somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওরা বড় অসহায়!! (একটি অসহায় মেয়ে "রিমার" গল্প)

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ভোর ৪:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


হাতে একটু সময় নিয়ে পড়বেন
সবার প্রতি অনুরোধ রইলো।


বাপ মা হারা ছোট্ট মেয়েটা জীবিকার সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে এসেছে। একটা কাজ দরকার, যেকোন একটা কাজ।
দু বেলা কোন মতে খেয়ে পুরে বাঁচলে হয়। রাস্তার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
কোথায় যাবে, কার কাছে কাজ চাইবে? জানেনা কি করবে।
রোদ্রের অনেক তাপ! রাস্তার পাশে একটা পার্কের মধ্যে ঢুকে গেলো। ছোট ছোট অনেক ছেলে-মেয়েরা খেলা করছে।
তাদের সাথে তাদের বাবা, মা আছে। যেটা বায়না করছে সেটা কিনে দিচ্ছে তাদের বাবা।
অনেক ক্ষুধা লেগেছে, কি করবে ছোট্ট মেয়ে রিমা। ওই লোকটার কাছে গিয়ে কি কিছু খেতে চাইবো?
নাহ! যদি গালি দিয়ে তাড়িয়ে দেই? তবু যায়, ক্ষুধা যে আর তর সয়না!

কাকু, কইডা টাকা দেন না.. কিছু খাবো।
দুই দিন ধইরা ভাত খাইনা..কিছু দেন না?
ওই ছেমড়ি কে তোর কাকু লাগে? ফাইজলামো করিস?
যা দূর হ"" দূরে সরে দাড়া..
ইশ! আমার সোনা মনির গায়ে ময়লা লেগে গেলো! যা এখান থেকে..
লোকটির স্ত্রী রিমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো।
পার্কের একটা বেঞ্চে বসে ক্ষুধার যন্ত্রনায় অশ্রু ঝরছে রিমার দু চোখ বেয়ে।
আর দূরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে মহিলাটি তার মেয়েকে মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আইস্ক্রিম খাওয়াচ্ছে।
পার্ক থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটছে রিমা। রাস্তার পাশে একটা হোটেলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো রিমা।
অপার দৃষ্টিতে শিঙ্গাড়ার কড়াইটার দিকে তাকিয়ে আছে।

ও ভাই একটা শিঙ্গারা দেন না?
অনেক ক্ষুধা লেগেছে..টাকা আছে?
না নাই,
তাইলে ভাগ..দেন না ভাই।
আপনি যা বলবেন করবো। আমি সব কাজ করতে পারি।
দেন না..
তাই? সব কাজ করতে পারিস?
তাইলে যা, ভেতরে গিয়ে সব টেবিল পরিস্কার কর।আর কলস ভরে ভরে পানি নিয়ে আয়।
যদি পারিস তাইলে খাইতে দিমু।আচ্ছা করতেছি।
টেবিল পরিস্কার করে কলস নিয়ে পানি আনতে গেলো রিমা। হোটেল থেকে কল বেশ দূরে।
মাথার উপর প্রচণ্ড তাপ। কপালের ঘাম মাথা বেয়ে পড়ছে। কল চাপছে আর একটু একটু করে পানি খাচ্ছে রিমা।
এতো চাপছে তবু যেন কিছুতেই কলসিটা ভরছে না। আর পেরে উঠছেনা, ক্ষুধাতে শরীরে কাঁপ উঠে যাচ্ছে।
বহু কষ্টে কলসিটা ভরেছে রিমা। এখন হোটেল পর্যন্ত নিবে কেমন করে?
কলসি উঁচু করা যেন ওর সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবু তো নেয়া লাগবে।
কোন মতে টানতে টানতে রেস্টুরেন্ট টার সামনে গেল।
সেখানে অবস্থান রত লোকটা দৌড়ায় এসে একটা চড় মারলো রিমাকে।
এত দেরী লাগে?
তোকে কখন পাঠিয়েছি? রিমা কান্না জড়িত কণ্ঠে উত্তর দিলো, ভুল হয়ে গেছে ভাইয়া..
নাহ তোকে দিয়ে হবেনা। আরো এক কলস পানি আনতে হবে, আবার কত দেরী করবি কে জানে?
এবার আর দেরী হবেনা, দেন জলদি চইলা আসবো।
আরেক কলস পানি আনতে কলের উদ্দেশ্যে চলে গেলো রিমা। আর হয়ে উঠে নাহ, তবু যে পারতে হবেই..
পেটে যে রাজ্যের ক্ষুধা। আগের বারের থেকে একটু দ্রুত পৌছালো রিমা।
ও ভাই, এই যে আপ্নের পানি!! দেন না, কিছু খাইতে দেন না..
এই নে ধর,

