somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতির নদী

০৩ রা মার্চ, ২০১৪ রাত ৮:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



স্মৃতির নদীতে আমি ভেসে চলেছি বহুদিন। বহু বহু বহুদিন। ঠিক কবে থেকে তাও আমার মনে পড়ছে না। এ নদীর শুরু ছিলো কিন্তু শেষ নেই। দীর্ঘকাল আমি আশেপাশে কোনো কূল দেখিনি। ক্লান্তিহীনভাবে আমি ভেলাটিকে ভাসিয়ে চলেছি এবং স্মৃতি সংগ্রহ করে চলেছি।

আমার ভেলার চারপাশে অসংখ্য স্মৃতি সাঁতড়ে বেড়ায়। স্মৃতিগুলো যেনো জীবন্ত। ধরতে গেলে ছটফট করে। কিন্তু একটু পর ই পোষ মেনে যায়। নিজ ইচ্ছেতেই ভেলাতে এসে পড়ে যেনো। প্রথম প্রথম আমি ব্যাপারটিতে খুব রোমাঞ্চ বোধ করতাম। অসংখ্য প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি আমি তুলে ভেলায় রাখছিলাম দিনের পর দিন। কিন্তু এতে আমার ভেলাতে খোলা জায়গাগুলো যেনো নেই হয়ে যাচ্ছিলো।
একদিন প্রচন্ড শান্ত এই নদীতে ভাসমান ভেলায় শুয়ে শুয়ে আমি আকাশ দেখছি। আমার চারপাশে স্মৃতিগুলো গিজ গিজ করছিলো। আমার ধারণা আকাশের মেঘগুলো থেকে স্মৃতিগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ে। কিন্তু আমি কোনোদিন স্মৃতির বৃষ্টি দেখিনি। এ নদীটি এতো শান্ত কেনো? এ ভাবতে ভাবতে আমি পাশ ফিরলাম। এতে কিছু স্মৃতি কল কল করে উঠলো। আমি পাশ ফিরে অপ্রয়োজনীয় স্মৃতিগুলোকে দেখতে লাগলাম। আরেক পাশ ফিরে দেখলাম শান্ত নদীর স্বচ্ছ পানিতে অসংখ্য স্মৃতি সাঁতড়ে বেড়াচ্ছে। আমি হাত পানিতে ডুবিয়ে নাড়াতে লাগলাম। হঠাত কি জানি মনে হলো, লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম। ধীরে ধীরে কিছু স্মৃতিগুলোকে আমি পানিতে ছেড়ে দিলাম। সেগুলো সর-সর করে চলে গেলো। আমি আগ্রহী হয়ে উঠলাম, ধীরে ধীরে অসংখ্য পুরোনো অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি আমি ছেড়ে দিলাম। সেগুলো একবারো ফিরে তাঁকালো না। আমি ই ভেবেছিলাম তারা আমার পোষ মেনেছিলো। হতাশ হয়ে হালকা হাসলাম। খুশীও হলাম এখন আমার ভেলাতে অনেক খোলা জায়গা। আমি ইচ্ছেমতো শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে পারবো।

দিনগুলো চলে যেতে লাগলো। আমি এখন স্মৃতি সংগ্রহের ব্যাপারে আগের থেকে বেশি খুঁতখুতে। অসংখ্য স্মৃতি আমি ফেলে চলে এসেছি পেছনে। ভেলাতে তোলার প্রয়োজনবোধ ও করি নি। তবে হঠাত হঠাত পুরোনো অপ্রয়োজনীয় স্মৃতিগুলোর কথা মনে পড়ে যায় যেগুলোকে আমি যেতে দিয়েছিলাম বা যেগুলো আমার জন্য দাঁড়ায়নি। সেগুলো অবশ্য এখন ফিকে হয়ে আসছে। আমি বর্তমানের স্মৃতিগুলোকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি। যত্ন করতে থাকি। সাথে সাথে ভেলাটিকে ভাসিয়ে নিয়ে চলি। মাঝে মাঝে দু পা ডুবিয়ে আমি ভাবতে থাকি কবে এ নদীর শেষ হবে? কখনো কি আসলেই শেষ হবে? এর শেষে কি আছে? আলো নাকি অন্ধকার ? আমার পা এর চারপাশে স্মৃতিগুলো ঠুকরে ঠুকরে যায়।

