঁচড়ের দাগ; এই সকালেও সমুজ্জ্বল।

সেই বিকেল ৩:৩০ থেকে দাড়িয়ে আছি। টিএসসিতে থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে প্রবেশের বিশাল লম্বা লাইন। আমি সেই লাইনেরই সামান্য একজন সদস্য। প্রতি পনের মিনিটে পনের কদম গতিতে এগুচ্ছি। কখনো সেটাও না। এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা। আবার হঠাৎ একটা গতি তৈরি হলে দৌড়ে যেয়ে শূণ্যস্থান পূরণ করা। আমার ডানদিকে হরেক-রকমের পথ-বিক্রেতা আর বাম-দিকে হরেকপদের মানুষ। লম্বা লাইনে না দাঁড়িয়ে যখন তখন লাইনে বাম হাঁত ঢোকানোর জন্য উদগ্রীব। কখনো বিনয়, কখনো অনুরোধ, কখনো ধমক, কখনো গায়ের জোর, কখনো বা কৌশল, একা এবং স্বপরিবারে।

সংগ্রামে যা হয়, হৃদ্মতা গড়ে ওঠে সহযাত্রীদের সাথে। আমার পেছনে একজন মধ্যবয়ষ্ক মানুষ এবং সামনে একজন তরুণী। মোটামুটি এই বিন্যাসেই এগিয়ে যাচ্ছি। তাদের ঠিক সামনেই বাবা মা এবং তাদের কিশোরী মেয়ে, যিনি পথের একটি বিপণন দ্রব্যকেও মাফ করছেন না। বাঁশি, লেইস, থ্রী পিসের ডিজাইন, এমনকি শাড়ি সবকিছুর দরদাম করছেন। এবং যা হয়, দরদাম একটা সওদামূলক অবস্থায় আসার সাথে সাথেই লাইন এগিয়ে যায়; মেয়েটিও স্ব-পরিবারে সামনে চলে যান। বিক্রেতার বিরক্তি এবং অনুচ্চারিত গালাগালি সহ্য করতে হয় লাইনের পরের লোকগুলোকে। এরই মধ্যে দেখলাম পথ বিক্রেতাদের কাছ থেকে চাঁদা তুলছেন আরেক যুবক, কখনো ধমক, কখনো আদর তার বা-গালেও লেখা মহান একুশে ফেব্রুয়ারি।

পেছনের মধ্যবয়ষ্ক মানুষ প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন, কত পার্সেন্ট এলাম? আর কতদূর? আমি বিজ্ঞের মত উত্তর দিতে থাকি। এভাবে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা যখন ২৫ পার্সেন্টের মত দূরে তখন দেখা দিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বইমেলার প্রায় মুখোমুখি দুই প্রবেশপথে জনসমুদ্র, যা কোন্দলে রূপ নিয়েছে। "বাঙ্গালীকে লাইনে রাখা সহজ নয়" কথাটার প্রমাণ দিতেই কিনা আমরা চর্তুমুখি আক্রমণের শিকার হলাম। পেছন থেকে ঠ্যালা তো আছেই, এরমাঝে যারা সোহরাওয়ার্দীতে ঢুকতে পারছেন না তারা ছিটকে এসে লাইনে আঘাত করছেন, যারা বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন তারা ডানদিক থেকে ক্রমাগতভাবে ঠেলছেন। দোয়েল চত্বর থেকে আরেকটি জনসমুদ্র ধেয়ে আসছে। অন্যদিকে তক্কে তক্কে থাকা হায়েনার মত, লাইনহীন সুবিধাবাদী গোষ্ঠী এই ভিড়ের মধ্যেও তাদের গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাঁয়তারা কষছেন।

