somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

*মায়ের নাড়ীর বন্ধন*

১১ ই এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[লেখাটা বেশ পুরনো। লিখেছিলাম ২০১০ এর ফেব্রুয়ারিতে। সামান্য পরিমার্জন করে পোস্ট করলাম। :) ]

বেশ কিছুদিন ধরে ঢাকায় যেতে ইচ্ছে করছে। অনেকদিন হলো ঢাকায় যাওয়া হয় না। এদিকে ক্লাশ চলছে পুরোদমে। ক্লাশ বাদ দিয়ে যেতেও পারছি না। কিছু বইপত্রও কেনার আছে। ফরিদপুরে সে সব বই পাওয়া যায় না। কিনতে হবে ঢাকায় গিয়ে।

মেজ চাচা নূর মোহাম্মদ ঢাকার খিলক্ষেতে থাকেন। চাচাকে ফোন করলাম বইগুলোর একটা কোন বন্দোবস্ত করতে। কিন্তু তার সময় হয়ে উঠছে না। এদিকে বইগুলোর প্রয়োজন দিন দিন বেড়েই চলছে। সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেই ঢাকা যাব। কিন্তু সময় কোথায়?

কোনও একটা উপলক্ষে ৬ দিন ক্লাশ বন্ধ। আমার জন্য এ এক মহা সুযোগ। ঢাকায় যাওয়ার আগ্রহ এবং বই কেনার প্রয়োজন দু'টোই মেটানো যাবে এখন। এক ঢিলে দুই পাখি মারার আনন্দে আমি আত্মহারা। চাচাকে ফোন দিয়ে বললাম ঢাকায় আসছি।

ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল এর আগে আমি একা কখনও ঢাকায় যাই নি। কয়েক বছর আগে চাচার সাথে তার বাসায় গিয়েছিলাম। যাওয়ার রাস্তাগুলো মোটামুটি মনে আছে। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে সাহস করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। একটু সকাল সকালই বের হয়েছি। সাথে চাচীর জন্য কয়েকটি বেল নিয়ে নিলাম। চাচী বেল খুব পছন্দ করেন। প্রথমবারের মত একাকী ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রার শুরু লগ্নে কিছুটা ভয় মিশ্রিত রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম।

রাজবাড়ি থেকে ঢাকায় যেতে জল ও স্থল উভয় পথই পাড়ি দিতে হয়। প্রথমে বাসে তারপর লঞ্চে অতপর আবার বাসে চড়ে অবশেষে নবীনগর এসে নামলাম। সেখান থেকে ম্যাক্সিযোগে আব্দুল্লাহপুর। কিন্তু আব্দুল্লাহপুর থেকে খিলক্ষেতের কোনও বাস চোখে পড়ল না। জনৈক পথচারিকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি রাস্তা বাতলে দিলেন- 'ওই রাস্তায় খিলক্ষেতের বাস পাওয়া যাবে।' আমি তার দেখানো রাস্তার ধারে উপস্থিত হলাম। কিছুক্ষণ পর বাস এল, তাতে উঠে বসলাম। তখনও বুঝতে পারি নি একটু পর কী বিপদের সম্মুখীন হতে যাচ্ছি আমি। বাসে বসে আমার কেমন অস্বস্তিবোধ হচ্ছিলো। মন কেমন খুঁতখুঁত করছিলো, আমি ঠিকঠাক পৌঁছুতে পারবো তো?

বাসে উঠে প্রথম ভুলটি করলাম খিলক্ষেতের বদলে নতুন এয়ারপোর্টের ভাড়া পরিশোধ করে। কারণ ইতোপূর্বে বিশ্ব ইজতিমা উপলক্ষে একবার ঢাকায় এসেছিলাম। তখন এয়ারপোর্টের উল্টো দিকের রেলগেইটটি দেখে ধারণা করেছিলাম এটাই বুঝি খিলক্ষেত রেলগেট। এই ধারণাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। এয়ারপোর্টএ নেমে রেলগেইটের দিকে পা বাড়ালাম। আমার মনে হচ্ছিলো কে যেন বারবার আমাকে সতর্ক করে বলছে- 'তুই ভুল পথে পা বাড়াচ্ছিস, এটা খিলক্ষেতের রাস্তা না।

রেলগেইটের ওপারের রাস্তাটি কেমন অচেনা মনে হতে লাগলো। বাড়ি থেকে আসার সময় আম্মু বলেছিলো ঢাকার রাস্তাগুলো আর আগের মতো নেই। বদলে গেছে সব। আমার কেমন যেন ভয় হতে লাগল, তবে কি এসব রাস্তাও বদলে গেছে? এক পা দু'পা করে হাঁটছি কিন্তু পা দু'টো যেনো চলছে না। মনে হচ্ছিলো রাস্তার নীচ থেকে কেউ টেনে ধরেছে। ক্রমেই আশংকা দানা বাঁধতে লাগলো। আমি কি সঠিক পথেই হাটছি?

-'ভাই নামাপাড়া কোনদিকে?'

