somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিরাজ সিকদার --- বাংলাদেশের চে গুয়েভারা ।

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১০:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কমরেড সিরাজ সিকদার ছয়টি বিষয়কে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এটাই তার বিখ্যাত ‘ছয় পাহাড়ের দালাল’ তত্ত্ব। এই ছয় পাহাড়ের দালাল বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন, সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ এবং পূর্ববাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ। এই ছয় পাহাড়ের প্রতিনিধি তাঁর মতে, আওয়ামী লীগ, মস্কোপন্থী ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের সংগঠনগুলো। এ জন্য চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হোন, আত্মবলিদানে নির্ভয় হোন, সমস্ত বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে বিজয় অর্জন করুন’—কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে কর্মীদের নির্দেশ দেন—
ক) গ্রামে গ্রামে গেরিলা যুদ্ধ গড়ে তুলুন।
খ) শেখ মুজিব ও তার সাগরেদদের চক্রান্ত খতম করুন।
গ) ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ নিপাত যাক।
ঘ) সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক।
ঙ) মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক।
এক কথায়, বাংলাদেশের শত্রুদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন কমরেড সিরাজ সিকদার। বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণের মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, দেশপ্রেমিক, বিপ্লবী সমাজ নির্মাণের স্বাপ্নিক এবং মাওবাদী কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রধান পথিকৃত এই তুমুল আলোচিত মানুষটি সম্পর্কে মনীষী আহমদ শরীফ বলেন, ‘সিরাজ সিকদার আজ আর কোনো ব্যক্তির নাম নয়, সিরাজ সিকদার সংকল্পের, একটি সংগ্রামের, একটি আদর্শের, একটি লক্ষ্যের ও ইতিহাসের একটি নাম।’
তারপর তার আফসোস, ‘গণমানুষের দুঃখ ঘুচানোর জন্যই তিনি নিশ্চিন্ত আরামের নিশ্চিত জীবনের স্বস্তি-সুখ স্বেচ্ছায় পরিহার করে জেল-জুলুম-নির্যাতন-লাঞ্ছনার ও মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেবুঝে বরণ করেছিলেন। এ মানবতাবাদী সাম্যবাদী নেতাকে হাতে পেয়েই প্রচণ্ড প্রতাপ শঙ্কিত সরকার বিনা বিচারে খুন করল, সেদিন ভীতত্রস্ত আমরা তার জন্য প্রকাশ্যে আহা শব্দটি উচ্চারণ করতেও সাহস পাইনি। সে গ্লানিবোধ এখনও কাঁটার মতো বুকে বিঁধে। যদিও সেদিন জানতাম যে, এমন দিন শিগিগর আসবে, যখন সিরাজ সিকদারের কবরে নির্মিত হবে স্মারক মিনার—সমাধিসৌধ আর হন্তারকদের জংলাকীর্ণ গোরে আশ্রয় হবে ফের।’
সবশেষে তিনি তরুণদের প্রতি জানান উদাত্ত আহ্বান, ‘তরুণরা সিরাজ সিকদারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হোক, দেশের গণমানব বিপ্লব আসন্ন করে তুলুক।’
সিরাজ সিকদার গ্রেফতার হন ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি। আর তাকে হত্যা করা হয ২ জানুয়ারি। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক হেফাজতেই তার ওপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। নির্যাতন করে কথা আদায় করতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ শুরু করে জিজ্ঞাসাবাদ। যথার্থ বীরের মতোই ছিল তার জবাব। তাকে বলা হয়, আপনি জানেন, আপনার পরিণতি কী?
সিরাজ সিকদার অকম্পিত কণ্ঠে জবাব দেন, ‘আমি জানি, একজন দেশপ্রেমিকের পরিণতি কী হতে পারে তা ভালোভাবেই আমার জানা আছে।’
—আমরা আপনাকে শেখ সাহেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলব।
স্পষ্ট উচ্চারণে সিরাজ সিকদারের জবাব ছিল, ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতকের কাছে একজন দেশপ্রেমিক ক্ষমা চাইতে পারে না।’
বলা হয়, ‘তাহলে আপনাকে মৃত্যুকেই বরণ করতে হবে।’
দ্বিধাহীন, ভয়হীন কণ্ঠে সিরাজ সিকদারের জবাব, ‘সে মৃত্যুকেই আমি গ্রহণ করব, সে মৃত্যু দেশের জন্য মৃত্যু, গৌরবের মৃত্যু।’
এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে। রাত তখন সাড়ে দশটা। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সিরাজ সিকদারকে দাঁড় করানো হয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর সামনে। শেখ মুজিবের সঙ্গে সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন (এজাহার থেকে প্রাপ্ত) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, শেখ মুজিবের বড় ছেলে শেখ কামাল, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির মতো প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনরা।
প্রধানমন্ত্রী তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেই প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সময় যথার্থ বীরের মতোই সিরাজ সিকদার প্রশ্ন করেন, ‘রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাউকে বসতে বলার সৌজন্যবোধ কি আপনার নেই?’
