somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প - “গাতক সুরুজ”

০১ লা মার্চ, ২০১৪ রাত ১২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“গাতক সুরুজ”
“মসজিদ কোথায় বানাইবা বললা?” -দোতালা বাসের দ্বিতীয়তলার জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে লোকটা চিৎকার করে।

সুরুজ মিয়া বিরক্ত হয় ।

প্রথমত, লোকটা এই নিয়ে চতুর্থবারের মত একই প্রশ্ন করছে। একই প্রশ্ন বার বার করলে তার উত্তর ভিন্ন হয় না। তবুও সুরুজ জবাব দিচ্ছে। লোকটা ডাবল ডেকার বাসের দ্বিতীয় তলায় বসে থাকার কারণে চিৎকার করে জবাব দিতে দিতে গলা ধরে এসেছে সুরুজের।
দ্বিতীয়ত , লোকটা তাকে তুমি তুমি করে কথা বলছে । সুরুজ দাড়ি – টুপি – পাঞ্জাবী পরিহিত মানুষ । শরীর থেকে ভুর ভুর করে ছড়াচ্ছে “ গুলে লালা” -আতরের সুবাস। ধর্মীয় পোশাক আর আতরের তীব্র ঘ্রাণের যৌথ প্রভাবে আজকাল মানুষ তাকে দেখা হলেই একটা সেলাম দেয়। এমনকি দাঁড়ির কিছু অংশে পাক-ও ধরেছে তার। কিন্তু এই বেয়াড়া লোকটা, যার গলা শুনে চ্যাংড়া ছেলেপেলে-ই মনে হচ্ছে , সে সুরুজ মিয়াকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়ার ধারও ধারছে না!

শেষ বিকেলের ধূলিধূসর ক্লান্ত হাওয়া সুরুজ মিয়াকে ছুঁয়ে যায়। তার আর চিৎকার করতে ভালো লাগে না।

কিন্তু সামনের চাঁদার পয়সা রাখার ছোট্ট টেবিলে পড়ে থাকা অল্প কিছু টাকা সুরুজকে স্মরণ করিয়ে দেয় , আজকে টাকা উঠেছে খুবই কম। ভাব দেখানোর সময় অথবা সুযোগ- কোনটাই নেই।

“ মসজিদ বানামু মুতসুদ্দিপুর” – আবারো চিৎকার করে জবাব দেয় সুরুজ।
“ মুতসুদ্দিপুর কই আবার ?” লোকটার পাল্টা প্রশ্ন ।

এইবার রাগে সুরুজের গা রি রি করে উঠলো! মুতসুদ্দিপুর কই , এটা জেনে সে কি করবে? দান করবে আল্লাহপাকের নামে । সওয়াব যা পাওয়ার তা সাথে সাথে পেয়ে যাবে। মসজিদ কি মুতসুদ্দিপুর হবে না জেদ্দায় হবে না কুয়ালালামপুর হবে – তা জেনে এর লাভ কি? অথবা দরকারটাই বা কি?

এই বয়সে রাগ বেশী হওয়াটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। প্রেশার বেড়ে গিয়ে দফারফা হতে পারে। মনোযোগ সরিয়ে নিতে সুরুজ পাশের চা- বিড়ির দোকানে তাকায়। পান খাওয়া দরকার একটা।

দোকানীর দিকে তাকিয়ে সুরুজের মেজাজ গেলো আরও খিচড়ে। ব্যাটা দাঁত কেলিয়ে হাসছে! বোঝাই যায়- সুরুজের অপদস্থ হওয়াটা বেশ উপভোগ করছে সে। থার্ডপার্টি হবার এই এক সুবিধা- আপন মনেই গজরায় সুরুজ।

এরি মাঝে বাসের উপর থেকে লোকটা আবার চিৎকার করে-
“ যেইখানেই বানাও , বানাইও কিন্তু । মসজিদের নামে টাকা উঠাইয়া মাইরা খাইও না ।”

এবার সুরুজের ধৈর্যের বাঁধ পুরোপুরি ভেঙ্গে যায় । দাঁত মুখ খিঁচিয়ে একটা তীক্ষ্ণ জবাব দেবে এমন সময় দেখে লোকটা দোতালা থেকে একটা নোট ছুঁড়ে মেরেছে । আহা , টাকা ! কচকচে একটা নোটের এমনি ক্ষমতা যে এ সবকিছুর মুখ বন্ধ করে দিতে পারে । সুরুজের হেল্পিং হ্যান্ড ও একমাত্র সন্তান করিমুল্লা দৌড়ে গিয়ে টাকাটা কুড়িয়ে আনে। রাস্তার সিগনেল ছেড়ে দেয়। একরাশ ধুলা উড়িয়ে সব বাস – সিএনজি – মাইক্রোগুলো প্রায় উড়ে চলার গতিতে এগোতে থাকে ।

টাকা হাতে আসার পর নতুন করে সুরুজকে বিরক্তি গ্রাস করে । পাঁচটাকার একটা নোট, তাও আবার মধ্যে ছেড়া ! মানুষজনের বিবেক বলে আজকাল আর কিছু নেই। দিবি তো মাত্র পাঁচ টাকাই , তাহলে কাকে দিবি কেন দিবি এত ঠিকুজী-কুলুজী উদ্ধার করার ইচ্ছা কেন?

