somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চশমিশ আর একটা পরীর গল্প (প্রথম পর্ব)

০১ লা এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এটা দুটো ছেলেমেয়ের গল্প। ধরা যাক মেয়েটার নাম জেরিন, আর ছেলেটার নাম ফারহান। ছেলেটা চশমা পড়ে, ঘরকুনো, সারাদিন গল্পের বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে। তাঁর ক্লাস করতে ভাল্লাগে না, পড়াশুনা করতে বোর লাগে, সবার সামনে ফোকাস হতে ভাল্লাগে না। তবে হ্যাঁ, তাঁর যে অল্প কিছু বন্ধু আছে তাঁদের সাথে আড্ডা দিতে তাঁর বেজায় ভালো লাগে। সোজা কথায় খুবই সাধারণ একটা ছেলে, আর দশজনের মধ্যে থাকলে চোখেই পড়বেনা ধরণের। জেরিন ফারহানের পুরো উল্টো। সে লেখাপড়ায় ভীষণ ভালো। তাঁর পাশাপাশি সে খুব ভালো গায়, ভালো আবৃত্তি করে। জেরিনের এক শিক্ষকের একটা কথা শুনলেই জেরিনের ব্যাপারে একটা হালকা পাতলা ধারণা পাওয়া যাবে - "রেহনুমা, You are a bright lady with a capital B". জ্বি হ্যাঁ, জেরিনের আসল নাম রেহনুমা। 'ভালো ছাত্রী' বললে আমাদের মাথায় একটা কমন চেহারা অনেক সময় ভাসে - চোখে ভারী চশমা, হাতে মোটা মোটা বই, কম কথা বলে, মানুষজনের সাথে তেমন মেশে না। নাহ্‌, এগুলোর কোনটাই জেরিনের মধ্যে নেই। সে মানুষের সাথে খুব সহজে মিশতে পারে, মজা করতে পারে, চারদিক মাতিয়ে রাখতে পারে। আবার সে ভীষণ সুন্দরীও। পরিচয় পর্ব শেষ, এখন আমরা আমাদের গল্প শুরু করি।

এক
ক্যান্টিন, লাঞ্চটাইম।

- "আজকে আমাদের ব্যাঙ কাটাইসে, জানিস?" রাফসান ফারহানকে বলে।
- "তাই?" ফারহান ছোট্ট করে জবাব দেয়।
- "ল্যাব থেকে বেরনোর আগে দেখি আমি যেটা কাটসিলাম সেইটা হাওয়া। তারপর তোর সাথে দেখা হওয়ার পর বুঝলাম ব্যাঙ সাহেবের আসলে কি হইসে। তোরে সেই ব্যাঙটা কেউ গিলায় দিসে। কি হইসে বল তো শালা? মুখ এমন পাঁচের মতো করে রাখছিস কেন?"
- "বলিস না, অ্যাসাইনমেন্ট দিসে।"
- "তো? আমরা তো আমজনতা। দশে পাঁচ, খুব হইলে ছয় পাওয়া পাবলিক। সাবমিশনের দুইদিন আগে নেটে বসবি, এক ট্যাবে গুগল দিয়ে সার্চ দিবি, আরেক ট্যাবে উইকিপিডিয়া দিয়ে দিবি। যার কেউ নাই তাঁর গুগল আছে।"
- "সমস্যা অন্য জায়গায় রে ভাই। গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট।"
- "আরো ভালো। এক গ্রুপে তো আর সবাই কাজ করে না। গ্রুপ তো আর কাবিখা প্রকল্প না যে কাজ করে খাইতে হবে।"
- "গ্রুপটা দুইজনের।" ফারহান উত্তর দেয়।
- "নাহ্‌ তাইলে এক আধটা ব্যাঙ তুই খেতে পারিস। কার সাথে পড়সে রে?"
- "আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্লের সাথে।" ফারহানকে আগের থেকেও বেজার দেখায়। "ওর সাথে কথা বলতে নিজেরে কেমন যেন মুর্খ লাগে। আমি তো বই ছুঁয়েও দেখি না।"
- "আহা! Holy inferiority complex. ছেলেটা কখনো সুন্দরী কোন মেয়ের সাথে মেশে নাই তো, তাই 'ভুই' পায়" রাফসান দাঁত কেলাতে কেলাতে উঠে দাঁড়ায়।
- "আমি বাঁচি না আমার প্যাঁড়ায়, আর উনি মজা নিচ্ছে। ঐ, কই যাস?"
- "ক্লাস আছে রে। মাত্র লাঞ্চ শেষ করলাম তো, এখন শেষের দিকের একটা বেঞ্চে শুয়ে ঝিমাবো। তুই বাসায় কখন যাবি?"
- "দেরী আছে। একটু পরে অ্যাসাইনমেন্টের কাজে জেরিনের সাথে বসতে হবে।"
- "মু-হু-হা-হা-হা। চামে চামে সুন্দর মেয়েদের ডিস্টার্ব করো, না?" বিশাল একটা হাসি দিয়ে রাফসান বেড়িয়ে যায়।