সে সময় এসপি মাহবুব ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি এগিয়ে এসে রিভলবারের বাঁট দিয়ে পেছন থেকে সিরাজ সিকদারের মাথায় আঘাত করেন। সিরাজ সিকদার মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। অন্যরা তার ওপর কিল, চড়, ঘুষি ও লাথি মারতে থাকে। তারপর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, মনসুর আলী এবং অন্যরা সিরাজ সিকদারকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং এসপি মাহবুব উদ্দিন আহমদ নির্দেশ দেন। মাহবুব উদ্দিন অন্য আসামিদের সঙ্গে বন্দি সিরাজ সিকদারকে শেরেবাংলা নগর রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে যান। সেখানে তার ওপর আরও নির্যাতন চালানো হয় এবং ২ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে রক্ষীবাহিনী সদর দফতরেই সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পূর্ব পরিকল্পনামত পুলিশ বন্দি অবস্থায় নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ সাভারের তালবাগ এলাকা হয়ে সাভার থানায় নিয়ে যায়। সাভার থানা পুলিশ পরের দিন ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে।
অথচ পরদিন পুলিশের প্রেসনোটে বলা হয়, ‘গ্রেফতারের পর পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে সিরাজ সিকদার নিহত।’
ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, গুপ্তহত্যা বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে পুলিশের প্রথম সাফাই।
তো সিরাজ সিকদার আলেকজান্ডারের সামনে বন্দি পুরু যা বলেছিল সেরকমই কিছু কথা বলেছিলেন। কিন্তু ভুল হয়েছিল সিরাজ সিকদারের। কারণ তার সামনের মানুষটি বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার ছিলেন না। ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।
ভারতের নকশালবাড়ী কৃষক আন্দোলন খ্যাত নেতা কমরেড চারু মজুমদারকেও হত্যা করা হয়েছিল পুলিশ হেফাজতে। তাকে হত্যা করার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে চারু বাবু সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি ছিলেন একজন মহান দেশপ্রেমিক।’
আর কমরেড সিরাজ সিকদারকে হত্যার পর তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে সদম্ভে ঘোষণা করেন, ‘কোথায় তোদের সিরাজ সিকদার’। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি সিরাজ সিকদার হত্যার সব দায়দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে তুলে নেন। তাছাড়া দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, ‘জাতির পিতা’ হিসেবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের একজন নেতা সম্পর্কে এ ধরনের বক্তব্য ছিল দুর্ভাগ্যজনক।
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে শেখ মুজিবের এখানেই পার্থক্য। এখানেই পার্থক্য বুর্জোয়া পার্টির নেতৃত্বের সঙ্গে পেটি বুর্জোয়া পার্টি নেতৃত্বের।
দুই
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সম্মানিত সদস্য সাবেক মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হান্নান শাহের বক্তৃতা শুনে বহুদিন পর প্রাণ খুলে হাসলাম। তিনি গত ২ জানুয়ারি এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সিরাজ সিকদার হত্যার বিচার করবে।’
১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর খুব জোরেশোরে দাবি ওঠে, সিরাজ সিকদার হত্যার বিচারের। সিরাজ সিকদারের পিতা আবদুর রাজ্জাক সিকদার দাবি তোলেন, একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি বিচার তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন। ১৯৭৮-এর দিকে এই দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়। প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতাকে সাংবাদিক সম্মেলনে জবাব দিতে হয় এ প্রশ্নের। জনসভাগুলোতে ব্যাখ্যা করতে হয় পরিস্থিতি। ১৯৭৮ সালে এ প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেছিলেন, ‘আইন তার নিজস্ব পথ বেছে নেবে।’
