somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পবলা গেরিলা

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়ার সাথে আমার প্রথম দেখা অফিসের লিফটে ! ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোন’ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ঠিকঠাক করতে এসেছেন । রাশভারী, বলিষ্ঠ, দাড়ি-গোঁফে ঢাকা মুখ । ভয়ে ভয়ে সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, আপনি ভাল আছেন ?’ হাসিমুখে উত্তর দিয়ে মাঝারি উচ্চতার মানুষটা নেমে গেলেন লিফট থেকে । পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিরক্ত মানুষটিকে বললাম, ইনিই বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া, ‘বিজয়ী হয়ে ফিরব নইল ফিরবই না’, ‘জনযুদ্ধের গনযোদ্ধা’ এই বইগুলো তাঁরই অস্ত্রধরা হাত থেকে বেরিয়েছে !


‘মুক্তিযুদ্ধের হাজারো গণযোদ্ধার একজন’ এভাবেই নিজেকে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন ‘জনযুদ্ধের গনযোদ্ধা’বইয়ের শুরুতে । ইতিহাসে যে যোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ থাকে একটি মাত্র বাক্য – ‘বাংলাদেশের ছাত্র কৃষক, জনতা, পেশাজীবী, শ্রেণীগোত্র নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন ।’ এরপর ইতিহাস এর চরিত্র হিসেবে বেছে নেয় ‘অল্প কিছু রাজনৈতিক নেতা, কিছু সামরিক ব্যক্তিত্ব, কিছু বুদ্ধিজীবী’-কে । এই বই (এবং মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়ার প্রায় সব বইই) তাই সেসব উপেক্ষিত, অনাদৃত পার্শ্বচরিত্রের মহানায়ক হয়ে ওঠার দলিল। এই বইয়ের নায়ক চোরাকারবারি তাজুল, মিরাশের মা, বোকা হাবিলদার রমিজ, ‘নষ্টা’ মেয়ে সায়রা, ১৪ বছরের বাচ্চু, ৭২ বছরের অহেদ কেরানি, রাখাইন মেয়ে প্রিনছা ! এই বই বিদেশী বন্ধু ঔডারল্যান্ড, মেঘ সিং এর অসামান্য অবদানের সামান্য স্বীকৃতি ।
অভিজ্ঞ চোরাকারবারি তাজুল তার ‘পেশাগত’ দক্ষতায় নিপুণতার সাথে সম্পন্ন করে রেকি, যুদ্ধের আকস্মিক পরিস্থিতেও ঘাবড়ায় না, তার এক কথা পরিস্থিতি যাই হোক, ‘যুদ্ধ না করে যুদ্ধ শেষ করবে না’। শান্তিবাহিন চেয়ারম্যান বাবা নিজ হ উপঢৌকন হিসেবে ক্যাম্পে রেখে আসেন সায়রাকে । তাঁর দিন কাটতে থাকে পশুদের রাতের খাবার হিসেবে । কিন্তু এই গ্লানিও দমিয়ে রাখতে পারে না সায়রাকে, সুনিপুণ গুপ্তচরের মত ঠিকঠিক খবর বের করে শত্রু অবস্থানের খবর জানিয়ে দিয়ে আসে মুক্তি বাহিনীকে । নিজের সর্বস্ব বিকিয়ে দিয়েও একইভাবে জিতে যায় রাখাইন মেয়ে প্রিনছা ! কোলের ছেলেকে সাথে নিয়েই মুক্তিবাহিনীর সাথে আঠার মত লেগে থাকে মিরাশের মা, তার অবিশ্রান্ত গুলিতে হতাহত পাকসেনাদের রক্তে লাল হয়ে যায় মগরা নদী! এই প্রাণশক্তি, এই প্রেরণার উৎপত্তি কোথায় ?
চা বাগানের কুলি হরি । সন্তানসম্ভবা কিশোরী বধূ ছাড়া আর কেউ নেই । তার উপর দায়িত্ব পড়েছে মুক্তিবাহিনীকে পথ দেখিয়ে শত্রুদলের কাছে নিয়ে যাওয়ার । রেইডের মাঝেই খবর আসে একটা মৃত সন্তান জন্ম দিয়ে মারা গেছে হরির বউ ! সর্বহারা হরি চোখ মুছতে মুছতে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় পালন করে তার শেষ কর্তব্য, তারপর হারিয়ে যায় ! খর্বাকৃতির জন্য মুক্তিবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দিতে পারেনা মহিউদ্দীন । নাছোড়বান্দা এই যোদ্ধা আড়াআড়ি শুয়ে পড়ে ক্যাপ্টেনের জিপের সামনে, বাহিনীতে ঢোকার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি বাতলে দেয় সে নিজেই, ‘স্যার, হাতে একটা গ্রেনেড দেন, শত্রুর বাঙ্কার দেখায় দেন । যে সাহস করে শত্রুর বাঙ্কার ধ্বংস করে ফিরে আসতে পারবে তাকেই ভর্তি করে নেন’ ! নির্বোধ? না তো কি? এই পরীক্ষার অবধারিত ফলালফল তো মৃত্যু ! বাধ্য হয়েই বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই কিশোরকে । ১৪ই ডিসেম্বর ভোরে সব পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাস করে চিরদিনের জন্য ময়দান ত্যাগ করে এই যোদ্ধা ! Job accomplished!
এই অসাধারণভাবে সাধারণ মানুষগুলো কিন্তু একেবারে অদৃশ্য নন । যুদ্ধের নাটকের শুরুতে তাদের নাম থাকে – ‘যুবক ১’, ‘যুবক ২’; সিনেমার credit line -এও ‘গ্রামবাসী’ বলে তাদের প্রাপ্য পাওনা তাদের বুঝিয়ে দেয়া হয় । তারপরও বারবার এই ‘তুচ্ছ’ ‘তুচ্ছ’গল্পগুলো আমাদের শোনান ২নং সেক্টরের যোদ্ধা কামরুল, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ইন্টার-পরীক্ষার্থী । তাঁকে দেখেই বুঝতে পারি তাঁর জীবনটা আটকে গেছে ওই ‘নয় মাসে’ । হাতে ধরে রাখা কলমটা মাঝে মাঝে খুব জোরে চেপে ধরেন, বুলেট বের হয় না যদিও ওটা থেকে ! তাঁর সহযোদ্ধা চোরাকারবারি তাজুল তার ‘পেশার’ প্রতি নিষ্ঠাবান থেকেছে শেষ পর্যন্ত – দেখেই বোঝা যায় খুব একটা ভাল নেই, মিরাশের-মা স্বামী, সন্তান সব হারিয়ে এখন মরমী ফকির, গ্রামছাড়া সায়রার নষ্ট হবার মত যৌবন ফুরিয়ে গেছে কবেই ! স্বীকৃতি পায়নি কিছুই, তবু মরে গিয়ে বেঁচে গেছে অহেদ কেরানি । যুদ্ধের প্রতিটি রাত ভাত বেড়ে বসে থাকতো যে গ্রাম্যবধূ তার অপেক্ষার পালা শেষ হল কিনা তা অবশ্য জানা নেই এই বইয়ের লেখকের !
যুদ্ধের পুরনো সত্য – ‘স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না’ এটা জেনে গেছেন আজন্ম যোদ্ধা কামরুল ! তাঁর সামনে বসে থাকা যুবকের জ্বলজ্বলে চোখ তাঁকে স্পর্শ করে কি করেনা, কথা বলতে বলতে তিনি তখন চলে গেছেন মুকুন্দপুর, প্রিয় রণাঙ্গনে ! তবুও না চাইলেও তাঁকে আবার ফিরে আসতে হয় এই নষ্ট সময়ে । সহযোদ্ধা তৈয়ব আলীকে যে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাঁকে যে বেঁচে থাকতেই হবে এই গল্পগুলো বলে যাবার জন্যে !
by Sheikh Nasir Uddin