একটু পড়ে জেরিন আর ফারহান একসাথে বসে। ফারহান অবাক হয়ে লক্ষ্য করে মেয়েটার ব্যবহার মেয়েটার চেহারার মতোই অসাধারণ। মুখচোরা ফারহানের সাথে কীভাবে কীভাবে যেন খুব সহজেই মানিয়ে নেয়। সেমিনার রুম থেকে বেরনোর সময় ফারহান লক্ষ্য করে, একটা কেমন অদ্ভুত ভালোলাগায় ও আচ্ছন্ন হয়ে আছে, কেমন অপার্থিব একটা স্বর্গীয় অনুভূতি, ভালোলাগা ছাড়া আর কোন অনুভুতির কোন অস্তিত্ব নেই সেখানে। পড়ন্ত বিকেলে বাসায় যেতে যেতে ফারহান খেয়াল করে, ওর সবকিছু ভালো লাগছে, টি এস সির আড্ডার শব্দ, রিকশার টুংটুং, দুর থেকে ভেসে আসা বাসের হর্ন – সবকিছু, এমনকি রাফসানের খোঁচা দেয়া টেক্সটও - "ডেটে আপনার অনুভূতি কেমন ছিলো? ‘আমি বসে বসে ভাবি নিয়ে কম্পিত হৃদয়খানি’ টাইপ?"

এটাই মোটামুটি ফারহান আর জেরিনের পরিচয়ের গল্প। সময় গড়িয়ে চলে। ফারহান আর জেরিনের বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে গভীর হয়। নিজেদের ভালো সময় কি খারাপ সময় – সবসময়ই একজন আরেকজনের পাশে থেকেছে, বিপদে আপদে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে যে এতো ভালো বন্ধু হতে পারে, ওরা নিজেরা একজন আরেকজনের সাথে মেশার আগে আগে কখনো সেটা কল্পনাও করেনি।


দুই
একটা সময় ফাইনাল ইয়ার চলে আসে। ফারহান একদিন হুট করে খেয়াল করে, জেরিনের জন্য ওর মনে অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। জেরিনের সাথে দেখা হলে, কথা হলে, ওর কথা মনে পড়লে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে, ভালো লাগছে, আবার কেমন যেন একটু কষ্টও হচ্ছে। সারাদিন মনের ভেতর কেবল জেরিন আর জেরিন। কি হচ্ছে এসব? আগে তো এমন কখনো হয়নি! ফারহানের কেমন অশান্তি অশান্তি লাগে। এর মাঝেই একদিন ফারহান শায়লাকে ফোন করে। শায়লা, ফারহান আর রাফসানের সাথে স্কুলে পড়তো, ফারহানের অল্প কয়টা ভালো বন্ধুর একজন। তাঁর আরেকটা পরিচয় হচ্ছে সে রাফসানের প্রেমিকা।
- "হ্যালো, শ্যাওলা? কি করিস বুড়ি?" একটা কথা বলে রাখা ভালো, বন্ধুদের সাথে ফারহান যথেষ্টই বাঁচাল।
- "বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডদের রাত বারোটার সময় ফোন দিতে ইচ্ছা করে ফারু? নাকি তোমার জেরু আজকে ফোন ধরে নাই দেখে আমারে দিয়ে প্রক্সি দিতেসো?" শায়লার রসবোধও কম না।
- "থাপড়াবো ধইরা! লাগে আমি তোমারে জীবনে ফোন দেই না? ঝুটি!"
- "না, আপনার সব মূল্যবান সময় তো জেরিন ম্যাডামের জন্য, আমরা তো মাঝে মধ্যে ছিটেফোঁটা পাই। যাই হোক, এই সময়ে তো তুই যেহেতু তুই খুব বেশী ফোন করিস নাই, আমি ধরে নিচ্ছি কোন কাজে ফোন দিছিস।"
- "ওমা, ‘হাই ফারহান, হাউ আর ইউ ফারহান' না; সোজা কাজের কথা, না?"
- "তোর সাথে আমার ফরমালিটির সম্পর্ক স্কুলে থাকতেই শেষ হয়ে গেসিলো, রিমেমবার?"
- "ধুর! খালি প্যাঁচায়। যাই হোক, আসি, কাজের কথাতেই আসি। আমি না একটা অদ্ভুত প্যাঁচে পড়সি রে দোস্তো। তুই যেহেতু পাগলের ডাক্তার থুক্কু সাইকোলজির স্টুডেন্ট, ভাবলাম ফ্রিতে কিছু পরামর্শ নেই"
- "নে নে, ফ্রি নিয়ে নে। পাশ করলে ভিজিট ছাড়া চেম্বারে ঢুকতেই দিবো না।"