সে সময় গণদাবি উঠেছিল শ্বেতপত্র প্রকাশের। ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মেনিফেস্টোতে বিএনপি অঙ্গীকার করেছিল সিরাজ সিকদারসহ আওয়ামী দুঃশাসনে সংঘটিত ৪০ হাজার রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার করবে।
মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু বিচার তো দূরের কথা, একটা তদন্ত পর্যন্ত করার কথা ভুলে গিয়েছিল ক্ষমতাসীনরা।
বেগম খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯২ সালে সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর ১৭ বছর পর ১৯৯২ সালের ৪ জনু সিরাজ সিকদার গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান শেখ মহিউদ্দিন আহমদ ও মহাসচিব নাজমুল ইসলাম সাইদ ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করেন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার ও হত্যার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দেয়া হয় ওই আর্জিতে। ওই মামলায় আসামি করা হয় সাবেক পুলিশ সুপার মাহবুবউদ্দিন আহমদ, আবদুর রাজ্জাক এমপি, তোফায়েল আহমদ এমপি, সাবেক আইজি ইএ চৌধুরী, সাবেক রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক কর্নেল (অব.) নুরুজ্জামান, মোহাম্মদ নাসিম এমপি গংদের।
আর্জিতে বলা হয়, আসামিরা মরহুম শেখ মুজিবের সঙ্গী ও অধীনস্থ কর্মী থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও শলা-পরামর্শে অংশগ্রহণ করতেন এবং ১নং থেকে ৬নং আসামি তত্কালীন সময়ে সরকারের উচ্চপদে থেকে অন্য ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের সঙ্গে শেখ মুজিবের সিরাজ সিকদার হত্যর নীলনকশায় অংশগ্রহণ করেন।
এই মামলার একবারের জন্যও কোনো শুনানি হয়নি। আজ পর্যন্ত জানা যায়নি মামলাটি শেষ পর্যন্ত কবর চাপা পড়ল কেন?
এভাবে একের পর এক বল মিস করে করে এখন ম্যাচ মিসের পর্যায়ে পৌঁছেছে বিএনপি। এখন যখন দেশ পুরোপুরি আক্রান্ত, আমরা ‘জান বাঁচাবো না দেশ বাঁচাবো’ পর্যায়ে উপনীত, সেই সময় ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহর বিচারের ওয়াদা নিদারুণ তামাশার মতো। আমাদের মৃত নদীগুলোর বুকে দগদগে ঘায়ের ওপর জেগে থাকা বালুকার স্তূপে গরম বাতাস দেয়ার মতো অর্থহীন।
তিন
কমরেড সিরাজ সিকদারের দেশপ্রেম ও গণমানুষের চাহিদা সম্পর্কে উপলব্ধি ছিল বিস্ময়করভাবে অনন্য সাধারণ। সময়কে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে তার বিচক্ষণতা এবং কর্তব্যকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়া সম্পর্কে তার দৃঢ়তাও ছিল নজিরবিহীন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও পাকিস্তানি শাসক শ্রেণীর সংঘাত যখন অনিবার্য হয়ে পড়ে, তারও ৫৩ দিন আগে ৮ জানুয়ারি সিরাজ সিকদার ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েম করুন’ শিরোনামে যে আহ্বান জানান, তাতে বলা হয়, ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, একটি স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে রূপ দিন। স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন।’ বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের গেরিলারা সাফল্যজনকভাবে পূর্ব বাংলার বুকে সর্বপ্রথম সূর্যসেনের দেশ চট্টলায় এবং সন্ন্যাসী বিদ্রোহের দেশ ময়মনসিংহে জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধের সূচনা করেছে এবং বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে।
বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী, আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জনগণের সশস্ত্র সংগ্রাম কিছুতেই দাবিয়ে রাখতে পারবে না। ১৯৭০-এ পূর্ব বাংলার জনগণের যে গণযুদ্ধ শুরু হয়েছে তা দাবানলের রূপ নেবে ১৯৭১-এ।’