সুরুজ পকেট থেকে বড় নোটগুলো বের করে সন্তঃপর্ণে গোনা শুরু করে ।
সুরুজ সাবধানে পুরো টাকা দুইবার গোনার পর সুরুজের কুঞ্চিত কপালের ভাঁজের সংখ্যা আরও কিছু বাড়ে। একশ তিয়াত্তর টাকা পঞ্চাশ পয়সা মাত্র! মানুষের মনে ধর্ম কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি উঠে গেছে আজকাল- ভাবে সে । এইত সেদিন, মাত্র দশ বছর আগেও প্রায় প্রতিদিন গড়ে তিন-চারশো টাকা উঠে আসতো বাঁধা নিয়মে। কিন্তু এখন এই দুর্মূল্যের বাজারে এসে প্রতিদিন টাকা ওঠে গড়ে দু’শ টাকা !

সুরুজ দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে টাকাগুলি ঝোলায় ভরে । সামনে পেতে রাখা টেবিলের ওপরের চাদরটা সযত্নে ভাঁজ করে । টাকার পিছু পিছু চাদরটাও ঝোলায় প্রবেশ করে। ছোট্ট টেবিল , আর টুলটা সে সামনের পান সিগারেটের দোকানে প্রতিদিনের মত জমা রাখে। টুল – টেবিল জমা রাখার ভাড়া হিসেবে দোকানীর হিসসা দশ টাকা বুঝিয়ে দেয় । তারপর বড় শরিফ ছাতাটা ভাঁজ করে বগলের নীচে নিয়ে ডাক দেয় –

“ করিমুল্লা , বাবা এই দিকে আসো”

সুরুজের ছেলে করিমুল্লা বড় বড় চোখে সিনেমার পোস্টার দেখছিল। সিনেমার নাম “নিষ্পাপ মুন্না”। নায়ককে করিমুল্লা চেনে। তার প্রিয় হিরো আকিব খান।

করিমুল্লা অল্প অল্প পড়তে শিখেছে , কিন্তু সব শব্দের অর্থ সে এখনও বোঝে না। যেমন, নিষ্পাপ শব্দের অর্থ সে ভালো একটা বুঝতে পারছে না। নায়ক নায়িকাকে খুব কায়দা করে জাপটে ধরে হাসি দিচ্ছে। তাহলে যে তার প্রিয় হিরোর মত করে নায়িকাকে জাপটে ধরে হাসি দিতে পারবে সেই বোধহয় নিষ্পাপ । তবে তো করিমুল্লা এখনও নিষ্পাপ হতে পারবে না ! তার যে বিয়ে-ই হয় নি !

সুরুজ মিয়ার ডাক শুনে দৌড়ে গিয়ে করিমুল্লা হাত ধরতেই সুরুজ হাঁটা শুরু করে। গন্তব্য দয়াগঞ্জের মোড় হতে গেণ্ডারিয়া রেলস্টেশন । ঐখানেই করিমুল্লা , আর করিমুল্লার মা হাসনা বেগমকে নিয়ে সুরুজের আবাস ।

পথিমধ্যে প্রত্যেকদিনের পরিচিত যে অন্ধ ফকির রাস্তার বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকে তার দিকে ইশারা করে সুরুজ তার ছেলেকে বলে-
“ বাবা, হাতে টাকা পয়সা থাকলেই মানুষরে দান খয়রাত করবা। আল্লাহপাক দানশীল মানুষদের বড়ই মহব্বত করেন । এই জইন্যে হাদিস শরীফে আসছে যে তুমি জাহেল হও সমস্যা নাই, কিন্তু হে আল্লার বান্দা, তুমি দানখয়রাত কইরো! তাইলে তোমার মর্তবা কৃপণ আবেদের থেকে বেশী হইব।” ।

এই কথা বলে সুরুজ ভিক্ষুকটার দিকে পঞ্চাশ পয়সা ছুঁড়ে দেয়। সুরুজের মুখে ভিক্ষা দানের প্রশান্ত হাসি তার ছেলের চোখ এড়ায় না।

করিমুল্লা পিছনে তাকিয়ে দেখে অন্ধ ফকির পঞ্চাশ পয়সার মুদ্রা নেড়েচেড়ে দেখে শক্ত মুখে বিরবির করে কি যেন বলছে । করিমুল্লা জানে ফকির আসলে তার বাবাকে কঠিন কিছু গালি দিচ্ছে । তার বাবা দান খয়রাতের ব্যাপারে নানা ভালো কথা বললেও কোনদিনও পঞ্চাশ পয়সার বেশী ফকিরটাকে দেয় না । পঞ্চাশ পয়সায় পেয়ে ফকির বিরক্ত হয়ে তার বাবাকে গালি দেয় । একদিন কাছে গিয়ে করিমুল্লা শুনেছে সে গালি । শুনে দৌড়ে পালিয়েছে । অন্ধ একটা মানুষের মুখ এত খারাপ হয় কি করে ?

“ কি বলছি বুচ্ছ নি ?” – সুরুজ মিয়া জোর গলায় বলে ওঠে ।
“ বুচ্ছি আব্বা” ।
“ আর বাবা মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবা । হাদিসে আসে , বাবা – মায়ের পায়ের তলায় সন্তানের বেহেস্ত।”
“ কিন্তু আব্বা , আম্মা যে ঐদিন কইল খালি মায়েদের পায়ের নীচেই সন্তানের বেহেস্ত ?”

