somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পঁচিশ নম্বর ভূত ( অনুগল্প )

২১ শে মার্চ, ২০১৪ সকাল ১০:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


( উৎসর্গঃ নদীতে ভেসে বেড়ানো উদবাস্তু লাশগুলোকে )

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার আরাম কেদারায় আয়েস করে বসে আছেন । সন্ধ্যা হয়েছে । সারাদিন খুব গরম ছিল । এখন ঠাণ্ডা বাতাস হচ্ছে । পদ্মার বোটে বসে এই বাতাস খেতে খুব ভালো লাগে । এই সময় কবি গুন গুন করে গান করেন । গানের কথাগুলো বাতাসের সাথে নাচানাচি করে , হাসাহাসি করে , এক অন্যের গায়ে ঢলে পড়ে । আজ কবি গান গাচ্ছেন না ।

রাতে একটা জরুরি সভা আছে । এক সপ্তাহ আগে থেকেই এই সভার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছিলো। কবির একমাত্র সেবক নরেন নদীর ধারের গ্রাম থেকে ভালো রসগোল্লা জোগাড় করে রেখেছে । সভায় বড় মাথার লোকরা আসবেন । খালি মুখে কথা জমে না । তাই রসগোল্লা দিয়ে মুখ ভর্তি করতে হবে । কবি সেই সভা নিয়ে ভাবছেন ।

তার এক ভক্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর পাঠিয়েছে । এই ভক্তের বাড়ি ঢাকার পাশে বিক্রমপুরে । এককালে আর্মিতে কাজ করতো । আর্মির লোক গান পছন্দ করে না । ওরা পছন্দ করে ঢুস ডাঁশ। বন্দুকের শব্দ এদের কাছে মধুর লাগে । তবে এই মানুষটা ভিন্ন । প্রতি রাতে গীতাঞ্জলী না পড়ে ঘুমাতে যেত না । পড়ার পরে বলতো আহা কি লেখা । এই কবি বাঙ্গালী না হলে আমি জাতীয়তা পরিবর্তন করতাম । একশত ভাগ করতাম । তার নাম ফরিদ মিয়া । সে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের শেষের দিকে পাক বাহিনীর হাতে মারা যায় । পালিয়ে যুদ্ধ করতে এসেছিলো । মৃত্যুর পর থেকেই ঢাকার পুরাতন বিমানবন্দরে থাকে । বিমানের শব্দ না শুনলে নাকি তার ভালো লাগে । মন অস্থির লাগে । ভুতেদের মন নাই এমন তো কোন কথা কোন গ্রন্থে লেখা নাই ।

ফরিদ মিয়া চিঠিতে জানিয়েছে বাংলাদেশ এক মহা আয়োজন করেছে । এই আয়োজনের কথা শুনলে যে কেউ হাত তালি দিবে । হাত না থাকলে পা তালি দিবে । চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করবে । ব্যাপার হল বাংলাদেশের জাতিও সঙ্গীত গেয়ে বিশ্বরেকর্ড করা হবে । যে সে কথা না । এক লাখ মানুষ একসাথে এই গান গাবে। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি , চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রানে বাজায় বাঁশি। ভূত সমাজের উচিৎ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা । এমন দৃশ্য দেখা কি সবার ভাগ্যে জোটে । জোটে না ।

ভুতেদের ডাক বিভাগ খুব ভালো কাজ করে । তিন দিনের মধ্যে চিঠি এসে পৌঁছেছে । কবি নদীতে ছিলেন বলে একদিন দেরি হয়েছে । না হলে আগেই চলে আসতো । চিঠি পাওয়ার পর পরই কবি সভার আয়োজন করেছেন । বড় মাথার ভূতদের আগেই জানানো হয়েছে । সবাই আসবে । তাদের নিয়ে আজ রাতে সভা হবে ।

কবি এই সভা নিয়ে ভাবছেন । আজ তিনি খুবই খুশি । মনে মনে ভাবছেন বাংলাদেশ কতো কিছু করছে । সেদিন পতাকা নিয়ে রেকর্ড করলো । তার খুব যাওয়ার ইচ্ছা ছিল । তবে মাজার বেথ্যার কারনে যেতে পারেন নি । তবে এইবার অবশ্যই যাবেন । নদী নালা সব ভরাট হয়ে গেছে , এর উপরে গরু ছাগল চরে । সমস্যা নেই । কোন রকমে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত যেতে পারলেই হবে । পরের বেবস্তা ফরিদ মিয়া করবে । সে খুবই কাজের ভূত । কাজ করা আর তেজপাতা গোনা তার কাছে একি কাজ । কবি গুন গুন করে গান ধরলেন ।

আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালবাসি।

চিরদিন তোমার আকাশ,
তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।

ঘটনাঃ ২

বাতাসে কেমন জানি গন্ধ আসছে । মরা পচার গন্ধ । কবি নাক কুচকালেন । নরেনকে ডাকলেন । ব্যাপার কি ? বোট তো নদীতে । এইখানে মরা পচার গন্ধ আসবে কি করে । কবির দুর্গন্ধ খুবই অপছন্দ ।
নরেন খোঁজ করে জানালো একটা লাশ নদীর মাঝখান দিয়ে ভেসে যাচ্ছে । কয়েকদিন আগেকার লাশ । পচে গেছে । নাম অজানা । এই লাশের উপর তার ভূত বসে আছে । মুখ গম্ভীর করে । গন্ধ সেই লাশ থেকে আসছে ।
কবি খুবই বিরক্ত হলেন । মরে গেছিস ভালো কথা । মানুষের শেষ পরিনতি মৃত্যু । কেউ আগে মরে কেউ পরে । এই নিয়ে চিন্তার কি আছে । কবি সেই ভুতকে ডাকতে বললেন । তিনি কথা বলবেন ।


