somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাওরে.....

০৮ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ডিমের কুসুমরাঙ্গা একরাশ পানি সরিয়ে সবে উঁকি মেরেছে। সেই আগুন রাঙ্গা পানিতে অসংখ্য মাছ ধরা নৌকায় সাত সকাল থেকেই জাল টানার ব্যাসততা । সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখে সকালের নরম ভিজে আলোয় এ এক অসাধারন রোম্যান্টিক দৃশ্য। টাঙ্গুয়া হাওরের যে মুল্লুকেই যাওয়া হোক না কেন, এমন রোম্যান্টিক সূর্যোদয়ের মুখোমুখি হতে হয় বার বার।
ঈদ এর পর দল বেধে ঘুরতে যাওয়া 'ভ্রমণ বাংলাদেশ' এর ট্রেডিশনে পরিনত হয়েছে। কিন্তু এবারের ঈদ বর্ষার ঠিক মাঝামাঝি হওয়াতে কোথায় যাওয়া যায় এ নিয়ে একটু দোটানায় পরতে হল। পাহাড় না পানি? শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের ডাক উপেক্ষা করে, পানির টানে আমরা ছুটে চলেছি 'টাঙ্গুয়া হাওরে'।
হাওর! নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চারদিকে বিশাল জলরাশি। কূল নেই, কিনারা নেই। শুধু পানি আর পানি।

বাতাসের তীব্র বেগের তালে তালে হাওর একেক সময় একেক রূপ ধারণ করে। হাওরের পানি কখনো গ্রামের সদ্য বিবাহিতা লাজুক নববধূর মতো শান্ত, আবার কখনো বা চঞ্চল কিশোরীর মতো দুরন্ত।
১৬ তারিখ সকালে সুনামগঞ্জে নাস্তা সেরে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমরা রওনা হলাম তাহিরপুরের উদ্দেশে। বৈঠাভাঙ্গা ঘাট পার হয়ে লেগুনায় চড়ে আমরা যখন তাহিরপুর পৌঁছলাম তখন প্রায় ১২ টা। হাবিব সারওয়ার ভাই আমাদের জন্য নৌকা রেডি করে অপেক্ষা করছেন সেই সকাল থেকে। দুপুর হয়ে যাওয়াতে আমরা দুপুরের খাবার সেরেই হাওরে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। খাবার শেষ করেই টাঙ্গুয়া হাওরের প্রবেশদ্বার খ্যাত পাটলাই নদী দিয়ে আমরা ঢুকে গেলাম হাওরের মূল অংশে। অপূর্ব সে দৃশ্য। দু'পাশের হিজল করচের পাতা বাতাসে দুলে দুলে যেন আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে। চারদিকের বিশাল জলরাশি যেন মিশে গেছে দূর নীলিমায়।
টাঙ্গুয়া হাওর মূলত সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার দশটি মৌজা নিয়ে বিস্তৃত। প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই হাওরে ছোট-বড় ১২০ টি বিল আছে। প্রতি বছর এ হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে। ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভয়চর প্রাণী নিয়ে জীব বৈচিত্রে ভরপুর এই টাঙ্গুয়া হাওর।
টাঙ্গুয়া হাওরে ঢোকা মাত্রই চারদিকের দৃশ্যপট কেমন জানি বদলে গেল। বিশাল জলরাশির বুকে ছোট ছোট মাছ ধরা নৌকা, মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে নিজেদের অস্তিত্ব জানিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। আমরা অপলক দৃষ্টিতে টাঙ্গুয়ার পূর্ণ যৌবন উপভোগ করছি। দলের সবাই যার যার মতো ছবি তুলতে ব্যস্ত। কেউ কেউ আবার আয়েশি ভঙ্গিতে উপভোগ করছে চারদিকের অপার সৌন্দর্য। হাওরের স্বচ্ছ পানি দেখে এতে জলকেলি করার লোভ সামলায় এমন সাধ্য কার? আমরা মাঝিকে অনুরোধ করলাম সুবিধামত একটি জায়গায় নৌকা ভিড়াতে। বেশ খানিকটা এগিয়ে চমৎকার এক জায়গায় মাঝি নৌকা ভিড়াতেই আমরা নেমে পড়লাম পানিতে।