সুরুজ কিছুটা দ্বিধাদন্ধে পড়ে যায় । চিন্তা করে বলে –
“ আইচ্ছা, বাড়ি গিয়া কেতাব দেইখা সিউর হবো নে।”

যখন সুরুজ তার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে সূর্য পশ্চিম আকাশে হাল্কা লাল আভা ছড়িয়ে তার শেষ উপস্থিতিটুকু জানান দিচ্ছে । সুরুজদের সামনের ঘরে মুনিয়া আর সোনিয়া দুইবোন ঠোঁটে গাড় লাল লিপিস্টিক আর মুখে সস্তা পাউডার লাগিয়ে সেজে গুজে দাঁড়ানো । আঁধার নেমে আসা মাত্রই তারা তাদের নামবিহীন কাজ করে জীবিকা উপার্জনের উদ্দেশ্যে মিশে যাবে অন্ধকারে।

গরিব মানুষদের চালায় যখন আঁধার নামে , তখন ঝুপ করে নামে। একসাথে এত পরিমানে নামে যে সেদিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। আধারেরও চোখ ঝলসে দেয়ার ক্ষমতা আছে, আলোর চাইতেও সে ঝলসানো আরও তীব্র, আরও ভয়াবহ!

মুনিয়া ( অথবা সোনিয়া) করিমুল্লার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়। সুরুজ মিয়ার সেই হাসি দেখে বুকে সিরসিরে একটা ভীতিভাবের সঞ্চার হয় । সে শিউরে উঠে ছেলেকে টেনে তার আড়ালে নিয়া আসে।

প্রতিদিন বস্তিতে এসে বাড়িতে ঢুকার আগে সুরুজকে ছোট একটা নাটক করতে হয়। বস্তির কাছাকাছি এসেই সুরুজ দ্রুত মাথার টুপি খোলে। চোখে কিছু সুরমা লাগায় । ঝোলা থেকে গেরুয়া রঙের কাপড়খানি বের করে কাঁধে চাপায়। তারপর ঝোলা থেকে রংচটা, ভাঙ্গা একটা দোতারা বের করে হাতে নিয়ে নিজ বাড়ির দরজার কড়া নাড়ে । দরজার পাশের জানালা খুলে গেলে সুরুজ জানালার কাছে যায় ।

জানালা দিয়ে ভেতরে তাকালে কুপিবাতির টিমটিমে আলোয় অন্ধকার ঘরকে আরও বিকট- দমবন্ধ করা লাগে। করিমুল্লার মা, হাসনা বেগমের বিছানা ঘরের একদম জানালা ঘেঁসে । বিছানায় শুয়ে শুয়েই সেখান থেকে সে হাত বাড়িয়ে দরজার চাবি এগিয়ে দেয়। সুরুজ মিয়া দরজার তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করে।

“ আইজ তারাতারি আইয়া পরলা যে?” – ঘরে ঢুকতেই হাসনা বেগমের প্রশ্ন ।
“ বায়না শেষ হইয়া হেসে তরাতরি , কি করব এখন ? বায়নাদারগো লগে গফসফ- মৌজমস্তি করব?”

“ আহা রাগ করো ক্যান?” লম্বা শ্বাস নেন হাসনা বেগম, “ সেইদিন আর রইসে কই? আগে মানুষ বয়াতিগো কত সম্মান করত , কত আদর যত্ন কইরা কথা কইত। এখন তো সবাই বোধয় গানের পালা শেষ হইবার সাথে সাথেই ট্যাকাপয়সা দিয়া বিদায় কইরা দেয়, তাই না? ”

সুরুজ মিয়া প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তার পাঞ্জাবী খুলে আলনায় টানিয়ে রাখে। এদিকে হাসনা বেগমের গল্প শেষ হয়না। রোজ সকালে সূর্য যখন উঠি উঠি করে, তখন তার স্বামী বাসা থেকে বের হয়ে যায়। ফেরত আসে সূর্য ডোবার পর । তারপর ঘরের সিঁড়িতে বসে থাকে , কত কি ভাবে , মন ভালো থাকলে একটা দুইটা গান গায়। তার সাথে সেভাবে কথা বলার আর সুযোগ হয়ে ওঠে না হাসনা বেগমের । কাজেই, বাহির থেকে আসার পর খানিকক্ষণের যে ফুসরত – তার মধ্যেই সারাদিনের জমিয়ে রাখা কথা গুলো বলা শুরু করে সে।

“ কও না আজকের গানের বায়না কেমন হইল? কি খাইতে দিলো ? গান কুনটা কুনটা গাইসো ?”

