somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবাসন-নির্বাসন

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৫:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এইতো কিছুদিন আগেও আমি আম্মুর গলা জড়িয়ে ঘুমোতাম । একই কম্বলের উষ্ণতা ভাগাভাগি করে নিতাম আম্মু আর আমি । আম্মু আমার অগোছালো লম্বা চুলগুলো গোছানোর ভান করে এলোমেলো করে দিত । আমি গল্প শোনার বায়না করতাম । প্রথম প্রথম আম্মু রূপকথা বলতো । সেই রূপকথায় রাজপুত্র থাকতো । যে রাজপুত্র শুভ্র ঘোড়ার পিঠে চেপে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে আসে দৈত্যদের হাত থেকে । আমি তখন চুপিচুপি নিজেকে রাজকন্যা ভাবতাম আর ঠোঁট টিপে হাসতাম । একটু বড় হওয়ার পর গল্পগুলো বদলে গেলো । গল্পে জায়গা করে নিলো সুফিয়া কামাল, কুসুম কুমারী দাস এবং বেগম রোকেয়ার মতো মহীয়সী নারীরা । আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম । মনে মনে ভাবতাম একদিন আমিও বেগম রোকেয়ার মতো হবো । নিচু গলায় আম্মুকে বলতাম "আম্মু , আজকে থেকে আমার নাম বেগম রোকেয়া । তুমি আজকে থেকে আমাকে এই নামে ডাকবে ।"
আম্মু ঠোঁট টিপে হাসতো শুধু ।

***

আমার নাম প্রাপ্তি । আমি গতবার পিএসসি দিয়েছি । এখন ক্যাডেট কোচিং করছি । গত ডিসেম্বরে আমার তেরো বছর পূর্ণ হয়েছে । এ বছর চৌদ্দতে পা দিয়েছি । কেউ বয়স জিজ্ঞেস করলে আমি অস্বস্তিতে পড়ে যাই । চৌদ্দ বলবো নাকি তেরো বলবো !
যেদিন আব্বু আম্মু আমাকে কোচিং এ ভর্তি করাতে নিয়ে এলো সেদিন আমি অনেক খুশী ছিলাম । ঠিক কি কারণে খুশী ছিলাম সেটা এখনো চিন্তা করে বের করতে পারিনি । যাই হোক, প্রথমদিন কোচিং এর এক স্যার গাল টিপে জিজ্ঞেস করেছিলো, "মামণি তোমার বয়স কতো ?"
আমি অনেকক্ষন চুপ থেকে বলেছিলাম, "তের বছর তিন মাস নয় দিন ।" স্যার সেদিন কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে ।তারপর কাগজে কি কি সব লিখে আমাকে ভর্তি করিয়ে নিলেন কোচিংয়ে ।

কোচিং করতে এসেছিলাম আনন্দ নিয়ে । তখনও জানতাম না সবাইকে ছেড়ে একা একা আমাকে এখানে থাকতে হবে । কোচিং করার জন্য আবার আব্বু আম্মুকে ছেড়ে থাকতে হয় নাকি ?সবার সাথে থেকে কি কোচিং করা যায় না ? পরে শুনেছি ক্যাডেটে নাকি নিয়ম শৃঙ্খলাকে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয় । তাই ক্যাডেটে পড়তে হলে আমাকে নিয়ম মাফিক চলার অভ্যাস করতে হবে । সে জন্যই কোচিং এর তত্বাবধানে একটা বোর্ডিং এ রাখা হয়েছে আমাকে ।

একটা মাঝারি সাইজের ঘরে মোট ছয়টা বিছানা । আমি, নীলা, ঐশী, ঐন্দ্রিলা, স্নেহা আর অর্পিতা আমরা ছয়জন সেই ঘরে থাকি । ঘরের একদম এক কোনায় আমার বিছানা । আমার বিছানার সাথেই লাগোয়া বাথরুম । আমাদের ছয় জনের জন্য বরাদ্দ সেটা । প্রতি শুক্রবার আমরা পালা করে ময়লা কাপড় ধুয়ে দেই ।