এভাবেই একদিন আমার ভেলার কাছে অসম্ভব সুন্দর একটি স্মৃতি এসে ভিড়লো। আমার অন্যান্য সকল স্মৃতি তার কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছে যেনো। স্মৃতিটিকে আমি ভেলায় তুলে নিলাম। সে ছিলো কিছুটা ক্লান্ত। তাকে দেখেই মনে হচ্ছিলো সে মুক্ত। পোষ মানাবার নয়। তবুও সে কেনো জানি আমার সাথে থেকে গেলো। তার সাথে আমার সময়গুলো ভালো যেতে লাগলো। টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি আমরা মাঝে মধ্যে তুলে নিতাম। পুরনো কিছু প্রিয় স্মৃতিও ছিলো সাথে। অপ্রয়োজনীয় নাকি প্রয়োজনীয় জানি না, তবে আরো কিছু স্মৃতি আমি ফেলে দিলাম। খারাপ লাগছিলো না যদিও। সেগুলো ফিরে তাঁকালো নাকি তাঁকালো না তাতেও আমার কিছু যায় আসছিলো না আগের মতো। বুঝলাম আমি বড় হচ্ছি। নিজেকে নিয়ে আমি খুশী হলাম।

এভাবে কেটে গেলো আরো বহুদিন।

আমার ভেলা জীবনে মোড় হিসেবে একদিন আকাশে খুব মেঘ করলো। টুপ করে আমার কপালে এক ফোঁটা স্মৃতি পড়লো যেনো। এভাবে এক ফোঁটা থেকে দু ফোঁটা। শুরু হলো মুষুলধারে বৃষ্টি। বড় ছোট অসংখ্য স্মৃতি যেনো আকাশ কাঁপিয়ে নীচে ঝড়তে লাগলো। আমি বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে দেখতে লাগলাম। আমার সারাজীবনের দেখা শান্ত নদীটি অশান্ত হয়ে উঠলো। বিশাল বিশাল ঢেউয়ে আমার ভেলাটি উলটে যাচ্ছিলো প্রায়। আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ভেলার এক প্রান্তের একটি খুঁটি শক্ত করে ধরে রইলাম। নদীতে শান্ত বড় বড় স্মৃতিগুলো যেগুলো সবসময় ভেসে বেড়ায়, কারো কাছে ধরা দেয় না তারা যেনো হিংস্র হয়ে উলটে দিতে চাইলো আমার ভেলা। এভাবে সারা রাত চললো এই ঝড়-বৃষ্টি। সকালে হুট করে সব শান্ত যেনো। আকাশ নদী সবই আগের মতো শুধু আমি দেখলাম আমার ভেলাটির অবস্থা ছিন্ন-ভিন্ন। কিচ্ছু নেই বলতে গেলে সেখানে আর। অনেক পুরনো জীর্ণ কিছু স্মৃতি পড়ে আছে ভেলাটিকে আকড়ে। আর কিছুই নেই। হঠাত সুন্দর স্মৃতিটির কথা মনে পড়লো। আমি আতি পাতি করে সারা ভেলা খুঁজলাম কোথাও পেলাম না।আমি জানতাম সে একদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। থাকবে না। হু হু করে কান্না পেলো তখন। আমি বোকার মতো প্রথমবারের মতো কাঁদতে লাগলাম। পুরনো স্মৃতিগুলো আমার কোলে মাথা ঘষতে লাগলো যেনো স্বান্তনা দিচ্ছে। বড় বড় স্মৃতিগুলো আমার ভেলার নীচ দিয়ে ভেসে যেতে যেতে আমাকে যেনো বলে গেলো থাক কেঁদো না। আমি তাও কাঁদলাম। কান্না শেষ হবার পর আমি চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। সেই মুহূর্তেই টের পেলাম আমি আরো বড় হয়ে গেছি।

এভাবে আরো অজস্র দিন পার হয়ে গেলো। আমি অনেক স্মৃতি পেলাম এবং হারালাম। আকাশ থেকে আরো বহুবার স্মৃতির বৃষ্টি হলো। আমি নতুন কিছুকে কাছে নেয়া থেকে বিরত থাকলাম। তবে দূর দিগন্তে তাঁকিয়ে থাকতে থাকতে আমার হঠাত করে সেই সুন্দর স্মৃতিটার কথা মনে পড়তো। আমি খুব সাবধানে লুকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। যেনো নিজের কাছ থেকে লুকিয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেলছি।