সুরুজ মিয়া লম্বা দম নিয়ে এসে বসল তার বউয়ের পাশে। ঈশ্বর মানুষের এক গুনের অভাব পুরন করেন আরেক গুন দিয়ে । গতর –মাথা খাটিয়ে কোনো ভদ্রস্থ কাজ সে কখনো জোটাতে পারেনি বটে, তবে বউকে বানিয়ে বানিয়ে তার গানের আসরের কাহিনী শোনানোর ক্ষেত্রে কখনো কল্পনা শক্তির ভাটা পড়েনি। তার মসজিদের নামে টাকা উঠিয়ে ঘর চালানোর কথা তার বউ জানেনা। সে জানে , সুরুজ মিয়া শহরের প্রখ্যাত গায়ক বা বয়াতি , শহরের গলিতে গলিতে তার স্বামীর নামডাক। তার এই বিশ্বাসের পেছনের কাহিনী যথাসময়ে আসবে ।

“আইজ আসরের শুরু হেইরকম জুইত কইরা করতে পারি নাই । বয়সই তো নাই বউ, গলায় হেই জোয়ানকালের জোরও পাইনা।”
হাসনা বেগমের মুখে আঁধার নেমে আসে । তার স্বামীর কষ্টে তার মুখে ব্যাথার প্রগাড় ছায়া পড়ে।

সুরুজ প্রমাদ গোনে । বউ কে খুশী করার জন্য গল্প বানিয়ে বলতে গিয়ে সে যদি বউকে কষ্টই দিয়ে ফেলে, তাহলে আর গল্প ফাঁদার কি দরকার? কষ্টের রসদের কি তাদের জীবনে অভাব আছে ?

“ কি কও ! আইজকা আসর জমাইতে পারো নাই? মাইনসে কটু কথা কইসে ?”

সুরুজ মুখভর্তি হাসি ছড়িয়ে হাসনা বেগমের পাশে বসে । হাসনা বেগম আরও প্রশ্ন করছে, তার মানে- চাইলে সুরুজ এখনো ঘটনা সামলে নিতে পারবে ।

“ তাই কইসি নাকি ? কইলাম যে আসর জুইত মত শুরু করতে পারি নাই। কাইল রাত থেকে গলা একটু বসা ছিল, তাই সকাল সকাল গলা সেইভাবে খুলে নাই । তয় দুপুর হইতে যেই না দলে দলে মানুষ আইসা জড় হওয়া শুরু করলো , আমার গলাও খুইলা গেলো সাথে সাথে বানের লাহান। তারপর যদি মানুষের খুশীর জাকইর যদি দেখতা বউ !”

হাসনা বেগম হেসে ফেলে । ফিক করে মুচকি হাসি । সুরুজ অবাক হয়ে তার বউয়ের মুখের দিকে তাকায় ।

গরিব হবার এই এক সুবিধা, অল্পতেই এরা অনেক কিছু পেয়ে যাবার খুশীতে বিভোর হতে পারে। পকেটে খাবার টাকা নেই , গায়ে তালি দেয়া জামা , মাথার ওপর ফুটো চালা ঘরের ছাউনি – কিন্তু জীবনের ছোট ছোট প্রাপ্তির দিকে এতটা অবাক বিস্ময় নিয়ে তারা তাকায় , তাকিয়ে আনন্দিত হয়, উদ্বেলিত হয় যে তাদের বঞ্চনার জায়গা গুলো চাপা পড়ে যায় সহজেই।

সুরুজ মিয়া ভাবে, এই হাসিটুকুর জন্যই সে এখনও তার পঙ্গু বউয়ের সাথে আটকে আছে। যে সময় সুরুজের ভরাযৌবন, সে সময় তার স্ত্রী সর্বাঙ্গের সৌন্দর্যকে অবান্তর করে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে বিছানায় পড়লো। তারপরও তাদের বস্তির আর দশজন পুরুষের মত সে যে তার বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয় নি তার কারণ তার বউয়ের এই অপার্থিব সুন্দর হাসি। বিয়ের বেশ কিছুদিন পর সুরুজ- হাসনা ঘরে আসে তাদের একমাত্র সন্তান করিমুল্লা।

“ তয় , আজকে আসর মাত করসে কে জানো নি করিমুল্লার মা?”
হাসনা বেগম কৌতূহল নিয়ে তার স্বামীর মুখের দিকে তাকায় । খুব আবেগ নিয়ে কিছু বলতে গেলেই কেবল মাত্র তার স্বামী তাকে করিমুল্লার মা নামে ডাকে ।

“ আসর মাত করসে আমাগো করিমুল্লায় ! আহ কি খাসা গলা যে আমগো বাপধনের! কই বাপ, কই গেলি?” সুরুজ করিমুল্লাকে গলা উচিয়ে ডাকে।
“ বাপ, এদিকে আয় । তোর মায়েরে কদমবুসি কইরা যা। দেখ তোর গানের কথা শুইনা তোর মায়ে কত খুশী হইসে!”

করিমুল্লা এসে মাথা নিচু করে তার মায়ের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে । করিমুল্লার অন্ধকার মুখ সুরুজ মিয়ার চোখ এড়ায় না ।

রাত ঘনিয়ে আসে । খাওয়া দাওয়া শেষে হাসনা বেগম দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে। সুরুজ মাটিতে মাদুর পেতে শুয়ে থাকা তার ছেলের মাথার পাশে গিয়ে বসে । করিমুল্লা একপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে ছিল । সুরুজ তার ছেলের মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দেয় । করিমুল্লা ঘুরে বাবার দিকে তাকায় ।

“ কিরে বাপ, তর ঘুম আসে না ?”
“ আইচ্ছা আব্বা, তুমারে একটা কথা জিগাই ?”

সুরুজ মিয়া আঁচ করতে পারে , তার ছেলে কি জানতে চায় । সুরুজ চুপ করে থাকে।
“ আব্বা , তুমি আম্মার লগে প্রতিদিন মিছা কথা ক্যান কও ?”