-'আমার জানামতে, এদিকে নামাপাড়া নামে কোনও এলাকা নেই, নদ্দাপাড়া নামে একটি এলাকা আছে। হতে পারে আপনি যে নামাপাড়ার খোঁজ করছেন এই নদ্দাপাড়াই সেটা।'

আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। ভয়ে ভয়ে এগোচ্ছি, কে জানে আজ কপালে কী লেখা আছে। এক পর্যায়ে রাস্তার একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু কোথায় নামাপাড়া? এতো নদ্দাপাড়া। নামাপাড়ার কোনও নামগন্ধও নেই। এদিকে জুম'আর নামাজের সময় গেছে। সামনেই একটি মসজিদ দেখে সেদিকে পা বাড়ালাম। যেতে যেতে এক ফেরিওয়ালার সাথে কথা হলো। সে পুরো ঘটনা শুনে বলল- 'আপনি উল্টোপথে এসেছেন। আপনি আবার এয়ারপোর্ট গিয়ে বাসে উঠবেন।সেখান থেকে খিলক্ষেতের ভাড়া দুই কি তিন টাকা।'

নামাজ পড়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পথে আম্মু কয়েকবার ফোন দিলেন। প্রতিবারই মিথ্যে করে বললাম, 'চিন্তা করো না আমি প্রায় পৌঁছে গেছি,। আমি যে পথ হারিয়ে পথে পথে ঘুরছি এটা আম্মুকে বলার সাহস করিনি।

এয়ারপোর্ট থেকে আবার বাসে চড়লাম। ভাবছি এবার বুঝি বাসায় পৌঁছুতে পারবো। এখনো বেশি বেলা হয়নি। কিন্তু বিধিবাম! ড্রাইভার খিলক্ষেত স্টান্ডে বাস থামালো না। বাসটি চলতে থাকলো আপন গতিতে। হেলপার যখন সাত রাস্তা, সাত রাস্তা বলে চেঁচাচ্ছে তার স্বরে তখন আমার হুশ ফিরলো। আমিতো খিলক্ষেত ফেলে অনেক দূর এসে পড়েছি। পাশের যাত্রীকে জিজ্ঞেস করতেই সে হেলপারকে আচ্ছা ধমক লাগালো আমাকে খিলক্ষেত না নামিয়ে দেয়ার জন্য। ততক্ষণে বাস মহাখালী ফ্লাইওভারে এসে দাঁড়িয়েছে। বাস থেকে নেমে আমিতো প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম। তবুও সাহস হারাইনি। আবার খিলক্ষেতের উদ্দেশ্যে বাসে উঠলাম।

ইতিমধ্যে আমার দেরী দেখে চাচা আম্মুকে ফোন দিলেন। বললেন- 'সাড়ে চারটা বেজে যাচ্ছে কই তোমার ছেলেতো এখনও এলো না।' একথা শুনে আম্মুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। আম্মু বলল- 'আচ্ছা আমি ফোন করে দেখছি ও কোথায় আছে।' চাচার সাথে কথা শেষ করেই আম্মু আমাকে ফোন দিলেন। আমি তখন রাজধানী শহরের গোলকধাঁধায় দিশেহারা। ক্ষোভে দুঃখে একেবারে হতবুদ্ধি। ফোন রিসিভ করলাম না এই ভেবে যে, কোথায় আছি জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দেবো আমি?

ফোন রিসিভ করছি না দেখে আম্মু আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু জাকির ভাইকে ফোন দিয়ে আমার খোঁজ নিতে বললেন। সে ফোন দিলে সেটাও রিসিভ করলাম না আমি। এমনকি এক পর্যায়ে আমি বেকুবের মতো মোবাইলটা বন্ধ করে দিলাম। বুঝতেই পারিনি ফোন বন্ধ করাটা আমার পরিবারের জন্য কতোটা দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে।

অবশেষে খিলক্ষেত স্ট্যান্ডে পৌঁছুলাম। বাস থেকে নেমে হেঁটেই রওনা দিলাম। যেন বাতাসের সাথে দৌড়পাল্লায় নেমেছি। এদিকে চাচা অস্থির হয়ে রাস্তায় আর বাসায় ছুটছিলেন। আমি বাসার কাছাকাছি পৌঁছুতেই হঠাৎ চাচার সাথে দেখা। আমাকে দেখেই আচ্ছা বকুনি দিলেন- 'এতো সময় লাগে আসতে? রাস্তা ভুলে গেছো নাকি?'

আমি উত্তর না দিয়ে মোবাইলটা অন করে আম্মুকে ফোন দিলাম। আম্মু ফোন রিসিভ করেই হেঁচকি দিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

-'তুই কোথায় বাবা?'

- 'শান্ত হও আম্মু! ভয়ের কিছু নেই। আমি পৌঁছে গেছি। চাচার সাথে বাসায় যাচ্ছি।'

আমার কোন খোঁজ না পেয়ে আম্মু খুব কান্নাকাটি করেছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ছোট মামা দুলাল ঢাকায় রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমার ফোন পেয়ে তারা শান্ত হন।

ঘটনা এটুকুই। কিন্তু এটি ছিলো আমার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষণীয় ঘটনা। আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম সন্তানের জন্য পিতামাতার কতোটা টান থাকতে পারে। অনুভব করেছিলাম মায়ের অকৃত্রিম ভালবাসা। যদিও এটা ছিলো আমার জীবনের একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু এর দ্বারা আমার চোখ থেকে কুয়াশার জাল সরে গেলো। অনুধাবন করলাম মায়ের নাড়ীর বন্ধন কতোটা অটুট।

[প্রিয় মা, ক্ষমা করো! তোমার এই অবুঝ ছেলে না বুঝে কতো কষ্টই না দিয়েছে তোমাকে। তবু তুমি কষ্ট নাওনি একটুও। এ তোমার হৃদয়ের উদারতা। তুমি অনেক বড় মা। তোমার এই বিশালতা ছাড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই কারো।]
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয় অংশ)

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:০৫


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমাদের সদ্য খনন করা পুকুরটা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেল। যা মাছ সেখানে ছিল, আটকানোর সুযোগ রইল না। আমি আর দুইবোন শিউলি ও হ্যাপি জালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×