মাত্র তিনটা শিঙারাই কি কিছু হয়? আরও দেন না?
ধুর ছেমড়ি যা দিছি তাই খাইয়া জলদি চলে যা।
একটু আগে হোটেলের মালিক লোকটা বাইরে থেকে এসে ভেতরে বসেছিল। তিনি বিষয়টা লক্ষ্য করলো।
ম্যানেজার কে ডেকে মালিক বলল, মেয়েটাকে দেখে অনেক ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে।
ওকে ভেতরে বসিয়ে কিছু খেতে দাও।
ম্যানেজার: ওস্তাদ এদের সাথে বেশী খাতির করবেন না পাইয়া বসবে। শিঙ্গারা দিছি ওই নিয়া জাগগা..
তোমাকে বলছি কিছু খেতে দিতে, তাই দাও। এত বেশী কথা বলো কেন?
এই মেয়ে এদিকে আসো, জি কাকা ডাকছেন?হ্যাঁ, তোমার নাম কি?
রিমা, আমার নাম রিমা..কাকা দুই কলস পানি আইনা দিলাম আর এই তিনডা শিঙ্গারা দিলো?
আমার অনেক খিদা লাগছে কাকা। আর দুইডা শিঙ্গারা দিতে কননা...
এই ম্যানেজার, এই দিকে আসো..এই বাচ্চা মেয়েটাকে দিয়া পানি আনাইছো?
ম্যানেজার মাথা নিচে করে জবাব দিলো, জে...
তোমার চাকরি নট করে দিবো আমি।
যাও জলদি ভাত আর মাংস দিয়ে একে খেতে দাও।
জী, আচ্ছা।

রিমার অমন ভাবে খাওয়া লক্ষ্য করলো দোকানের মালিক জুম্মন সাহেব।
তিনি বুঝতেই পারলো মেয়েটা সত্যি, দুই একদিন ধরে কিছুই খাইনি।
খাওয়া শেষে জুম্মন সাহেব জিজ্ঞেস করলো রিমাকে, তোমার বাবা-মা নেই?
না, কাকা। কেন কি করে তারা মারা গেল?
আমি ছোড বেলায় আব্বা মারা গেছে,
আর মা আরেক মাইনসের লগে বিয়া করছে। গ্রামে আমার দাদীর লগে থাকতাম হেয়ও চইলা গেলো।
হুম, বুঝছি তোমার আর কেউ নেই..দেখি আমি কোন ব্যাবস্থা করতে পারি কিনা।
তুমি আশে পাশেই থাইকো। যদি কোন ব্যাবস্থা করতে পারি জানাইয়া দেবো।
আমি এখন বাইরে যাবো। ম্যানেজার কে বলে যাচ্ছি, কিছু খেতে ইচ্ছে করলে এখানে এসে খেয়ে যাইও।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেলো, রাস্তার পাশে ফুটপাথ ধরে চলছে রিমা।
একদল লোক ফুটপাথের এক কোনায় শুয়ে আছে।
নাহ! আর পারছি না, ক্লান্ত শরীর।
একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। ফুটপাথের এক কোনে বসে পড়লো রিমা।
পাশে শুয়ে আছে একটা মা, তার শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
চোখ জুড়ে ঘুম আসছে রিমার। সেই মা আর শিশুটির পাশে আরেকটি শিশুর মত শুয়ে পড়লো রিমা।