সুরুজ আড়চোখে খাটের দিকে তাকায় । তার বউ অঘোরে ঘুমুচ্ছে । সে তার ছেলের মাথায় হাত বুলাতে থাকে ।
“ তুমি তো গান গাও না আব্বা , তুমি বয়াতি না । আমগো কুনো গানের দলও নাই। তাইলে প্রতিদিন ঘরে আইয়া আম্মারে ক্যান কও যে আমরা গান গাই আর টেকা রুজগার করি ? ”
“ আইচ্ছা বাবা, আর কমু না ।” – সুরুজ কথা সংক্ষেপ করার চেষ্টা করে ।
করিমুল্লা কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে আবার সরব হয় -
“ আব্বা , তুমি হেই যে একখান গফ কইতা না রাজপুত্রে তেপান্তরের মাঠ পার অইয়া যায় রাক্ষসরাজের কাছ থেইকা রাজকইন্যারে ছুটাইয়া আনতে হেইডা আইজ শেষ করো না ?” ।

সুরুজ ছোট করে শ্বাস ফেলে । মাঝে মাঝে তার ছেলের আবদার রক্ষা করার জন্য তাকে গল্প বলতে হয়, সুয়ো রানী- দুয়ো রানীর গল্প , রাক্ষস খোক্কোসের গল্প , তেপান্তরের মাঠের গল্প । সম্প্রতি সে তেপান্তরের মাঠের গল্প বলছিল , শেষ করা হয় নি ।

সুরুজ গল্প শুরু করে –
“ কোন পর্যন্ত গেসিলাম জানি ?”
“ রাজকইন্যারে রাক্ষসরাজ আটকাইয়া রাখসে রাক্ষসপুরীতে , রাজকুমার এখন বিশাল তেপান্তরের মাঠের এই পারে বইয়া আসে । ঐ পারে আটকা রাজকইন্যা ।”
“ আইচ্ছা , শুন। রাজকুমার তো পুরাই বেদিশ , কিভাবে সে এত বড় মাঠ পার হইবো । হ্যায় এদিক ঘুরে , ঐদিক ঘুরে , কিন্তু দিশা পায় না । কি করা, কি করা – চিন্তা করতে করতে সে একটা গাছের নীচে ঘুমাইয়া পড়ে ।

এদিকে রাত হইয়া যায় । রাজকুমারের হঠাৎ ঘুম ভাইঙ্গা যায় কার কথায় জানি । রাজ কুমার চোখ খুলে না । চোখ বন্ধ কইরা শুনতে থাকে ।

দুইটা কণ্ঠ - একটা পুরুষ কণ্ঠ , আরেকটা মহিলার ।

নারী কণ্ঠ কয় – ‘ আহারে বেচারা রাজার ছাওয়াল , কেমন হাপাইয়া পইরা ঘুমাইয়া আছে। ’
পুরুষ কণ্ঠ কয় – ‘বেচারার রাজকইন্যারে তো রাক্ষসরাজ তার পুরীতে আটকাই রাখসে । হ্যারে ছুটাই আনতেই তো রাজকুমারে এত দৌড়া দৌড়ি করতেছে।’
‘ কিন্তু রাজকুমার তো দিশা পায় না । হ্যায় কেমনে কইরা পৌছাইব মাঠের ঐ পারে? ও ব্যাঙ্গমা , তুমি তো রাস্তা চিনো । কইয়া দেও না রাজার ছাওয়ালরে।’
‘রাস্তা খুঁইজা পাওয়া তো খুবই সুজা। এই বট গাছের নাক বরাবর ডান দিকে একশ পা হাইটা গেলেই দেখব জারুল গাছের নীচে বান্ধা আসে এক পঙ্খিরাজ ঘুরা। ঐডার পিঠে চাইপা বসলেই একটানে মাঠ পার।’
‘এত্ত সুজা!!’
‘ নিয়ম জানা থাকলে সব কাজই সুজা।’

হঠাৎ সুরুজের কাশি আসে । কাশির দমকে কেঁপে কেঁপে ওঠে সে । করিমুল্লা লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে পানি নিয়ে এসে তার বাবার হাতে দেয় , পানি খেয়ে স্থির হয় সুরুজ । হেলান দিয়ে বসে খাটিয়ার পায়ার সাথে ।
করিমুল্লা স্থির চোখে তার বাবার দিকে চেয়ে আছে । অপেক্ষা করে আছে , কখন তার বাবা আবার গল্প শুরু করবে ।

শুরুজ গলা খাকড়ি দিয়ে আবার শুরু করে –
“ হ , কই জানি ছিলাম ? ও , আইচ্ছা । তো রাজকুমার তো সব শুনল চোখ বন্ধ কইরা । তারপর তো তার আর ঘুম আসে না। সে খালি অপেক্ষা করে , কখন রাত শেষ অইব , আর কখন সে পঙ্খিরাজ ঘুরা খুঁজতে বাইর অইব ।

এইভাবে কইরা রাত শেষ অইল । মুরগের প্রথম ডাক শুইনাই সে লাফ দিয়া উইঠা বসলো । ঝোলার থাইকা পানি বাইর করি হাত মুখ ধুইল ।”

মধ্যে হঠাৎ করেই করিমুল্লা লাফ দিয়ে উঠে বলে বসলো –
“ আব্বা , রাজকুমারের ঝুলার মত আমার একটা ঝুলা আইনা দিবা ?”
সুরুজ হেসে বলে –
“ কেন রে, তর রাজ কুমারের ঝুলা ক্যান লাগবো ? কি করবি ?”