অর্থাত্ আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর বহু আগে সিরাজ সিকদার তার শ্রমিক আন্দোলনের কমরেডদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘গেরিলা বাহিনী’। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি আজও ছাই চাপাই পড়ে আছে। আরেকটি বিষয় দেখার, ১৯৭১-এ যে সর্বাঙ্গীণ যুদ্ধ শুরু হবে তাও আমাদের কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে সিরাজ সিকদারই প্রথম অনুভব করেছিলেন। সেজন্যই তার গেরিলা বাহিনী শুরু করে দিয়েছিল যুদ্ধ। সে জন্যই ১৯৭১-এর ১ মার্চের পর মাও সে তুঙের জাপান বিরোধী যুদ্ধে চিয়াং কাই শেকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মতো তিনি শেখ মুজিবকে খোলা চিঠি লেখেন। পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জনের জন্য দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের জন্য প্রকাশ্য-গোপন সব দেশপ্রেমিক পার্টি, গোষ্ঠী, ধর্মীয় ভাষাগত ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে ‘পূর্ব বাংলা প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী বিপ্লবী কোয়ালিশন সরকার’ গঠন এবং একটি ‘জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট’ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তার আহ্বান শেখ মুজিব কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলো।
তারপর ঘটলো ২৫ মার্চের ভয়াবহ ঘটনা। শেখ মুজিব পাকিস্তান বাহিনীর কাছে ধরা দিলো। দেশজুড়ে চলল গণহত্যা। ২৭ মার্চ এল মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা। ১৭ এপ্রিল ভারতে গঠিত হলো প্রবাসী মুজিবনগর সরকার।
সিরাজ সিকদার ভারতের সাহায্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করাকে কোনোভাবেই সঙ্গত মনে করেননি। তার মতে, এটা হবে বিষধর সাপের দংশন থেকে বাঁচার জন্য হিংস্র বাঘের থাবার নিচে আশ্রয় নেয়ার মতো। তিনি দেশের ভেতরে থেকেই পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। বরিশালের পেয়ারা বাগান পরিণত হলো রণক্ষেত্রে। ৩ জুন তিনি শ্রমিক আন্দোলনকে ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’তে রূপান্তরিত করলেন। এখানে আরও বিষয় অনুধাবনের আছে। হক-তোয়াহা-মতিন-আলাউদ্দিন এবং দেবেন সিকদারের নেতৃত্বে সেই সময়কার সব কমিউনিস্ট পার্টি যখন মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সেই সময় এদেশের একমাত্র কমরেড সিরাজ সিকদার যিনি পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সব মুক্তিযোদ্ধাকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগ এ আবেদনকেও প্রত্যাখ্যান করে।
১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসেই কমরেড সিরাজ সিকদার পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তা ভারতের কলোনিতে পরিণত হবে। এ জন্যই ১৯৭২ সালে তিনি ঘোষণা করেন, পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে, ভারতের উপনিবেশ হওয়ার জন্য নয়। এ জন্যই সিরাজ সিকদার আবারও সৃজনশীলতার পরিচয় দেন। হক-তোয়াহা-মতিন-আলাউদ্দিন-দেবেন সিকদারদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ১৬ ডিসেম্বরের পর ঘোষণা করেন সামন্তবাদই বাংলাদেশের প্রধান শত্রু। এরপর তারা শ্রেণী শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রামের জোতদার, মধ্যবিত্ত চাষীদের। সিরাজ সিকদার এ সিদ্ধান্তকে ভুল আখ্যায়িত করে বলেন, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এবং তাদের দালালরাই দেশের প্রধান শত্রু। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের জনধিকৃত নেতা ও কর্মীদের হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার সংগ্রাম শুরু করেন। বিপুল জনপ্রিয়তায় সিক্ত সর্বহারা পার্টির গেরিলারা এ সময় থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে মুজিব শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দেয়।
১৯৭৪ সালে পূর্ব বাংলার নিপীড়িত জনগণের উদ্দেশে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ও পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর জরুরি আহ্বানে সিরাজ সিকদার বলেন, ‘বাঙালি জাতি এবং পূর্ব বাংলার জনগণের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উত্খাত করে দুর্ভিক্ষ পীড়িত জনগণকে বাঁচান। ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর অর্ধদিবস হরতাল পালন করুন। খাদ্য, বস্ত্র, চিকিত্সা, শিক্ষা, চাকরি, বাসস্থানের ব্যবস্থা করুন। শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র কায়েম করুন।’