২.
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।
ফুটপাতে মানুষের চলাচল বৃদ্ধি পেতেও শুরু করেছে। রিমা ঘুমিয়েই আছে একটা ছোট বাচ্চার মত।
বড়োলোকদের বিলাশ বহুল বাড়িতে নয়, আরাম কোমল দায়ক খাটে নয়, এসির বাতাসে নয়,
রাস্তার পাশে ফুটপাতের এক কোনায় শুয়ে আছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্ত রিমার ঘুম ভাঙ্গেনা।
একটা ফকির হাতে একটা লাঠি আর থালা নিয়ে রাস্তা পার হয়ে এপারে এলো।
রিমার শোবার জায়গাটাতে গিয়ে রিমা কে ডাকা শুরু করলো।
এই ছেমড়ি? ওঠ, এখনো ঘুমাচ্ছিস? ওঠ..
রিমা চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো।
কিরে? এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে আছিস ক্যান? তুই জানিস না এটা আমার জায়গা?
কাকা এইটা তো রাস্তা, এইটা আপ্নের জায়গা হবো ক্যান?
অই ছেমড়ি? শহরে কি নতুন আইছিস?
হ কাকা, নতুন আইছি...
সর..সরে বয়, এইডা আমার ভিক্ষা করার জায়গা..বুঝছচ?
রিমা একটু দূরে সরে গিয়ে বসলো। পাশের লোকটি ভিক্ষা করা শুরু করে দিয়েছে। রিমা সেটা চেয়ে চেয়ে দেখছে।
এক একজন মানুষ পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর কেউ কিছু না কিছু লোকটির থালায় ফেলে যাচ্ছে।
রিমা সেখানেই বসে ছিল চুপ চাপ করে।
মুরব্বি চাচাকে দান করতে করতে এবার রিমার সাম্নেও দুই একজন এক,দুই টাকা করে ফেলতে শুরু করেছে।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে রিমার বেশ কিছু টাকা হয়ে গেলো।
মুরুব্বি চাচা, লোকটি একটা কঠিন দৃষ্টি নিয়ে রিমার দিকে বার বার তাকাচ্ছে।
মনে হচ্ছে সে রিমাকে খেয়ে ফেলবে। তার ব্যাবসায় বিরাট লস হয়ে যাচ্ছে এই মেয়েটির জন্য।
সকালের নাস্তার টাকাটা হয়ে গেছে, রিমা মনে মনে অনেক খুশি হলো।
সকালের খাবার টা তো কিনে খাওয়া যাবে, এতেই সে অনেক খুশি।
বেলা ৯/১০ টার দিকে ফুটপাত ধরে দুই জন লোক এলো।
রিমার পাশের মুরব্বি চাচার কাছে গিয়ে তারা কি যেন কথা বলতেছিল।
কথা বলার এক পর্যায়ে তারা মুরব্বির কাছ থেকে কিছু টাকা নিলো তারপর রিমার দিকে ইশারা করে কি যেন বলল।
এরপর ছেলে দুইটা রিমার কাছে এসে রিমার সব টাকা গুলো কেড়ে নিয়ে চলে গেলো।
রিমা অনেক আকুতি মিনতি করলো কিন্ত তারা কিছুতেই তা শুনলো না।
রিমার দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতে রিমা পাশের মুরব্বির কাছে গেলো।
কাকা, ওরা কারা? ওরা তো আমার সব টাকা নিয়ে গেলো?
ওরা হলো এই এলাকার দায়িত্বে আছে..
মানে? কিসের দায়িত্বে?
আরে, আমরা এখানে ভিক্ষা করিনা? এর ট্যাক্স দেয়া লাগে এদের। ট্যাক্স না দিলে ভিক্ষার "পারমিশন" দেইনা।
প্রতিদিন যা ইঙ্কাম করি তার অর্ধেক ওরাই নিয়ে যায়..
তা আপ্নের তো অর্ধেক নিছে। কিন্ত আমার পুরাটা নিলো ক্যান?
আরে, আমার তো পারমিশন আছে..তর তো কোন পারমিশন নাই, তোরে নতুন দেকছে এইজন্য সব নিয়া গেছে।
এইখানের ভিক্ষা সমিতির হেড হচ্ছে আসলাম ভাই।
তুই আইজকা অনার সাথে দেখা কইরা একটা পারমিশন নিয়া নিস, তাইলেই হইবো।
একবার পারমিশন নিলে পুরাটা নেবেনা অর্ধেক নেবে, আর অর্ধেক তোর কাছেই থাকবে।
আমি তো হের ঠিকানা জানিনা, চাচা..
হোন, অই পূর্বের যে বাস স্ট্যান্ড আছে না,
ওইখানে যাইয়া হের নাম কইলে চিনাই দেবে, অহন যা আমারে জালাইস না।
কাকা..অনেক ক্ষুধা লাগছে ৫ টা টেকা দেবেন? ভিক্ষা কইরাই শোধ দিয়া দিমুনে।
না, পারুমনা তুই আমারে মাফ কর।