করিমুল্লা কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায় । কি করবে সে রাজকুমারের ঝোলা দিয়ে ? তাদের দুইটা ঝোলা আছে । তারা প্রতিদিন সকালে যখন টাকা তুলতে বের হয় তখন তার বাবা ঝোলা কাঁধে বের হয় । চেঞ্জ করে করে একেকদিন একেকটা ঝোলা নিয়ে বের হয় তারা ।

রাজকুমারের ঝোলার মত একটা ঝোলা থাকলে হয়ত সেই ঝোলায় ভরে আরও বেশী টাকা আনতে পারত তারা ।

কিন্তু সুরুজ মিয়াকে সে গুছিয়ে বলতে পারে না , আসলে ঝোলা নিয়ে তার
পরিকল্পনাটা কি । তাই ছোট করে শ্বাস ফেলে সে বলে –
“ থাউক বাবা , তুমি গল্প কও ।”
সুরুজ মুচকি হাসে । তারপর আবার তার গল্প শুরু করে –
“ রাজকুমার হাত মুখ ধুইয়া বটগাছের মুখামুখি দাঁড়াইয়া নাক বরাবর ডান দিক হিসাব করলো । তারপর হাঁটতে হাঁটতে সোজা ডাইনদিকে একশো পা গিয়া দেখল আসলেই জারুল গাছের নীচে একটা পঙ্খিরাজ ঘুরা দাড়াইয়া আসে । ঘুরাটা রাজকুমাররে দেইখাই সুন্দর কইরা ডাক দিলো একটা ।
রাজকুমার লাফ দিয়া ঘুরার পীঠে চাইপা বইতেই পঙ্খিরাজ ছুট একটা লাফ দিয়া দিলো আকাশে উড়াল ।
পঙ্খিরাজ উড়ে আর উড়ে । উড়ে আর উড়ে । কিন্তু রাস্তা আর শেষ অয় না ।
চৈত্র মাস ছিল হেই সময়, বুচ্ছত ? আকাশ পুরা ফকফকা । রাক্ষসরাজ দূর থেকে দেখল , পঙ্খিরাজে কইরা রাজকুমার আসতেছে । সাথে সাথে সে জাদু দিয়া আকাশ কালো কইরা দিলো । পাঠাইয়া দিলো একটা ঘূর্ণিঝড় ।”

“ আব্বা, মরুভূমিতে ঘূর্ণিঝড় হয় ?”

সুরুজ করিমুল্লার প্রশ্নে কিছুটা হতচকিত হয় , তারপর সামলে নেয়।
“ না, মরুভূমিতে হয় সাইমুম ঝড় ! নাম শুনসোস?”
করিমুল্লা অবাক চোখে তাকিয়ে বলে –
“ না , শুনি নাই !”
“ সেই সাইমুম ঝড়ে পইরা রাজকুমার আর তার পঙ্খিরাজ ঘুরা তো তাল সামলাইতে পারে না । তবু তারা অনেক কষ্টে উড়তে লাগলো ।

এইভাবে উড়তে উড়তে তারা প্রায় চলি আসছে রাক্ষসপুরীর কাছে । রাজকুমার তার তরোয়াল বাইর করি উচাইয়া ধরলো । রাক্ষসরাজ তো পাইয়া গেল ভয় ! সে তার সব শক্তি নিয়া মারল এক বান !”

-এই পর্যন্ত এসে থেমে গেলো সুরুজ মিয়া । কিছুক্ষণ আগে ছেলের করা প্রশ্নের কথা মনে পড় গিয়েছে তার। মেজাজ হঠাৎ খিঁচরে গেলো । গল্প শেষ না করেই উঠে দাঁড়ালো সুরুজ ।

“ ঠিক আছে , বাকী গল্প পরের দিন। ঘুমা এখন।”

করিমুল্লা তো পুরো অবাক , গল্পের এ রকম চরম মুহূর্তে এসে তার বাবা কেনো গল্প থামিয়ে দিলো – সে কিছুই বুঝল না ।

“ তারপর কি হইলো আব্বা, শেষ কইরা যাও না ?”
“ কি আর হইল , বান খাইয়া রাজকুমার মইরা গেলো । ঘুমা এখন । ”
“ কিন্তু রাজকুমার কি কখনো বান খাইয়া মইরা যাইতে পারে ? এইডা কেমুন গল্প?”

ছেলের অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে সুরুজ মিয়া উঠে ঘরের দরজা খুলে ঘরের সিঁড়িতে এসে বসলো।

দুনিয়ার স্বার্থপরতায় সে তিতিবিরক্ত । “ রাজকুমার কি কখনো বান খাইয়া মইরা যাইতে পারে ?”- প্রশ্নের কি ছিরি ! কেন পারে না ? অবশ্যই পারে!

প্রত্যেকে নিজের মত করে সব গল্প শুনতে চায় । সামান্য একটা রুপকথা , সেইখানেও তার ছেলে নিজের পছন্দ মত একটা সমাপ্তি দাবি করে । তাহলে সুরুজ তার জীবনকে ঘিরে যে একটা ছোট্ট একটা গল্প বানিয়েছে , তার সমাপ্তি কেন মানুষ তাকে তার পছন্দমত কল্পনা করে নেবার সুযোগটুকু দিতে চায় না ?

