somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামের ইতিহাসে জঙ্গিবাদের উদ্ভব - ২

০৮ ই এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৭:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আলী (রা.)-এঁর পক্ষ থেকে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) ও অন্য কয়েকজন সাহাবী খারিজীদের সামনে তাদের মতামদের বিভ্রান্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু অনেকেই তাদের উগ্রতা পরিত্যাগ করতে অসম্মত হয়। এর মূল কারণ ছিল, কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে নিজেদের পারঙ্গমতার বিষয়ে তাদের অহঙ্কার এবং নিজের চেয়ে অপরের সংশোধনের বিষয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করা। খারিজীদের কাউকে ব্যক্তিগত মত লালনে বা ব্যক্তিগত মতানুসারে ইবাদত বন্দেগী, ব্যক্তিজীবন বা পারিবারিক জীবন পালনে আলী (রা.) বা অন্য কোনো সাহাবী বা পরবর্তী শাসক ও আলিমগণ বাধা দেননি। রাষ্ট্র, শাসক বা জনগণের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বা আদেশ-নিশেষ করতেও কেউ তাদেরকে বাধা দেয়নি। কিন্তু এতে তারা পরিতৃপ্ত থাকেনি। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল অন্যান্যদের জীবনে তাদের মতো করে 'আল্লাহর দীন' বাস্তবায়ন করা। এজন্য দীন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তারা নিজেরা পাপের মধ্যে নিমজ্জিত হচ্ছিল। তাদের মানসিকতা ছিল, সমাজের অন্য মানুষের জীবনে 'দীন' প্রতিষ্ঠা না হলে বোধ হয় আমার নিজের দীন পালন মূল্যহীন হয়ে গেল। সাহাবীগণ তাদের এই বিভ্রান্তি সংশোধনের চেষ্টা করেন।

জিহাদ ব্যক্তিগত ফরয ইবাদত নয় যে, তা পরিত্যগ করলে গোনাহ হবে। বরং অনেক আয়াতে বিশৃঙ্খলা, ফিতনা বা হানাহানির সময়ে, আদেশ, নিষেধ, দাওয়াত ও জিহাদ পরিত্যাগের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। অন্যত্র পিতামাতার খেদমত বা আনুসঙ্গিক প্রয়োজনের জন্য জিহাদ পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র, সমাজ ও অন্য মানুষের জীবনে দীন প্রতিষ্ঠাকে নিজের ব্যক্তি জীবনে দীন প্রতিষ্ঠার মত একই পর্যায়ের ইবাদত বলে মনে করা, অথবা তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা উগ্রতা ও সন্ত্রাসের মূল কারণ। এই উগ্রতা বিভিন্ন বিভ্রান্তির পথে পরিচালিত করে, যেমন, অন্যান্য মুমিনের বা রাষ্ট্রের পাপ অন্যায় দূর করতে ব্যর্থ হয়ে তাদেরকে কাফির বলা, সমাজের মানুষদেরকে ঘৃণা করতে শুরু করা, জোর করে মানুষদেরকে সংশোধনের চেষ্টা করা, নিজের জীবনেআল্লাহর স্মরণে অবহেলা করা।

ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বকে নিয়ে সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা। তবে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য আছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাসহ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছাড়া সকল দেশের সকল সমাজের মানুষদের জন্য ধর্ম পালনের প্রশস্ততা রয়েছে। মুসলিম-অমুসলিম সকল দেশ ও সমাজে বসবাস করে একজন মুসলিম তার ধর্ম পালন করতে পারেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধর্ম পালনের জন্য শর্ত নয়। ইসলাম কোন শুধু রাষ্ট্র ব্যবস্থার নাম নয়। ইসলাম অনুসারী ব্যক্তি নিজ জীবনে ধর্মকে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে। পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যে কোনো ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যবস্থা লঙ্ঘিত হলে সুযোগ ও সাধ্যমত কুরআন নির্দেশিত উত্তম আচরণ দ্বারা খারাপ আচরণের প্রতিরোধ পদ্ধতিতে দাওয়াত, ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের মাধ্যমে তা সংশোধন ও পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন। এই চেষ্টা সফল না হলে মুমিনের দ্বীন-পালন ব্যাহত হয় বা সমাজ ও রাষ্ট্রের পাপের কারণে ব্যক্তি মুমিন পাপী হন এরূপ চিন্তা বিভ্রান্তিকর। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, 'হে মুমিনগণ, তোমাদের উপরে শুধু তোমাদের নিজেদেরই দায়িত্ব। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তাহলে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।' কাজেই সমাজ পরিবর্তনের আগ্রহে কোনো মানুষের জান, মাল, সম্মান ইত্যাদির ক্ষতি করা চরম বিভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়।