বইয়ের নামঃ ‘জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা’
লেখকঃ মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া
প্রকাশকঃ Centre for Bangladesh Liberation War Studies
Click This Link
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সমাধান দিন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩১




সকালে কন্যা বলল তার কলিগরা ছবি দিচ্ছে রিকশাবিহীন রাস্তায় শিশু আর গার্জেনরা পায়ে হেটে যাচ্ছে । একটু বাদেই আবাসিক মোড় থেকে মিছিলের আওয়াজ । আজ রিকশাযাত্রীদের বেশ দুর্ভোগ পোয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নিছক স্বপ্ন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৮



©কাজী ফাতেমা ছবি
তারপর তুমি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠব
চোখ খুলে স্মিত হাসি তোমার ঠোঁটে
তুমি ভুলেই যাবে পিছনে ফেলে আসা সব গল্প,
সাদা পথে হেঁটে যাব আমরা কত সভ্যতা পিছনে ফেলে
কত সহজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদম চুপ. দেশে আওয়ামী উন্নয়ন হচ্ছে তো?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৯



টাকার দাম কমবে যতো ততোই এটিএম বুথে গ্রাহকরা বেশি টাকা তোলার লিমিট পাবে।
এরপর দেখা যাবে দু তিন জন গ্রাহক‍কেই চাহিদা মতো টাকা দিতে গেলে এটিএম খালি। সকলেই লাখ টাকা তুলবে।
তখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে গরু দুধ দেয় সেই গরু লাথি মারলেও ভাল।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:১৮


০,০,০,২,৩,৫,১৬, ৭,৮,৮,০,৩,৭,৮ কি ভাবছেন? এগুলো কিসের সংখ্যা জানেন কি? দু:খজনক হলেও সত্য যে, এগুলো আজকে ব্লগে আসা প্রথম পাতার ১৪ টি পোস্টের মন্তব্য। ৮,২৭,৯,১২,২২,৪০,৭১,৭১,১২১,৬৭,৯৪,১৯,৬৮, ৯৫,৯৯ এগুলো বিগত ২৪ ঘণ্টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×