ছোট্ট , সরু এই গলির মধ্যে পাখির বাসার মত তার বাসা । এখানেই তার পঙ্গু, পক্ষাঘাতগ্রস্থ স্ত্রী তাকে ভালোবেসে কাটিয়ে দিয়েছে বিশটি দীর্ঘ বছর।
তাকে ভালোবেসে ?

সুরুজ মিয়া চিন্তায় মগ্ন হয়। তাকে কেন ভালবাসবে হাসনা? সে বরাবরের চালচুলোহীন একটা মানুষ। প্রথম জীবনে গ্রামে সুরুজ আসলেই বয়াতি ছিল। তার ছোট একটা গানের দল ছিল। এবং সেই দলটার আশেপাশের চার পাঁচ গ্রামে বেশ খ্যাতিও ছিল। সে প্রথমবারের মত তার স্ত্রীকে সামনাসামনি দেখে এরকমই এক গ্রামের গানের আসরে। হাসনা ছিল সেই গ্রামের এক স্কুলমাস্টারের মেয়ে।

সুরুজের গান শুনে হাসনা সেইদিন-ই ঘোষণা করে, এই গায়কের সাথে তার বিয়ে না দেয়া হলে সে বিষ খেয়ে মারা যাবে। সুরুজ ছোট্ট মেয়েটার সাহস দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলো। এতটুকু মেয়ে, যে তাকে আগে কখনো দেখেই নি , সে শুধু তার গান শুনে তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গিয়েছে!

হাসনার স্কুলমাস্টার বাবা তো কোনওভাবেই বিয়ে দিতে রাজি হন নি। কিন্তু উড়নচণ্ডী সুরুজের মনে স্থায়ীভাবে মেয়েটা দাগ কেটে যায় । একমাস পর সুরুজ হাসনার বাবাকে গিয়ে বলে , সে তার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। সে ঢাকা গিয়ে ব্যাবসার চেষ্টা করবে । এদিকে হাসনা বেগম এরই মধ্যে দুইবার ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে আত্মহত্যার ব্যার্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সুরুজ মিয়ার কথার ভরসায় হাসনার বাবা তার মেয়েকে সুরুজের হাতে তুলে দেয় ।
ঢাকায় এসে সুরুজ নানা ব্যাবসা করার চেষ্টা করে। কোনটাতেই সফল না হয়ে এই ঠকবাজির কাজে নামে। গ্রামের বাড়িতে মসজিদ বানাবে এই কথা বলে মানুষের কাছে টাকা তুলে সংসার চালায়।

কিন্তু, এই সবকিছুর মাঝে সে তার বউকে এই কথাটা জানানোর সাহস পায়নি যে সে গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। এদিকে ছেলের সামনে মিথ্যা কথা বলে বলে সে প্রতিনিয়ত ছেলের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছে । এই কষ্ট সুরুজ আর বুকে ধরে রাখতে পারছে না ।

সুরুজ ভারাক্রান্ত মনে তার ছোট্ট চালাঘরের সিঁড়িতে এসে বসে ।
সুরুজকে তার পাড়া প্রতিবেশী , আত্মীয়স্বজন , এমনকি তার ছেলে তাকে জীবনযুদ্ধে ব্যর্থ একজন মানুষ হিসেবেই দেখে , এটা সুরুজের অজানা নয়। আর সুরুজ এই উপেক্ষার দৃষ্টিকে তার প্রাপ্য বলেই মনে করে। কারণ, সে জানে সে বউ- বাচ্চাকে কখনোই কিছু দিতে পারে নি । কিন্তু এও তো সত্য যে সে কখনো কারো কাছে কিছু চায় ও নি । তবে তার স্ত্রীকে খুশী করার জন্য সে যে সামান্য একটা বানানো কাহিনির আশ্রয় নেয় , তার বিরুদ্ধেও সবার কেন এত ক্ষোভ ?

সুরুজ মিয়া আকাশের দিকে তাকায়। চাঁদ নেই আকাশে। কিন্তু সারা আকাশ ভর্তি তারা, অসংখ্য অগনিত তারা! সে যখন অনেক ছোট, তার মা তাকে মাটিতে বসিয়ে মেঝেতে মুঠো মুঠো মুড়ি ছিটিয়ে দিত। আদর করে বলত- “খা আমার বাপ, খা...”! আজ অনেক গুলো বছর পর এসে সুরুজের মনে হল আকাশ ভরে যেন তার মা মুড়ির ছড়ানোর মত করে তারা ছিটিয়ে দিয়েছে, আর বলছে – “ খা আমার বাপ, খা... বয়স হলি কি আর মায়ের হাতে খাতি নেই?” !

“ কিরে বাপ, মুখ বেজার কেন তোর?”
“ মা, তোমার নাতি আমার উপর রাগ করছে। আমি ওর মায়ের লগে মিথ্যা কথা কই রোজ দিন এই লইয়া।”- সুরুজ জবাব দেয় ।

সুরুজের বৃদ্ধা মা সব শোনেন, শুনে হাসেন । তার ছেলের বয়স হয়েছে, কিন্তু বুদ্ধি হয় নি!