জিহাদের অনেক শর্ত রয়েছে, সেগুলোর অন্যতম যে, জিহাদ শুধু যুদ্ধরত কাফিরের বিরুদ্ধেই হবে। ভুল জিহাদে কোনো মুসলিমকে হত্যা করার চেয়ে, সঠিক জিহাদ থেকে বিরত থাকা উত্তম। মুসলিম যতক্ষণ দীন পালনের নিরাপত্তা ভোগ করছেন ততক্ষণ ফিতনা দূরীভূত করার নামে যুদ্ধ করার সুযোগ নেই বরং দাওয়াত, আদেশ, নিষেধ ইত্যাদির মাধ্যমে সমস্যা দূর করার চেষ্টা করতে হবে। যে সকল সাহাবী খারিজীদের বুঝাতে চেষ্টা করেন তাঁদের একজন জুনদুব ইবনু আব্দুল্লাহ (৬০ হি) একবার খারিজীদের কতিপয় নেতাকে ডেকে বলেন, রাসুলাল্লাহ বলেছেন, 'যে ব্যক্তি কাঠিন্য বা উগ্রতার পথ অবলম্বন করবে আল্লাহও তার জন্য কাঠিন্য বা উগ্রতার পথ অবলম্বন করবেন। কেউ যদি কোনো মানুষের হাতের তালুতে রাখার মত সামান্য রক্তও প্রবাহিত করে তবে সেই রক্ত তার ও জান্নাতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে কাজেই যদি কেউ পারে এইরূপ রক্তপাত থেকে আত্মরক্ষা করতে, তবে সে যেন আত্মরক্ষা করে। কিন্তু তারা উগ্রতার পথ পরিহার করেনি।

সালাত, সিয়াম ইত্যাদি ইবাদতের মত ইবাদত নয় জিহাদ। এ সকল ইবাদত যদি কোনো কারণে ভুল হয় তবে তাতে ইবাদতকারী কঠিন পাপের মধ্যে নিপতিত হয় না। কিন্তু জিহাদের নামে একজন নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করলে কঠিন পাপের মধ্যে নিমজ্জিত হতে হয় এবং সকল পুন্য বরবাদ হয়ে যায়। জিহাদের নামে ভুল মানুষকে হত্যা করার চেয়ে জিহাদ না করা অনেক ভাল। পক্ষান্তরে সাধারণভাবে আজীবন জিহাদ না করলেও এইরূপ শাস্তিলাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। জিহাদ বর্জন করলে কোনোরূপ গোনাহ হবে বলে কুরআনের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। এখানে লক্ষণীয় যে, খারেজীদেরকে বুঝানোর পরও তারা উগ্রতা ত্যাগ করলো না কারণ তাদের মধ্যে সন্ত্রাসের মাধ্যমে নেতৃত্ব, ক্ষমতা, সম্পদ ও অন্যান্য জাগতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যও ছিল।

ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ ও ফিতনা বা সন্ত্রাসের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এই যে, জিহাদ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধ এবং ফিতনা বা সন্ত্রাস ব্যক্তি বা গোষ্ঠি পরিচালিত যুদ্ধ। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুসারে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের রাষ্টপ্রধানের নির্দেশে ও নেতৃত্বেই জিহাদ পরিচালিত হবে। খারিজীগণ বিষয়টিকে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠিগত পর্যায়ে নিয়ে এসে সন্ত্রাসের জন্ম দেয়। বস্তুত, হত্যা, বিচার, শক্তি প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয় যদি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত না হয় তবে তা ফিতনার মহাদ্বার উন্মোচন করে। পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষই অন্য কোনো না কোনো মানুষের দৃষ্টিতে অন্যায়কারী ও অপরাধী। প্রত্যেক ব্যক্তি বা গোষ্ঠি যদি নিজের মতমত বিচার, যুদ্ধ ও শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে তবে তার চেয়ে বড় ফিতনা আর কিছুই হতে পারে না।

ইসলামের নামে বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- রোধ করতে সন্ত্রাসীদের বিভ্রান্তির স্বরূপ উদ্ঘাটন অতীব জরুরি। যে কোনো যুগে ও সমাজে ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রচার করতে এই একই বিভ্রান্তির উপর নির্ভর করা হয়। ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাস উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই হোক, ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই হোক, অথবা ইসলাম প্রতিষ্ঠার আবেগ ও উন্মাদনার কারণেই হোক, ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনার জন্য খারিজীদের বিভ্রান্তিকর মতগুলো নিত্য নতুন পোষাকে উপস্থাপন করার ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। এজন্য আমরা খারেজীদেরর মতামতগুলি কুরআনের আলোকে পর্যালোচনা করবো।

প্রথমত, নিঃসন্দেহে কুরআন ইসলামী জ্ঞানের মূল উৎস এবং প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব নিজে কুরআন অধ্যয়ন করে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সকল মুসলিম কুরআন অধ্যয়ন করবেন, কিন্তু সকল মুসলিমই বিশেষজ্ঞ হবেন না। প্রত্যেক মুমিন নিজ জীবনের পাথেয় হিসেবে কুরআন অধ্যয়ন করবেন। কিন্তু জটিল সমস্যার ক্ষেত্রে সমকালীন প্রাজ্ঞ আলিমগণের মতামত গ্রহণের পাশাপাশি পূর্ববর্তী প্রখ্যাত আলিম, ফকীহ ও ইমামদের মতামতের অনুসন্ধান ও তাদের মতামতের আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এই মূলনীতি লঙ্ঘন করার কারণেই সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয়। খারিজীগণ সাহাবীগণের এবং তাঁদের পরে সমাজের মূলধারার আলিমগণের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। নিজেদের মতামতকেই তারা চূড়ান্ত বলে মনে করেছে। ফলে তারা বিভ্রান্তির অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×