আমার সকালের টেকাই অহনো উঠে নাই!
আমার দুই পোলা আর মাইয়া আছে ওদের কি অবস্থা আগে দেহন লাগবে, খাইছে কিনা হেই টেনশনে আছি।
আর তুই আইছো জালাইতে যা ভাগ...
কাকা, আপ্নের পোলা মাইয়ারে তো দেখলাম না..হেরা কি করে?
দুই পোলা একটা রোডের ওইপার আরেকটা পাশের এলাকাই ভিক্ষা করে। ওদের তেমন পইসা হয়না,
পোলাপাইন তো সবাই ভিক্ষা দেইনা।
আর মাইয়া? মাইয়া কি করে?
মাইয়া বাসায় থাকে, রান্না-বান্না করে আমরা বাড়ীতে গেলে রাইন্দা দেই।
আপ্নার বউ নাই? বউ কোই?
মুরব্বির চোখে পানি লক্ষ্য করা গেলো, বউ মইরা গেছে মাইয়াটা হওনের সময়। বড়ই ভালাবাসতাম হেরে।
অহন মা মরা মাইয়াডাও বড় হইছে হেরে বিয়া দেওন লাগবো,
দুই বছর ধইরা টাকা জমাইতাছি ভিক্ষা কইরা কইরা। মাইয়া আমার ম্যাট্রিক পাশ।
টাকার অভাবে পড়াশুনাডা করাইতে পারলাম না।
একটা ভালা পোলার লগে বিয়া দিতে পারলে তো বাইচা জাইতাম।
ভিক্ষা করি তাই বুইলা তো আর ভিখারির লগে মাইয়া দিতাম না।
রিকশা-ভ্যান চালাই এই রকম একখান পোলার লগে বিয়া দিমু।
মা মরা মাইয়া আমার হইছেও অর মার মত। তোরে এত কথা কইয়া কি লাভ? তুই টাকা চাইছিলি না?
এই নে ১০ টাকা রাখ।
না কাকা লাগবো না...
ক্যান একটু আগেও তো ৫ টাকা চাইলি? অহন লাগবো না ক্যান? নে রাখ, ভিক্ষা কইরা শোধ কইরা দিস...
না, কাকা লাগবোনা..আমার এক পরিচিত দোকান আছে হেই আমারে ফ্রি খাইতে দিতে চাইছে।
আচ্ছা না লাগলে নাই। যা তোর লগে পরে কথা কইবুনে, অহন কাস্টোমার মিস দেওয়া যাইবোনা।
আচ্ছা কাকা, আমি যায় কিছু খাইয়া আহি খুব ক্ষুধা লাগছে।
আচ্ছা যা...
রিমা হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা ধরে, জুম্মন সাহেবের হোটেলের দিকে।
বেলা ১১ টা বাজে প্রায়। হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালো রিমা।
ম্যানেজার একটা গম্ভির্য ভাব নিয়ে রিমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কি? আইছস আবার ফ্রি খাবার খাইতা?
হ..খুব ক্ষুধা লাগছে কিছু দেন না, আমার কাছে টাকা হইলে সব শোধ করে দিমুনে।
মালিকে তোরে খাইতে দিতে কইছে বুইলা দিতাছি।
আমি মালিক হইলে তোর হাড় ভাইঙ্গা দিতাম মাইরা মাইরা, শালা ফকিরনির বাচ্চা ফ্রি খাইতে আছস...
রিমা মাথা নিচু করে রইলো। হোটেল বয় একটা প্লেটে খেচুরি ভাত এনে রিমার হাতে তুলে দিল।
প্লেট হাতে নিয়ে রিমা রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে ম্যানেজার বলে উঠলো,
যেখানে আছস ওইখানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া খা, ভেতরে ঢুকে টেবিলে বসে খাওয়ার আশা করে লাভ নাই।
রিমা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। খাওয়া শেষ করে রিমা যখন চলে যাবে, তখন পিছ থেকে ম্যানেজার রিমাকে ডাক দিলো।
এই ছেমড়ি? এইদিকে আয়, কই যাইতাছস?
কি কাকা? ডাকছেন?
হ, ফাও খাইয়া তো চলে যাইতাছস, এক কলস পানি আইনা দিয়া যা।
জী, কাকা। এক কলস পানি আনতে চলে গেলো রিমা। অনেক কষ্টে কোন মতে টানতে টানতে পানির কলস
বয়ে নিয়ে আসলো হোটেলে। কলস রেখে, আবার আগের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো রিমা।
হাতের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে রিমা। হাতে ফোস্কা কেটেছে।
এই ছোট্ট হাতে পানির কলস বহন করা অনেক কষ্ট সাধ্য কাজ। তবু কি করার ওতো পরিস্থিতির শিকার।
বেঁচে থাকতে হলে রিমা কে যে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হবে।