“ কি মিছা কথা বাপ?”
“ ঐযে, আমি ওর মায়েরে কই যে আমি বয়াতি, গান গাইয়া টাকা জুগার করি। তোমার নাতি এইডা সইতে পারে না। রাগ করে খালি। এহন আমি কি করি? প্রতিদিন এক ঘ্যানঘ্যান ভাল্লাগে?”

সুরুজের মা আবার হাসেন। মুখ টিপে হাসি...
“ এইডা কই মিছা কথা? আমার কাছে তো এইডা মিছা কথা লাগে না!”
“ মা, কথার প্যাঁচ মাইরো না। তোমার কথার প্যাঁচ আমার বুঝে আসে না।”
“ আহা, সুজা কথাই তো কইলাম! তুই তোর বউয়ের লগে মিছা কথা কস এইডা তো আমার মনে হয় না।”
“ ক্যান, আমি তো অরে প্রত্যেক দিন আইসা আমার গানের দলের বানাইন্না কিসসা শুনাই । আমি কি বয়াতি? আমার গানের দল আসে?”
“ বয়াতি না, তয় গান গাইয়াই তো টেকা কামাস! সুর কইরা টেকা চাস না মানুষের কাছে ? ঐডা তো গান-ই হইলো, তাই না? ”
“ মা,আমি মসজিদের নামে টেকা উঠাই, হেই টেকা দিয়া ঘর চলে। তুমি তো সবই জানো...”

সুরুজ মিয়ার বৃদ্ধা মা স্তব্ধ হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকেন । তারপর মাথা নিচু করে রেখেই বলতে থাকেন –
“ সুরুজ, হাচা কথা দুই পদের। একপদ হইল যেইডা তুই জানস, তোর পোলায় জানে। আরেকপদের হাচা কথা হইল তোর বউ যেইডারে হাচা মনে কইরা বিশ বচ্ছর বুকে আগলাইয়া ধইরা বাইচা আছে।”

সুরুজ মিয়ার মা একটু থেমে দম নেন-
“ ভালো কইরা বুইঝা ল । তোর বাপে যখন আমারে আর তরে ছাইরা চইলা যায়, তখন তোর বয়স কয়েকমাস। বড় হইবার পর থেকেই তুই জানস তোর বাপে বিদেশ থাকে। হেইখান থেইকা মাসে মাসে টাকা পাঠাইয়া আমাগো খাওয়ায় পরায়। তুই কখনো ট্যার পাস নাই ঘরে কোথা থেইকা আসলে টাকা পয়সা আসে। আমিও তরে কখনো জানাই নাই। কারন, হাচা কথা যেইডা ছিল, আমি হেইডা তরে জানাইতে পারতাম না। তয় যেইডা তোর লাইগা হাচা কথা হইবার পারে, যেইডা বিশ্বাস কইরা তুই রাইতে শান্তির ঘুম দিতে পারবি, আমি তরে হেইডা কইসি।”

বৃদ্ধা মাথা না তুলেই কথা বলতে থাকেন –
“ বাকি কি করবি হেইডা অহন তোর সিদ্ধান্ত । আমি তোর মা, কিন্তু এইবেলায় তোর মনে দুখ না দিয়া আমার উপায় নাই। তোর বউ তরে পসন্দ কইরা পাপ করসিলো । মাইয়াডারে দুখ ছাড়া একবেলা সুখ তুই দিবার পারস নাই। কেবল তোর গলার গীত ওর ভাল্লাগে এইল্লাইগা, তরে বিরাট বয়াতি মনে কইরা অয় বাইচা আছে এতগুলি বছর । অহন যেই সইত্ত অরে আরও কষ্ট আইনা দিব, ঐ সইত্ত ওর জানোন লাগব না। যেই মিথ্যারে সইত্ত জাইনা অয় খুশী আসে হেইডা মিথ্যা বানায়া অরে আর দুঃখ দিস না বাপ।”

নীরবতার কিছু মুহূর্ত কেটে যাবার পর সুরুজ মিয়া সিঁড়ির ওপর প্রান্তে তাকায়। তার মৃত মায়ের ছায়া অন্ধকারে মিশে গেছে।

বাড়ির চাল থেকে বরই গাছের লতাপাতা ঝুলে নেমে বাতাসে দোল খাচ্ছে। গরিবের কপালে বঞ্চনা আর বঞ্চনা । এমনকি এই বরই গাছেও বরই হয় না। ঘরে ঢুকে ঘুমুতে যাবে এমন সময় সুরুজ অবাক হয়ে দেখলো গাছটায় বেশ কিছু ডাঁশা ডাঁশা বরই দেখা যাচ্ছে। কিছু বরই ছিঁড়ে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। সকালে বউকে সে নিজ হাতে বরই খাওয়াবে।

তার মন এখন অনেক স্থির। মসজিদ বানানোর নাম করে সে যে সামান্য কিছু টাকা মানুষের পকেট থেকে বের করে নিয়ে পেট চালায়, শেষ বিচারে তার এই অপরাধের ক্ষমা হবে কিনা তা সে জানে না। তবে সে নিশ্চিত, তার বউকে এই কল্পনার অলীক জগতে বিভোর রাখার অপরাধে পরম করুনাময় তাকে কাঠগড়ায় দাঁর করাবেন না।

নাহলে তার মত যৎসামান্য মানুষের আর পৃথিবীতে দাঁড়ানোর জায়গা থাকে?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০২৩ রাত ১১:২৫
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×