ছোট্ট শিশুর মতো সবাই মিলে পানিতে দাপাদাপি করলাম প্রায় ঘণ্টাখানেক। আমাদের নৌকা আবার ছুটে চলেছে। আমাদের এবারের গন্তব্য টাঙ্গুয়া হাওরের কোলে পাহাড়ের গা ঘেঁসে গড়ে ওঠা ছোট্ট এক জনপদ ট্যাঁকেরঘাট।
বিকেলে সূর্যের সোনালী আলোর প্রতিফলনে টাঙ্গুয়ার পানিতে যেন আগুন ধরে গেছে। এ যেন এক অবাক দৃশ্য। ট্রলারের শব্দে কয়েকটা সাদা বক পাশের একটি হিজল গাছ থেকে উড়ে দূরের একটি করচ গাছে গিয়ে বসল। আমাদের ঠিক সোজাসুজি নীল আকাশের সাথে পাহাড় যেন মিতালি পেতেছে। দিগন্তের নীল আকাশ আর স্বচ্ছ পানি যেন মিলেমিশে একাকার। এদিকে রুমা আপু, ইতি আপু, তুহিন ভাই, সুমন ভাই ঝালমুড়ি বানাতে ব্যস্ত। ঝালমুড়ি খেতে খেতে টাঙ্গুয়ার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ভাবুক হয়ে গেলাম। এই সৌন্দর্য শুধু দেখলে হয় না, অনুভবও করতে হয়। সন্ধ্যার একটু আগে ট্যাঁকেরঘাটে আমাদের নৌকা ভিড়ল।

নৌকা থেকে নেমে সবাই হাটা ধরলাম বাজারের দিকে। এখানকার একমাত্র প্রাইভেট গেস্ট হাউজে মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা করা হল। ছেলেদের ইচ্ছা নৌকায় রাত কাটাবার। হোটেলে জম্পেশ একটা আড্ডা দিয়ে আমরা চলে এলাম নৌকায়। রাতের অন্ধকার ভেদ করে অসংখ্য নক্ষত্র মিটমিট করে জ্বলছে ওই দূর আকাশে। মনে হয় একটু জোরে বাতাস বইতে শুরু করলে নিমিষেই নিভে যাবে আকাশের ওই মিটিমিটি আলোর নক্ষত্রগুলো!
রাতের হাওর দেখার মজাই আলাদা। চারদিকে যেন কোন যুবতীর ঘন কালো চুলের মতো মাদকতাময় ভরপুর আঁধার। রাত দ্রুত বেড়ে চলল। গান আর আড্ডা চলল সমানতালে। ধীরে ধীরে মেঘ এসে তারার রাজত্বের দখল নিল। একটু পর শুরু হল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আমাদের আসর ভাঙ্গল। নৌকার ছইয়ের ভিতরে ঢুকে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ট্যাঁকেরঘাটের ভোর হয় পাখির ডাকে। চেনা অচেনা হরেক পাখির মিলিত কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মেঘালয়ের পাহাড় ঠেলে পূব আকাশে উকি মারে দিনমণি। হাওরের শান্ত সবুজ পানি লাল রঙ ধারণ করে। সামনের বিশাল প্রাকৃতিক ক্যানভাসে অনায়াসে আঁকা হয়ে যায় কত কত মাস্টারপিস।


নাস্তা সেরে সকালের নরম রোদ গায়ে মেখে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম বারেক টিলার উদ্দেশ্যে। অদ্ভুত সুন্দর পাহাড় ঘেরা যাদুকাটা নদী বয়ে চলেছে তরতর করে। নদী-পাহার-আকাশ যেন মিলেমিশে একাকার। ঘড়ি বলছে আমাদের ফিরতে হবে। অসংখ্য মাছধরা জালের গলকধাঁধা কাটিয়ে আমাদের ট্রলার ফিরে চলেছে সুনামগঞ্জের পথে। পিছনের পথ অতীতে মিশে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। স্মৃতির পাতায় যুক্ত হয় আরও একটি নতুন অধ্যায়।

৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×