৩.
আজকাল ভিক্ষা করতেও নাকি লাইসেন্স লাগে? তাই ভিক্ষার লাইসেন্স করার জন্য রিমা বাস মালিক সমিতির ইউনিয়ন লিডার আসলাম ভাইয়ের কাছে গেলো। ভেতরে কি যেনো একটা মিটিং চলছে, রিমা অফিস রুমের বাইরে দাড়িয়ে আছে। কিছুক্ষন পর একটা লোক বাইরে বের হলো। রিমা লোকটাকে বেরিয়ে আসতে দেখে তার কাছে গেলো,
কাকা, আফনের নাম কি আসলাম ভাই?
ধুর ছেমড়ি কইত্তা আইছোত, আসলাম ভাইরে চিনোস না? আমি আসলাম ভাই হমু কিল্লায়? আসলাম ভাই মিটিংয়ে আছে।
কাকা, ওনার লগে একটু দেখা করন যাইবো? আমার একখান দরকার আছিলো,
না এখন দেখা করা যাবেনা, ১ ঘণ্টা বইয়া থাক, মিটিং শেষ হইলে যাইস।
আচ্ছা কাকা। রিমা অফিসের বাইরে প্রায় ১ ঘণ্টার বেশী বসে আছে। এক একজন লোক বের হলে তার কাছে যেয়ে বলছে, আসলাম ভাইয়ের সাথে দেখা করার কথা। প্রায় দুই ঘণ্টা পর সব মানুষ জন যখন বেরিয়ে গেলো তখন রিমা অফিস রুমের ভেতরে ঢুকলো। সামনে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে আছে বিশাল দেহীর একজন লোক। তার ডান পাশে একজন সহকর্মী দাঁড়ানো। পাশের লোকটি একটা বক্স খুলে তার থেকে একটা পান বের করে আসলাম ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলো।
আসলাম ভাই, হাতে পান নিয়ে গালে পুরে দিয়ে সামনে রিমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
অই ছেরি, তোর নাম কি?
কাকা, আমার নাম রিমা।
কি চাস?
কাকা, আমার একখান লাইসেন লাগবো। ভিক্ষার লাইসেন...
ও তর লাইসেন্স লাগবো?
হ' কাকা।
তা টাকা আনছোস? ১০০ টাকা লাগবে..
কাকা, আমার কাছে তো কোন টেকা নাই, আফনেরে ভিক্ষা কইরা শোধ কইরা দিমুনে।
না না এম্নে হবেনা, আগে একশ' টাকা লইয়া তয় এইহানে আয়, তারপর দেখা যাবে।
কাকা, বিশ্বাস করেন আমার কাছে কোন টেকা নাই। আফনেরে আমি শোধ দিয়া দিমু, দেন না কাকা...
আসলাম ভাই, পাশের সহকর্মীর মুখের দিকে তাকালো, কি দিমু?
সহকর্মী হেঁসে দিয়ে বলল, দেন পোলাপাইন মানুষ, টেকা পাইবো কোই? অই তাইলে একটা শর্ত আছে, প্রথম দিন যে টাকা উঠবে সব আসলাম ভাইরে দিয়া যাবি। পারবি তো?
হ, কাকা... পারমু।
আসলাম ভাই ড্রয়ার থেকে একটা কার্ড বের করে রিমার দিকে চেলে দিয়ে বলল,
এইটা সঙ্গে রাখবি সব সময়, এইটা তর লাইসেন্স। বুঝলি?
হ, কাকা বুঝছি,
যা এখন যা, সন্ধার দিকে এসে টাকা দিয়ে যাবি।
রিমা পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে তার আগের ঠিকানায়, এখন থেকে ভিক্ষা করা শুরু করতে হবে। মুরব্বি আগের জায়গাতেই বসে আছে। তার মত সে ভিক্ষা করে যাচ্ছে। রিমা কে দেখত পেয়ে মুরব্বি জিজ্ঞেস করলো,