একই বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক’ ও তাদের প্রভু ভারতের নিষ্ঠুর শোষণ লুন্ঠনের ফলে পূর্ব বাংলায় আজ ইতিহাসের চরমতম সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। সমগ্র দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। ‘আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকরা কালোবাজারি, রাহাজানি, মজুতদারি, লাইসেন্স পারমিটের দৌলতে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। এ নিষ্ঠুর বিশ্বাসঘাতকরা এখনও ভারতে খাদ্য পাচার করছে, কালোবাজারি, মজুতদারি, চোরাচালানি করে প্রতিদিনই খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়াচ্ছে। এভাবে তারা কালো টাকা ও সম্পদের পাহাড় গড়ছে।’
প্রতিটি এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে ওই বিবৃতির এক স্থানে তিনি বলেন, ‘১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের ঢাকাসহ পূর্ব বাংলা দখল এবং পূর্ব বাংলায় তার উপনিবেশ কায়েমের প্রতিবাদে ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর হরতাল পালন করুন।’ (সিরাজ সিকদার রচনা সংগ্রহ, পৃষ্ঠা ৬২৯)।
১৬ ডিসেম্বরের ওপর আমাদের ইতিহাসে সেই প্রথম ও শেষ হরতাল। উল্লেখ্য, হরতালটি সফল হয়েছিল।
চার
সর্বহারা মানুষের আরেক মহান নেতা আরনেস্তো চে গুয়েভারাও শহীদ হয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার ক্রীড়নকদের হাতে। সেভাবে সিরাজ সিকদারও শহীদ হয়েছেন। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা ইদানীং চে’র ছবিযুক্ত, স্টিকারযুক্ত গেঞ্জি, জ্যাকেট পরে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়। দেখে আমার ভালোই লাগে। হয়তো এটা লেটেস্ট ফ্যাশন। তারপরও বলব, যারা এসব পরিধান করছে তাদের মধ্যে শতকরা ১০ ভাগও যদি চে’র জীবন জানতে আগ্রহী হয় তাহলেও জনগণের জন্য মঙ্গলজনক। আর সাম্রাজ্যবাদের জন্য তা ক্ষতির কারণ। চে’র মতোই আমাদের মাটিতে জন্ম হয়েছিল সিরাজ সিকদারের। একই পথে তারা চলে গেছেন ওপারে। কিন্তু অবাক লাগে আমাদের ফ্যাশন শপগুলোতে সিরাজ সিকদারের ছবি যুক্ত একটি গেঞ্জিও কোনোদিন চোখে দেখিনি। বাংলাদেশের একজন তরুণ-তরুণীকেও দেখিনি সর্বহারা নিপীড়িত মানুষের নেতা সিরাজ সিকদারের ছবিযুক্ত জামা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা কি আওয়ামী লীগের ভয়ে নাকি ভারত পছন্দ করে না সেই কারণে? আমি ঠিক জানি না।
সার্বিক বিবেচনায় কমরেড সিরাজ সিকদার ছিলেন এক মহান দেশপ্রেমিক। ছিলেন বাস্তববাদী, সৃজনশীল প্রতিভাসম্পন্ন মার্কসবাদী স্বাপ্নিক পুরুষ। ছিলেন নির্ভুল সমাজ বিশ্লেষক। ছিলেন পরিশ্রমী দৃঢ়চেতা সংগঠক। ছিলেন অসাধারণ কবি। তার সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে বাকি রয়ে গেছে আমাদের। সেই মানুষটির তেমন চর্চা আজকাল আর চোখে পড়ে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তাঁকে বাদ দিয়ে রচনা করেছেন সুবিধাবাদের পতাকাবাহী ইতিহাসবিদরা। ‘গণযুদ্ধের পটভূমি’র মতো কাব্য যিনি উপহার দিয়ে গেছেন, তাকে নিয়ে সাহিত্যালোচকরাও নীরব। আর এভাবেই সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের এদেশীয় তাঁবেদাররা সিরাজ সিকদারকে আড়াল করে ফেলেছে লোকচক্ষুর। ইদানীং এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে কেউ কেউ।
তাদেরই একজন তমিজউদ্দিন এবং শ্রাবণ প্রকাশনী।
ধন্যবাদ দিই শ্রাবণ প্রকাশনীকে। শ্রাবণ প্রকাশনী প্রকাশ করেছে ৬৫২ পৃষ্ঠার ‘সিরাজ সিকদার রচনা সংগ্রহ’। যে গ্রন্থটি প্রতিজন দেশপ্রেমিক দায়িত্বশীল নাগরিকের অবশ্যই একবার অন্তত পাঠ করা জরুরি।
আর একটা কথা, সিরাজ সিকদার নিজে কমরেড চে গুয়েভারাকে ট্রটক্সিপন্থী রোমান্টিক বলে মনে করতেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১০:৫২
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭


জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×