প্রথমদিন রাতে যখন আমি ঘুমোতে আসি তখন বিছানাটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো । হাত বাড়িয়ে আম্মুর গলা জড়িয়ে ধরতে গিয়ে স্বপ্ন ভাঙে । স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কষ্টে আমার চোখ ভারী হয়ে আসে । ভেতরে কালবৈশাখি শুরু হয়ে যায় । আমি বালিশে মুখ গুঁজে ঝড় থামানোর চেষ্টা করি । ঝড় কমে না, বরং বৃষ্টিতে বালিশ ভিজে যায় । ভেজা বালিশে মাথা রেখে আমি বুঝতে পারি এখানে আমি একা । একদম একা । ওদিকে আমার চিরপরিচিত বিছানায় আমার গল্পবলা আম্মুও একা । সেই একা আম্মুও হয়তো ঝড় থামাতে গিয়ে বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে । হয়তো আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করছে বারবার, ঠিক যেভাবে আমি নিঃশব্দে তাকে ডাকছি । ঝড়ের গতি বেড়ে যেতে গিয়েও হঠাত্‍ একদম থেমে যায় একটা হাতের স্পর্শে । আমি কেঁপে উঠি । আম্মু এসেছে ভেবে চকিতে উঠে বসি । চোখ মুছে তাকাই । দেখি নীলা উঠে এসেছে আমার বিছানায় । ভালো করে তাকিয়ে দেখি ওর চোখদুটোও ভেজা । নীলা ওর ভেজা চোখ হাতের উল্টোপিঠে মুছে নেয় । হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে,

-"কাঁদছো কেন ? এখনও কি ছোট্টটি আছো নাকি ?"

আমিও নীলার মতো চোখ মুছে ফেলি । পাল্টা জিজ্ঞেস করি

-"তুমি কাঁদছিলে কেন ?তুমি কি বড় হও নি ?"

ঠিক সেই মুহুর্ত থেকে আমরা বড় হয়ে গেলাম । এক এক করে বাকী ছয়জনের চোখ থেকে কষ্টের ছাপ মুছে গেলো । আমরা ঐ মাঝারি সাইজের ঘরেই একটা ছোট্ট পৃথিবী তৈরী করে নিলাম । সে পৃথিবীতে কান্নার প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়া হলো । আমরা অভিনয় শিখে গেলাম ।

***

এক সপ্তাহ পর আব্বু আম্মু আর বড়ভাইয়া এলো । দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়েই আম্মু দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো । কাঁদতে লাগলো অঝড় ধারায় । আমি ততদিনে পাকা অভিনেত্রীর মতো কান্না লুকোনো শিখে গেছি । হাসতে হাসতে বললাম, "ও কি ! কাঁদছো কেন ? রাতে একলা থেকে ভয় পেয়েছো বুঝি !"
আম্মু কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে । তারপর আবার জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো । হঠাত্‍ করে আমার কি যেন হলো ! বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেলো , গলার কাছে কি যেন একটা এসে আটকে গেলো । আমি
ঠোঁট কামড়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম । চোখ তুলে আব্বুর দিকে তাকালাম আব্বুর দিকে । চোখ দুটো আব্বুর কোটরে ঢুকে গেছে । আমার দিকে ঠিকমতো তাকাচ্ছেই না । বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে । স্পষ্ট বুঝতে পারলাম সেটা অশ্রু লুকানোর চেষ্টা মাত্র ।
বড়ভাইয়া বহুকষ্টে মুচকি হাসি ধরে রেখে এগিয়ে আসলো । মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
"কি রে বুড়ি! কষ্ট হচ্ছে নাকি আমাদের ছেড়ে থাকতে ?"
একমুহুর্ত আমার ইচ্ছা করলো চিত্‍কার করে বলি "হ্যাঁ ভাইয়া খুব কষ্ট হচ্ছে ! খুব খুব খুব কষ্ট হচ্ছে । মনে হচ্ছে আমাকে যেন নির্বাসন দেয়া হয়েছে কিংবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড !"
খুব সাবধানে বেপরোয়া ইচ্ছাটাকে দমন করলাম । তারপর বিকট হাসি দিয়ে বললাম "দেখাই তো যাচ্ছে কার কষ্ট হচ্ছে ! হিহিহি"