কি গেছিলি, আসমান ভাইয়ের কাছে?
হ' চাচা গেছিলাম। এইযে কার্ড দিছে, এইটা সঙ্গে রাখতে কইছে।
হুম, ওইটা কাছে রাখিস, হারায় না যেনো। রাত আঁটটা পর্যন্ত ভিক্ষা করলো রিমা। তার আগে সন্ধ্যার দিকে আসলাম ভাইয়ের লোক এসে, বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যা উঠেছিলো সব নিয়ে গেছে রিমার কাছ থেকে। আবার ১০ টার দিকে গিয়ে টাকা দিয়ে আসতে বলেছে। প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে রিমার, আবার সেই হোটেলে যেতে হবে খাওয়ার জন্য। আজকের যা উঠেছে, সেখান থেকে একটা টাকাও খরচ করা যাবেনা। রিমা ভেবেছিলো আর ফ্রি খাবেনা, টাকা দিয়েই খাবে। কিন্ত কিছু করার নাই, বাকিই খাওয়া লাগবে। হোটেলের মালিকের ব্যাবহার ভালো কিন্ত ম্যানেজার লোকটা সুবিধার না। তার কথা শুনতেও আর ভালো লাগেনা রিমার।
তাই আর ফ্রি নয়, আজকের পর থেকে। রাতের খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্যে রিমা হোটেলের দিকে রওনা হলো। আজকে হোটেলে মালিক আছে, কোন সমস্যা হবেনা রিমার। জব্বার সাহেবকে দেখে মনে মনে খুশি হলো রিমা।
রিমাকে দেখতে পেয়ে হোটেল মালিক জব্বার সাহেব রিমাকে ডাক দিলো,
এই মেয়ে, এদিকে আসো...
রিমা হোটেলের ভেতরে ঢুকলো, কি কাকা, ডাকছেন আমারে?
হ্যা, তোমারে ডেকেছি। তোমার জন্য একটা ব্যাবস্থা করে ফেললাম। তুমি কি কাজ কাম করতে পারবা?
কি কাম কাকা?
আমার বোনের বাড়িতে একটা কাজের লোক লাগবে, তুমি কি ঘর মোছা, পানি আনা, জামা-কাপড় ধোয়া এসব কাজ করতে পারবে?
হুম, পারবো।
তাইলে সমস্যা নাই, সকাল ১০ টার দিকে তুমি এখানে আসো, আমি তোমাকে নিয়ে আমার বোনের বাড়িতে দিয়ে আসবো। ওখানে অনেক আরাম পাবা। থাকা, খাওয়া, নতুন জামা কাপড়, টিভি দেখা, এমনকি মাঝে মাঝে কিছু টাকা কড়িও পাইবা। এখন তুমি কি রাজী আছো?
হ' কাকা, আমি রাজী। আমি সকালেই চইলা আসবো।
আচ্ছা তাইলে এখন খাওয়া, দাওয়া করে যাও। সকাল সকাল চইলা আইসো। রিমা রাতের খাবার খেয়ে, মনের সুখে হাঁটতে হাঁটতে তার গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে মুরব্বি চাচারে দেখতে পেয়ে খুশিতে তার কাছে যেয়ে সব খুলে বলল রিমা। এসব শুনে মুরব্বিও অনেক খুশি হলো।
খুবই ভালা সংবাদ দিছস, যা "আল্লায়" যেনো তরে অনেক সুখে রাখে। রাত ১০ টার কিছু আগে গিয়ে আসলাম ভাইয়ের কাছে বাকি টাকা গুলো দিয়ে আসলো রিমা। মনে অনেক শান্তি। যাক একটু খুশির সংবাদ তাহলে পাইছি। মনের আনন্দ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো রিমা।