ঠিক এই সময়ে আমি সামনের তরুণীকে বললাম, "আপু রেলগাড়ী হওয়া ছাড়া তো কোন পথ দেখছি না, তিনি সম্মতি দিলেন। এদিকে পেছনের আঙ্কেলকে বললাম, আমার ব্যাগটা শক্ত করে ধরেন"। আমরা যখন জোটবদ্ধ হয়েছি এবং পাশাপাশি দুটি ত্যাগী, ধৈর্যশীল, সৎ লাইন এগিয়ে যাচ্ছে তখনি মূল আঘাতটা এল। অর্থাৎ অবিশ্বাস এবং ইনসিকিউরিটি। দুটো লাইন, দুটোই সৎ, ক্লান্ত, বিরক্ত; কেননা এতটা পথ যুদ্ধ করে এসেছেন। ডানদিক থেকে এক মধ্যবয়ষ্ক ভদ্রলোক এই সরেন সরেন করে গায়ের জোরে বাঁদিকের লাইনকে ধাক্কা দিয়ে লাইনচ্যুত করতে উদ্যত হলেন। আর যায় কোথায়, আমি তাকে ঠেকাতে যেতেই তিনি বললেন, "আপনি তো লাইনের না"। কি!! এতবড় কথা? তিনি ধাক্কা দিয়ে আমার সামনের তরুণীকে সরিয়ে "লাইন ঠিক করতে" গেলেন। আর তখনি প্রতিরোধ। গায়ের জোরে আমার সাথে তিনি পেরে উঠছিলেন না, তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন তার বালিকা কন্যা আর কিছুক্ষণ পর তার তরুণ ছেলে। এদিকে কোন বেয়াদপ তখনো আমার ব্যাগ ধরে পেছনের দিকে টানছিল।

হাতাফাইয়ের উত্তেজনাকর মূহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল, দুই সন্তানের সামনে তার বাবার, "লাইন ঠিক করা নাকটা" যদি ভোঁতা করে দেই; তাহলে এর ট্রমা এই দুই সন্তান কোনদিনই ভুলতে পারবেন না। আর ঠিক তখনি যাত্রার বিবেকের মত সামনে চলে এলেন আমার পেছনের আঙ্কেল, জোর গলার বলতে থাকলেন, "কি বলেন এসব? গত এক ঘন্টা ধরে আমরা একসাথে লাইনে করে আসছি।" আমার সামনের তরুণীও সায় দিলেন। দুর্যোগের ঘনঘটা আরো একটু স্তিমিত হয়ে এল, যখন দুজন রমণী, শান্ত করে বললেন, "এসব নিয়ে রাগ করেন না, বইমেলা ঘুরতে এসেছি; মারামারি করতে তো নয়"। আমি তখন কার্যতই লজ্জা পেলাম। আতংকিত এবং উত্তেজিত পরিবারটি সামনে এগিয়ে গেলেন। আমার সামনের তরুণীটিও সামলে নিয়েছিলেন।
অবশেষে দুটি সৎ, ক্লান্ত, বিরক্ত লাইন মার্জ করে প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে গেল।

ঘটনার পুনঃপাঠ:

১. বিভিন্ন জাতীয় উৎসব, আয়োজনে পিপিলিকার মত মানুষ যায়। কেন যায়?
২. বই মেলার এই দ্বিমুখী পরস্পর বিরোধী প্রবেশপথ এবং বহির্গমন, পূর্বের তিনটি আয়োজনের চাইতে অগোছালো এবং অনিরাপদ।
৩. তাহলে কি মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে উৎসবে যাবে না?
৪. এই নিরাপত্তাহীনতার শেকড় কোথায়? অব্যবস্থাপনায়? সামাজিক অবিশ্বাসে? নাকি নিয়মিত অবিশ্বাস উৎপাদনে? এই যে যেমন অনেকেই লাইন ব্যবস্থাকে ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা করছিলেন।
৫. পুরো উত্তেজনা ও প্রায় হাতাহাতির ঘটনাটি সম্পুর্ণ পরিস্থিতিজাত নয় কি?
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:৩২
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রোড জ্যাম ইন ভিয়েতনাম

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৭



আমার ধারনা ছিল জটিল জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই লাগে । কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিল । ভিয়েতনামে এরকম জটিলতর জ্যাম নিত্য দিনের ঘটনা । ছবিটি খেয়াল করলে দেখবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×