----------------------------------------- ড. রমিত আজাদ
Ukraine in memories, Russia in memories – 1
---------------------------------------------Dr. Ramit Azad
ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের (পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকা) মধ্যে একটা প্রচন্ড ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়েছে। এই ঠান্ডাটা হঠাৎ করেই আবার গরম হয়ে যায় কিনা, সেই আশঙ্কাও করছে অনেকে। আমি বর্তমানে অবস্থান করছি আমার জন্মভূমি বাংলাদেশে, ঘটনাস্থল থেকে অনেক অনেক দূরে। তারপরেও পরিস্থিতি আমাকেও উদ্বিগ্ন করছে, পাশাপাশি ব্যাথিতও করছে, কেননা দুটি দেশেই আমি অনেকগুলো বছর কাটিয়েছি। দুটি দেশেই আমার কেটেছে পুরো তারুণ্যটাই।
জাতিতে জাতিতে বিভেদ, শত্রুতা, রেষারেষী, হানাহানী, সংঘাত ও যুদ্ধ চলছে স্মরণাতীত কাল থেকেই। আবার জাতিতে জাতিতে বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, ভালোবাসা ইত্যাদিও চলছে অনাদিকাল থেকেই। কোনটি ভালো? সংঘাত না বন্ধুত্ব? যুদ্ধ না শান্তি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরেছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দার্শনিক পর্যন্ত সবাই। ইউক্রেন ও রাশিয়ায় কাটানো আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমিও কিছুটা চেষ্টা করবো এই উত্তর খুঁজতে।
১৯৮৯ সালের আগস্ট মাসের এক শান্ত সকালে পা রেখেছিলাম সেই সময়ের প্রবল প্রতাপশালী শক্তিধর রাষ্ট্র পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নে। ঢাকার মাটি ছেড়ে নীল আকাশে হারিয়ে গিয়ে দশ ঘন্টা উড্ডয়নের পর বিমান থেকে বেরিয়ে মস্কোর শেরমিতোভা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের অত্যাধুনিক টার্মিনাল ভবনে নেমে তার জমকালো সৌন্দর্য্যে তাক লেগে গিয়েছিলো। তারপর বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে পরাশক্তির কেন্দ্রস্থল গ্র্যান্ড মস্কো শহরের শোভায় চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিলো। গাছ আর গাছ, বাগান আর বাগান, প্রকৃতি মাতার নিপুন তুলির আঁচড় আর রাশান কনস্ট্রাকটিভিজমের প্রভায় নিখুঁত দক্ষতায় নির্মিত সব দালান-কোঠা, এই দুয়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বিশাল নগরীটিকে মনে হয়েছিলো অতুলনীয়।
ঢাকা শহরে তখন আমরা কোন ফ্লাইওভারই দেখিনি। শাহবাগ, লালবাগ, গোপীবাগ, মালিবাগ, মধুবাগ, শান্তিবাগ নানান রকম বাগীচায় ছেয়ে থাকা ঢাকার সব বাগান বিলুপ্ত হয়ে কেবল নাম সর্বস্ব হয়ে থাকা ঢাকা অনেক আগেই শ্রীহীন হয়ে গিয়েছে। সেই শহরের বাসিন্দা হঠাৎ করেই গার্ডেন সিটি মস্কোকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি।
বিশাল মস্কোর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় 'মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি'। বিশ্ববিদ্যালয়ের গগনচুম্বী অট্টালিকাটির ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি হোটেলে কাটালাম দুদিন। সেখানকার হৃদয়বান বড় ভাইয়েরা ঘুরে দেখালেন ঐশ্বর্য্যমন্ডিত ইতিহাসখ্যাত মস্কো শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো। রেড স্কয়ার থেকে শুরু করে লেনিনের সমাধী হয়ে অলিম্পিক স্টেডিয়াম পর্যন্ত কিছুই বাদ দেয়া হয়নি। তবে সেবার ঐ সিটিতে থাকা হয়নি। অপরূপ মস্কো সিটি থেকে বিদায় নিতে হয়েছিলো । তখনকার রীতি অনুযায়ী আগত বিদেশী ছাত্রদের ছড়িয়ে দেয়া হতো বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়নের আনাচে-কানাচে। ভাষা শিক্ষা কোর্স করার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছিলো জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসি শহরে।
পরবর্তি একটি বছর রুশ ভাষা শিখে ও হেসে-খেলে আমার সময় কেটেছিলো স্নিগ্ধতায় ভরা ককেশাস পাহাড়ের কোলে। রীতি ছিলো, ল্যাংগুয়েজ কোর্স পাশ করার পর মূল বিষয়ে পড়ার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের আরেক দফা ছড়িয়ে দেয়া হতো সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিবিলিসি স্টেট ইউনিভার্সিটির ল্যাংগুয়েজ কোর্স ডিপার্টমেন্টের সমাপান্তে, আমাকে একদিন ডাকলেন ডেপুটি ডীন আলেকজান্ডার স্যার (আমরা নামের সংক্ষেপ করে উনাকে ডাকতাম সাশা)। সবগুলো ইউরোপীয় ভাষায় পারদর্শী সাবেক বিমান বাহিনী কর্মকর্তা হ্যান্ডসাম হিরো এই শিক্ষক আমাদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। স্যার আমাকে ডেকে বললেন, "তোমার জন্য দুটি অপশন রয়েছে, চাইলে তুমি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েই থেকে যেতে পারো, আর তা নইলে তোমাকে যেতে হবে ইউক্রেনের 'খারকোভ স্টেট ইউনিভার্সিটিতে'। সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আমি এক মিনিট ভাবলাম। জর্জিয়া আমার দেখা হয়ে গিয়েছে। আবার এখানেই থেকে না গিয়ে বরং ইউক্রেন চলে যাই। তাহলে আরো একটি দেশ ও জাতি দেখা হবে। চটজলদি উত্তর দিলাম, "ইউক্রেন যাবো।" স্যার আমার দিকে এক মিনিট নীরব তাকিয়ে রইলেন। কি ভাবছিলেন জানিনা। হয়তো স্যার চাইছিলেন আমি উনার ইউনিভার্সিটিতেই থেকে যাই। অথবা স্যার আমার মনোভাব পড়তে চাইছিলেন। জানিনা কেন। যাহোক একটু পড়ে মৃদু হাসি খেলে গেলো সুদর্শন সাশার ঠোটে। যদিও তিনি জর্জিয়ায় থাকতেন, কিন্তু জাতিগত পরিচয়ে তিনি ছিলেন রুশ। স্যার বললেন, "ঠিক আছে তোমার যা ইচ্ছে।"
১৯৯০ সালের এক শান্ত বিকেলে আমি তিবিলিসি ছাড়লাম। উড্ডয়নের পরপর বিমানটি বিস্তৃত ককেশাস পর্বতমালার উপর দিয়ে উড়ে উড়ে একসময় ঢুকে পড়লো ইউক্রেনের আকাশ সীমায়। ঘন্টা দুয়েক পড়ে সফল অবতরন করলো খারকোভ বিমানবন্দরে। যখন এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে এলাম তখন সেখানে গ্রীস্মের উষ্ণ সন্ধ্যা।
(চলবে)