ঘতনাঃ ৩

-তোমার নাম কি ?
-আমার নাম পঁচিশ , বাংলার ২৫ নম্বর ।
-এইটা কারো নাম হয় না কি ?
-কবিগুরু আমার কোন নাম নাই । মানুষ যখন ছিলাম তখন ছিল । এখন মনে নাই । মরার আগে আমাকে এই নাম্বার দেয়া হয়েছিলো ।
-হুম , মারা গেলে কি করে ? এক্সিডেন্ট ? এখন অবশ্য এই কারনে অনেক মানুষ মারা যায় ।
-না , এক্সিডেন্ট না । মেরে ফেলেছে ।
-নদীতে ভাসছ কেন ?
-ওরা আমাকে মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছে ।
-ঘটনা কি খুলে বল তো ।
-কবি গুরু ঘটনা খুবই দুঃখের । দুই তিন দিন আগে সন্ধ্যায় আমি বাড়ি ফিরছিলাম । আমার ছোট মেয়ে দই নিতে বলেছিল , তাই দই নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলাম । আমার ছোট মেয়ের নাম গিনি । ও বিড়াল পছন্দ করে , ওর বিড়ালের নাম মিনি ।
-বিড়ালের কাহিনী বাদ দাও । তোমার মারা যাওয়ার ঘটনা বল ।
-আমার বাড়ি যেতে হয় বড় রাস্তার উপর দিয়ে । আমি যখন বড় রাস্তার মোড় পার হচ্ছি তখন একটা গাড়ি আসলো । আমার সামনে দাঁড়ালো ।
-তার পর ?
-গাড়ীর কাচ কালো । কাঁচের একপাসে লেখা রেব । আমি তো ভয় পেলাম । বাঘে ধরলে এক ঘা , রেব এ ধরলে একশত ঘা । ইদানিং অবশ্য ভুয়া পরিচয়ে কিছু লোক ঘুরাঘুরি করে । মানুষকে ধরে নিয়ে যায় । এরা আসল না নকল আমি কিছুই বুজলাম না । আমাকে গাড়ীতে তুলে নিলো ।
-তার পর ?
-ওদের একজন বল্ল স্যার এইটার নাম্বার পঁচিশ । অন্যজন হাসলও । পরে আমার হাতের দই নিয়ে খেয়ে ফেললো । আমি ভাবলাম এরা তো মানুষ ভালো না । দই না নিয়ে গেলে মেয়েটা তো মন খারাপ করবে । মেয়ে খুবই জেদি । খাওয়া দাওয়া বন্ধ ।
-পরে তোমার কি হল ?
-পরে আর কি । ওরা আমাকে সহ কয়েকজনকে নদীর ধারে নিয়ে আসলো । তার পর ঢুস । কেল্লা ফতে । তখন থেকে আমি নদীর পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছি । গন্ধ বের হচ্ছে । কিচ্ছু করার নাই । সাতার জানি না । নদী পার হব কি করে ?

কবি কিছুই বললেন না । তিনি নরেন কে ডাকলেন । বললেন পঁচিশ নম্বর ভূতের খাতির যত্ন করতে । দুই পিচ রসগোল্লা খেতে দিতে বললেন । নরেন পঁচিশ নম্বরকে নিয়ে গেলো ।

ঘটনাঃ ৪

কবি এখন একা । ঠাণ্ডা বাতাস হচ্ছে । নদীর পানিতে মৃদু ঢেউ । এই ঢেউয়ে ঝিমুনি লাগে । কিছুক্ষণ পরে সভা শুরু হবে । এখন ঝিম ভাব আসলে চলবে না । এখন একটু খুশি খুশি থাকতে হবে । তবে তিনি খুশি থাকতে পারছেন না । তার মনটা খুব খারাপ লাগছে । কান্না পাচ্ছে । কবিদের কান্না করতে নেই । এইটা অশুভ কাজ । কবিরা সমাজের বিবেক । তারা কাঁদলে সমাজ সংস্কার করবে কে ? কবির কান্না পাচ্ছে পঁচিশ নম্বরের ভূতটার জন্য । বিনা কারনে ওরা মানুষটাকে মেরে ফেললো । মানুষটার মেয়েটার এখন কি অবস্থা । দই না খেয়ে মেয়েটা অবশ্যই তার পিতার উপর অভিমান করে বসে আছে । তার ঠোট ফুলে আছে । এই মেয়ে ফোলা ঠোট নিয়ে আমার সোনার বাংলা গাইবে কি করে । আহারে মেয়েটার কি কষ্ট । কষ্ট নিয়ে কি সঙ্গীত করা যায় ।
কবির মনে এখন কষ্ট হচ্ছে । কষ্ট নিয়ে তিনি সঙ্গীত করছেন ...............

"মা তোর বদন খানি মলিন হলে
আমি নয়ন
ও মা আমি নয়ন জলে ভাসি
সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালবাসি।"
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×