সেদিন আব্বু আম্মু অনেক কান্নাকাটি করলেন । ফিরে যাবার সময় হাসিমুখে গেলেন । যাবার আগে ভাইয়া হাতে এত্তগুলা গল্পের বই ধরিয়ে দিয়ে গেলো । আমি বই হাতে নিয়ে এমন ভাব করলাম যেন এমন খুশী আমার জীবনেও হয়নি । আমার খুশী দেখে ভাইয়া খুশী হলো । কিন্তু ভাইয়া জানে না এখানে গল্পের বই পড়তে দেয়া হয় না । এখানে শুধু পাঠ্যবই পড়তে হয় রাতদিন একাকার করে ।
আম্মু খুব সুন্দর একটা ফ্রগ দিলো যেটা আমি মিনিট পাঁচেক গালে ঠেকিয়ে রেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলাম । আর সবশেষে আব্বু দিলো একটা টেডিবিয়ার আর কিছু পকেটমানি । টেডিবিয়ারটা কোলে নিয়ে আব্বুকে একশো একটা থ্যাংকস দিলাম ।

আব্বু, আম্মু, খুশী মনে ফিরে গেলো । তাদের মেয়ে আনন্দে আছে । ভালো আছে ।

আমি অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকলাম তাদের ফিরে যাওয়া পথের দিকে । হাসি হাসি মুখে হাত নাড়ছিলাম ধীরে ধীরে আমার কানদুটো অবশ হয়ে আসতে লাগলো । চারদিক নিঃশব্দে ভরে গেলো । করিডোর পেরিয়ে আমার রুমে পৌঁছতে মনে হলো একযুগ পেরিয়ে গেছে ।

সে রাতে আমি মনখুলে কাঁদলাম, প্রাণভরে কাঁদলাম । বালিশ ভিজে গেলো, ভিজে গেলো আমার মতো পাঁচজনের কাঁধ । ওরা ফুলে ফেপে ওঠা সমুদ্রে সান্ত্বনার বাঁধ দেয়ার চেষ্টা করলো বৃথাই । ওরা এখনো জানে না যে সমুদ্রে বাঁধ দেয়া যায় না ।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মাটির কাছে যেতেই..

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

মাটির কাছে
যেতেই..


ছবি কৃতজ্ঞতাঃ https://pixabay.com/

ঠিক যেন
খা খা রোদ্দুর চারদিকে
চৈত্রের দাবদাহ দাবানলে
জ্বলে জ্বলে অঙ্গার ছাই ভস্ম
গোটা প্রান্তর
বন্ধ স্তব্ধ
পাখিদের আনাগোনাও

স্বপ্নবোনা মন আজ
উদাস মরুভূমি
মরা নদীর মত
স্রোতহীন নিস্তেজ-
আজ আর স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাকা ভাংতি করার মেশিন দরকার

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:১০

চলুন আজকে একটা সমস্যার কথা বলি৷ একটা সময় মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল৷ চাইলেই টাকা ভাংতি পাওয়া যেতো৷ এখন কেউ টাকা ভাংতি দিতে চায়না৷ কারো হাতে অনেক খুচরা টাকা দেখছেন৷ তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেলা ব‌য়ে যায়

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩০


সূর্যটা বল‌ছে সকাল
অথছ আমার সন্ধ্যা
টের পেলামনা ক‌বে কখন
ফু‌টে‌ছে রজনীগন্ধ্যা।

বাতা‌সে ক‌বে মি‌লি‌য়ে গে‌ছে
গোলাপ গোলাপ গন্ধ
ছু‌টে‌ছি কেবল ছু‌টে‌ছি কোথায়?
পথ হা‌রি‌য়ে অন্ধ।

সূর্যটা কাল উঠ‌বে আবার
আবা‌রো হ‌বে সকাল
পাকা চু‌ল ধবল সকলি
দেখ‌ছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পর্ণআসক্ত সেকুলার ঢাবি অধ্যাপকের কি আর হিজাব পছন্দ হবে!

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৩ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:২৭



ইন্দোনেশিয়ায় জাকার্তায় অনুষ্ঠিত একটা প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছে বাংলাদেশি নারীদের একটা রোবোটিক্স টিম। এই খবর শেয়ার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা। সেখানে কমেন্ট করে বসেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ২৩ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:১৪


কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়
আমার বাবা-কাকারা সর্বমোট সাত ভাই, আর ফুফু দুইজন। সবমিলিয়ে নয়জন। একজন নাকি জন্মের পর মারা গিয়েছেন। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আমার পিতামহ কামেল লোক ছিলেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×