গ্রামে, পশ্চিমের পুকুর পেরিয়ে, ডগির ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম;
একা।
অনেক দিনের পর।
কখনো কখনো অতীতের মত একা আর কিছুই হয় না। এই অতীতেই আমার "একা"র, যাত্রা। বহুবার শুরু বহুবার শেষ। এখনো চলছে, নিয়ত অতীতে, নিয়ত বর্তমানে; শুরু এবং শেষ।
মাঠে, বসন্ত বাতাস। হু হু করা। অচীন পাখির কান্নার রোল পড়েছে যেন। ঝড়ে পড়া পাতা আর মাতোয়ারা সবুজ ধানে ভেসে আসছে মৃত্যুর গন্ধ। অসহনীয় রকম নির্বিকার। একটা রিসাইকেল প্রসেস মাত্র। চারপাশে কেবল মাটি আর মাটিজাত সবকিছু। এমনকি নীল আকাশটাও। এই গন্ধের গন্ধ নাই, কিন্তু দৃশ্য আছে। অপূর্ব সবুজ, জীবনময় দৃশ্যকল্প।
এই গন্ধের গন্ধ নাই, কিন্তু শব্দ আছে। শনশন শনশন। হু হু হু হু।
মাঠে আরো একজন।
তিনি গ্রামের বৃদ্ধা, ছোটবেলায় যাঁর স্তনজোড়া ঘিরে আমার বিমুগ্ধ বিষ্ময়। দুপুরের পুকুর থেকে ওঠার পর তাঁর ভেজা শালকাঠের বাঁক; পিচ্ছিল, দৃঢ়। এর মাঝে তাঁর শ্লোগানের মত উদ্ধত স্তন; প্রাণবন্ত, অনিঃশেষ বিপ্লব আর জীবনের উৎস। দারিদ্র, ছনের ঘরের যুদ্ধ, ঝগড়া, বছরে বছরে নতুন শিশু, রূঢ় রসিকতা সবকিছুকে সামাল দেয়া একজোড়া টগবগে জীবন, একজোড়া হুংকার। ব্লাউজহীন বুকের জমিনে লড়াইয়ের পেশী।
তিনি। একটা ঝকঝকে ছাগলকে নিয়ে মাঠের ভিন্ন ভিন্ন কোণায় নিয়ে খুঁটি বাঁধছেন। ঠক ঠক ঠক। আবার খুঁটি উপড়ে ফেলছেন। মাটিটা নরম, খুঁটি গেঁথেও যাচ্ছে যেমন, বেরও হয়ে যাচ্ছে তেমনি। বিশেষ কোন পরিশ্রম নেই। তবুও মাটির কোন প্রান্তেই স্বস্তি হচ্ছে না। হয়ত এই প্রাণীটির সবুজ ঘাস পাওয়া মুখ্য নয়, প্রাণীটি; এই সকালে হয়ত ক্ষুধার্তও নয়। প্রাণীটির সাথে বাঁধা আছে লম্বা একটা দড়ি, সে যেতে পারে যেখানে ইচ্ছা, যখন তখন। তার ঘাসের অভাব নেই। এই মাঠেরও নেই। যদিও বৃদ্ধার স্বস্তি হচ্ছে না।
আমি তাঁর দিকে পিঠ দিয়ে বেনসন ধরাই। তাঁকে সম্মান জানাই। অতীতে দেয়া সম্মানের অভ্যাস। এই সম্মানের অভ্যাসের কোন অর্থ কি আছে? তিনি কি আমাকে চিনেছেন? আমার চিন্তা করতে ভালো লাগে না। আমি শুধু সিগারেটের কথা ভাবি। প্রবল বাতাসে সিগারেট ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
এই বৃদ্ধা, এই সবুজ, এই নির্বিকার ধান-ক্ষেত, এই একা অতীত থেকে, আমরা না; ফিরতে ইচ্ছা করে না। এই মাটি থেকে আমার ফিরতে ইচ্ছা করে না। এই সুদৃশ্য নিষ্ঠুর রিসাইকেল সহ্য করার চাইতে আমার তখনি ঢুকে যেতে ইচ্ছে করে থকথকে মাটির ভেতর। অথবা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে একটি ঝকঝকে প্রাণী, দড়ি বাঁধা।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৪ সকাল ৮:৪৩