এভাবে গেলো আরো বহুদিন। সেই প্রথমদিকের কথাগুলো আমার মনেই পড়ে না। সবকিছু ভুলে যাচ্ছি। ভেলা থেকে প্রিয় ও পুরনো কিছু স্মৃতি বাদে সবকিছুই ফেলে দিচ্ছি আজকাল। আমি বড় হয়ে যাচ্ছি সাথে সাথে ক্লান্ত। এই ভেলা টানতে কষ্ট হয় এখন। একঘেয়ে জীবনে স্মৃতি সংগ্রহ করতে করতে আমি বিরক্ত।

কিন্তু সেদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর আমি ভয়ংকর অবাক হলাম। আমি দেখলাম আমার ভেলা এক দ্বীপের কাছে এসে পড়েছে। আমি বার বার চোখ খুলে বন্ধ করে ভাবছিলাম এ স্বপ্ন নয়তো? হয়তো আমি কল্পনা করছি। হয়তো মরীচিকা। হয়তো কোনো ধোঁকা। এ কি করে সম্ভব? উত্তেজনায় আমার হাত-পা কাঁপছিলো। এরপর যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমি দেখলাম সেই স্মৃতিটি পাড়ে পড়ে আছে। সে যেনো আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো দীর্ঘকাল। আমাকে দেখে সেও আনন্দিত হয়ে মাথা নাড়াতে লাগলো।

আমার মাথায় অসংখ্য প্রশ্ন খেলে যাচ্ছিলো। তাহলে কি আমি পাড়ে নেমে পড়বো। এখানকার জীবন সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। যদি হেরে যাই ? কিন্তু সে যে এখানে। হয়তো আর কোনোদিন আমাদের দেখা হবে না। হয়তো আর কোনোদিন আমি কোনো দ্বীপের দেখা পাবো না। একঘেয়ে জীবনে কি আমি বিরক্ত নই? একঘেয়ে জীবনে জয়ের চেয়ে এখানে পরাজয়ই কি ভালো নয়? তাই ভাবতে লাগলাম। অবশেষে বড় সিদ্ধান্তটি আমি নিয়েই ফেললাম। পুরোনো স্মৃতিগুলোকে যতসম্ভব পকেটে পুড়ে মাথায় করে আমি কোমড় পানিতে নেমে পড়লাম। ধীরে ধীরে পানির পরিমান কমতে লাগলো। আমি দ্বীপটির দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। পুরনো স্মৃতিগুলো চারদিকে আনন্দে ছুটোছুটি করতে লাগলো। না, তারা আমাকে ফেলে যায়নি। আমাকে ফেলে তারা কোথাও যায়নি। দীর্ঘকাল পর বুঝলাম তারা আমাকে আসলেই ভালোবাসে। সুন্দর স্মৃতিটির দিকে আমি এগিয়ে যেতে লাগলাম, একবার পেছন ফিরে আবিষ্কার করলাম ভেলাটি ভাসতে ভাসতে চলে গেছে মাঝ নদীতে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার বুকটা ধক করে উঠলো। হালকা ভয় যেনো আমাকে ঘিরে ধরলো। তবে তা যেনো কিছুক্ষনেরই।

আমি আবার সামনে এগোতে লাগলাম। আমি দীর্ঘকাল স্মৃতির নদী পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছি, বহু ঝড় বৃষ্টি পার করেছি। অনেক প্রিয় স্মৃতি হারিয়েছি আবার ফিরেও পেয়েছি। এতকাল যখন পেরেছি আমি এখন ও পারবো।

** অনেকদিন কিছু ভালো করে লিখি না। হঠাত পরশু রাতে উলটা পুলটা কিছু একটা লেখে ফেললাম।
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৮

আজ (১০ মে ২০২৪) রাত দুইটা দশ মিনিটে নিউ ইয়র্কের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা। এর আগেও পশ্চিমের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় গিয়েছি, কিন্তু সে দু’বারে গিয়েছিলাম যথারীতি পশ্চিমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×