খুব সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো রিমার। অপেক্ষা করছে কখন ১০ টা বাজবে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর, দশটার কিছু আগে হোটেলের সামনে এসে উপস্থিত হলো রিমা।

জব্বার সাহেব রিমাকে নিয়ে তাঁর বোনের বাড়িতে দিয়ে আসলো। কাজের মেয়ে পেয়ে তাঁর বোন নিতান্তই খুশি। আজকাল কাজের লোকের বড় অভাব! খুজেই পাওয়া যাইনা!

কিছুদিন পর...

সকাল, দুপুর, রাত কাজ করতে করতে ছোট্ট মেয়েটা হাপিয়ে উঠেছে। আর পেরে উঠছেনা কিছুতেই। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। ছেলে, মেয়ে, স্বামীর সেবা যত্ন তাদের কাপড়, চোপড় ধুতে ধুতে বড় ক্লান্ত আজ রিমা! ওর বয়সী বাড়িতে দুটি ছেলে-মেয়ে প্রতিদিন স্কুলে যায় আর ও কাজের পরে কাজ করতে থাকে। আর যে পারছেনা রিমা!
জব্বার কাকা বলেছিল একটু আরাম করা যাবে, কিছু টাকা পাওয়া যাবে, ভালো ভালো জামা কাপড় পাওয়া যাবে! কোই? এসব কিছুই তো পাচ্ছেনা রিমা। আর বুঝি এই কষ্টের জীবনে থাকতে পারবোনা! এবার যে আমার মুক্তির দরকার। খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত হাওয়া খাওয়ার দরকার। এখানে আর থাকবোনা! এর থেকে "চাচার" পাশে বসে ভিক্ষা করলেও আরামে থাকতে পারবো! দু মুঠো ভাত নিজের ইচ্ছে মত খেতে পারবো। কেউ বলবেনা সব কাজ শেষ না করে খাওয়া চলবেনা!
আমি চলে যাবো। আমি স্বাধীন হবো। সব বাঁধা থেকে মুক্ত হবো।





(এটা শুধু একটা গল্প হলেও পারতো, তবে এটা গল্প নয়। এই রিমার মতো হাজারো রিমা আজও রাস্তায় কিংবা ফুটপাতের পাশে ওদের জীবন অতিবাহিত করে যাচ্ছে। হাজারো রিমারা এই শীতের মধ্যেও কোন স্টেশনের বারান্দায় বা খোলা আকাশের নিচে বস্ত্রহীন অবস্থায় শুয়ে আছে। কেউ নেই ওদেরকে দেখার জন্য। কেউ আসেনা সাহায্যের হাত বাড়াতে। ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে, ১ বেলা খাবার অথবা ২ টা টাকার জন্য! কিন্ত মানুষ নামের কিছু হায়েনারা তাদেরকে ফিরিয়ে দিচ্ছে বারবার। খাবারের পরিবর্তে ভাগ্যে জুটছে কিছু অশ্রব্য ভাষার গালাগাল। সমাজের বিত্ত শালীদের পকেটে ভুরি ভুরি টাকা আছে, কিন্ত রিমাদের মত অনাথ, অসহায় বাচ্চাদেরকে একবেলা খাবার খাওয়ানোর মত চিন্তাধারা, সময় কিংবা কোন ধরনের সদিচ্ছা তাদের নেই। আমাদের সমাজে শুধু গরীবেরাই গরীবদের দুঃখ, কষ্ট বোঝে। বড়লোকেরা বোঝেনা! কি হবে এই রিমার ভবিষ্যৎ? কি হবে এই অনাথ, অসহায় রিমার মত আরও হাজারটা বাচ্চার ভবিষ্যৎ? ওদের জীবন কি রাস্তা, ফুটপাত আর মানুষের লাথি, গুতার মধ্যে দিয়েই শেষ হয়ে যাবে? প্রশ্ন আপনাদের কাছে। এর সমাধান বের করবেনও আপ্নারাই। এর জন্য কি আমরা নিজেরাই দায়ী নয়?



৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪

বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×