এরপর ফারহান জেরিনের ব্যাপারটা বিস্তারিত খুলে বলে, জেরিনের জন্য ওর নতুন অনুভূতিগুলো, নতুন ভালোলাগাগুলো, নতুন কষ্টগুলো। শায়লা মন দিয়ে সব কথা শোনে।
- “তো। সব শুনে তোর কি মনে হয়।” ফারহান জিজ্ঞেস করে।
- “অনেস্ট মন্তব্য চাস?”
- “না, তোর মিছা কথা শুনতে চাইসি দেখে এতক্ষণ ভ্যাজর ভ্যাজর করসি।”
- “অনেস্ট মন্তব্য হইলো, তুই একটা গাধা। তুই প্রেমে পড়ছিস রে ছাগল। অনেক আগেই পড়া উচিৎ ছিলো। তুই গন্ডার দেখে এতোদিনে বুঝছিস।” অন্যপ্রান্তে কোন সাড়াশব্দ নেই দেখে শায়লা আবার বলে, “কিরে হার্টফেল করলি নাকি?”
- “তুই এতক্ষণ যা যা বলছিস সেগুলা হজম করার চেষ্টা করতেসি। একটানে গাধা, ছাগল আর গণ্ডার বানায় দিছিস।”
- “এক বিন্দু ভুল বলি নাই সোনা। তুমি চাইলে আর দশজনকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো। আটজনই আমার সাথে একমত হবে। বাকি দুইটারে সাইকোথেরাপি দেওয়ার পর তাঁরাও আর আপত্তি করবে না। যাই হোক, প্রপোজ কবে করবি?”
- “আপা থামেন! একটা ধাক্কা সামলে নেই আগে”
- “দেরী করলে পস্তাবি কিন্তু। যতো ভালো দোস্তোই হোক, চুপ থাকলে কিন্তু এক সময় পাখি উড়ে যাবে।”
- “একটু চিন্তা করে নেই দোস্ত।”
টুকটাক দু-একটা কথার পর ফোন রেখে দেয় ওরা। ফোন রেখে ফারহান বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দূরের মেঘলা আকাশে হলদে চাঁদ উঠেছে, কালচে-রূপালি মেঘ খেলা করছে তাঁর আশেপাশে। কেমন যেন অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নিল একটা পরিবেশ। কাছের একটা ফ্ল্যাট থেকে এফ এম রেডিওতে বাপ্পা মজুমদারের গান ভেসে আসে
“দূরের মেঘে স্বপ্ন আঁকি
রাতের অধরে নীল জোনাকি
তোমায় দিলাম তুলে, দিলাম তুলে
জোছনা, বন আর রূপালি চাদর
মনের খুব কাছে আলতো আদর
দিলাম হৃদয় খুলে, দিলাম তুলে।”

শুনতে শুনতে কেমন যেন একটা অপার্থিব স্বপ্নালু অনুভূতি হয় ফারহানের। কেমন যেন একটা ভালোলাগার আবেশ, একটা ঘোর কাজ করে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:৩০
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

EU বাংলাদেশ, আফ্রিকা ও আরবদের সাহায্য করার চেষ্টা করে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১০ ই জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৩



EU বাংলাদেশকে বিবিধভাবে সাহায্য করে আসছে স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকে; বিশেষ করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গুলোকে সচল করার জন্য সহযোগীতা করতে চায়। আমাদের দেশে ও আফ্রিকায় ভালো যা ঘটছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে কোকের আতারোট শিল্প অঞ্চলের কারখানা: ফিলিস্তিনি স্টেইটহুড, স্বনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে অসমম্মান করে।

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১০ ই জুন, ২০২৪ রাত ১১:১৭

কোকা-কোলার পূর্ব জেরুজালেমের আতারোট শিল্প অঞ্চলের কারখানাটিকে ঘিরে শুরু থেকেই তীব্র বিতর্ক আছে। এই এলাকাটি আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের অধিকৃত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিপক্ক প্রেম: মানসিক শান্তি

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১১ ই জুন, ২০২৪ রাত ২:৩০






জীবনের নির্দিষ্ট একটি সময়ে পৌঁছানোর পর, মানুষ যখন পরিপক্ক হয়ে ওঠে, তখন প্রেমের মাপকাঠি বদলে যায়। তখন আর কেউ প্রেমে পড়ার জন্য শুধু সৌন্দর্য, উচ্ছ্বলতা, কিংবা সুগঠিত দেহ খোঁজে না।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রবীন্দ্রনাথের শেষ কটা দিন কেমন কেটেছিল?

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১১ ই জুন, ২০২৪ সকাল ১০:১১




১৯৪১ সালে জীবনের শেষ দিনগুলোয় অসুখে ভুগছিলেন কবি। সারা জীবন চিকিৎসকের কাঁচি থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছেন, এবার বুঝি আর তা সম্ভব নয়। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি চলছেই। কিন্তু কিছুতেই কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

অশুদ্ধ বেনজীরের ‘শুদ্ধাচার’ পুরস্কারের কী হবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১১ ই জুন, ২০২৪ সকাল ১১:১৭


যুক্তরাষ্ট্র যখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেনজীর আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, এর সাড়ে ছয় মাস পর সরকার তাঁকে মহিমান্বিত করেছে ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ দিয়ে। সেই হিসেবে বেনজীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×